রহিম, জাহেদুর
রহিম, জাহেদুর (১৯৩৫-১৯৭৮) রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী। বগুড়া শহরে জন্ম হলেও তাঁর পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার শাহজাদপুর থানার লোচনাপাড়া গ্রামে। পরে তিনি স্থায়িভাবে ঢাকায় বসবাস করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুর রহিম।
জাহেদুর রহিমের ডাক নাম বাবু। তিনি ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার শুরু আতিকুল ইসলামের নিকট। বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা করেন।
পেশাগত জীবনে তিনি প্রথমে ফিলিপস কোম্পানি এবং পরে শিক্ষা বিভাগে চাকরি করেন। কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ায় শেষপর্যন্তু তিনি সঙ্গীতজগতেই প্রবেশ করেন। ১৯৬১ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমী থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে তিনি একাডেমিতেই শিক্ষকতা করেন এবং রবীন্দ্রনাথের শ্যামা ও চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যে কণ্ঠ সঙ্গীতে অংশ নিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছায়ানট, অগ্নিবীণা, মূর্ছনা, আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত নিকেতন, নজরুল পরিষদ প্রভৃতি সঙ্গীত বিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্রে সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৭৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘নিজস্ব শিল্পী‘ হিসেবে চাকরি করেন। ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকার তাঁকে উক্ত পদ থেকে বরখাস্ত করে।
জাহেদুর রহিম ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকে যখন পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তখন যেকজন নির্ভীক রবীন্দ্রভক্ত এর বিরোধিতা করেন, জাহেদুর রহিম তাঁদের অন্যতম। সরকারের ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে সভা-সমিতি এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে তিনি অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি গেয়ে দেশের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করে তোলেন।
ষাটের দশকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ৬-দফাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে জাগরণ ঘটেছিল, জাহেদুর রহিম দেশাত্মবোধক রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে সেই আন্দোলনকে আরও বেগবান করেন।
দরাজ কণ্ঠের অধিকারী জাহেদুর রহিম অতি অল্পকালের মধ্যেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম রেকর্ড বের হয়। তিনি ছায়ানট প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন। ভারতে অনুষ্ঠিত বঙ্গ সংস্কৃতি মেলায় তিনি বহুবার অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি রাশিয়া ও ভারত সফর করেন। রেডিও ও টেলিভিশনে তিনি নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৭৮ সালের ১৮ জুন তাঁর মৃত্যু হয়। [মোবারক হোসেন খান]