যৌনতা

যৌনতা  যৌন আচরণবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষের যৌন আচরণের অভিজ্ঞতা। মানুষের যৌনতাকে ব্যাখ্যা করা যায় এইভাবে যে, কীভাবে বিপরীত লিঙ্গের (হেটোরো সেক্সুয়ালিটি) মানুষ এক জন আরেকজনকে আকৃষ্ট করছে কিংবা আকৃষ্ট হচ্ছেন, কিংবা সমলিঙ্গীয় আকর্ষণ (হোমো সেক্সুয়ালিটি) অথবা একই সঙ্গে সম এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করা (বায়ো সেক্সুয়াল) অথবা কোন লিঙ্গের প্রতি আগ্রহ বোধ না করা (এ সেক্সুয়াল)।

এটি সত্যি যে মানুষের যৌন আচরণ অন্যান্য প্রাণি থেকে ভিন্ন, কারণ যৌনসঙ্গম ছাড়া এটি কখনও অন্যান্য রূপে চর্চিত হতো না। বর্তমানে যৌনসঙ্গম ছাড়াও বিভিন্ন রূপে যৌন আচরণের প্রকাশ ঘটায়। আগে সকল প্রাণিকে মনোগামীর চর্চা করতে দেখা গেলেও এখন বেশিরভাগই প্রকৃতির সুযোগের উপর নির্ভরশীল। যৌনতাকে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আইনগত এবং দার্শনিক দিক থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। এটি অবশ্য নৈতিকতা. আদর্শ, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতার সঙ্গেও জড়িত।

যৌনতার জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গিটি মানব পুনরুৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। মনস্তত্ত্ববিদরা যৌনতাকে দেখেছেন একটি আবেগ এবং মনকেন্দ্রিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে। যৌনতা হলো মানুষের ব্যক্তিত্বের উৎস। যৌনতার যে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা যৌন আচরণ এবং অভিজ্ঞতায় মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথম দিকের গবেষণায় ফ্রয়েড যৌনতাকে ঘিরে ইডপাস কমপ্লেক্স এবং ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স এর ব্যাখ্যা দেন এবং শৈশব থেকেই মানুষের যৌনকেন্দ্রিক আচরণের ব্যাখ্যা দেয়া হয়। মানব সৃষ্টির প্রথম দিকে যৌনতাকে কেবল মানব পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হতো। যৌনতাকে বতর্মান সময়ে নানাভাবে ব্যাখা করা হয়: আনন্দ, আধ্যাত্মিকতার অংশ কিংবা পণ্য হিসেবে। বাউল সংস্কৃতিতে যৌনতা সাধনার অংশ। আবার বিশ্বজুড়ে কোনো কোনো দেশে এই যৌনতাকে পুঁজি করেই গড়ে উঠেছে ‘সেক্স ইন্ডাস্ট্রি’।

সামাজিকভাবে যৌনতা হলো মানুষের সামাজিক জীবনের অংশ। এর উপর রাজনীতি এবং মিডিয়ার এক ধরনের প্রভাব আছে। বলা হয়ে থাকে প্রতিটি সমাজ এবং সংস্কৃতি মানুষের যৌন আচরণের প্রকাশভঙ্গি নির্দিষ্ট করে দেয়। যৌনতাকেন্দ্রিক বিষয়ে বাচ্চাদের জানানোর জন্য যৌন শিক্ষার আয়োজন করা হয়, যাকে যৌনতা শিক্ষা পাঠ বলা হয়। সকল ধর্মে যৌনতার ক্ষেত্রে কিছু কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করা হয়েছে।

সামাজিকভাবে নারীর কাছে যে ধরনের যৌন আচরণ আশা করা হয়, পুরুষের ক্ষেত্রে তা থেকে ভিন্ন আচরণ প্রত্যাশিত থাকে। নারী সব সময় তার যৌনতাকে অপ্রকাশিত রাখবে। আফ্রিকাসহ আরব বিশ্বের অনেক দেশে নারী খৎনা প্রচলিত আছে। নারীর যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এবং নারী যেন কোনো ধরনের যৌন সুখ পেতে না পারে সেজন্য নারীকে খৎনা করা হয়।

বাঙালির সংস্কৃতিতে যৌনতা একটি গোপনীয় বিষয়, যৌনতা বিষয়ক বাতচিত আকাঙ্ক্ষিত নয়। সাধারণত সমবয়সী, সমলিঙ্গভুক্ত ও দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ পরিচিতদের ছাড়া কারও সঙ্গে তা আলোচিতও হয় না। যৌনতাকেন্দ্রিক নারীর আলোচনাকে ভালোভাবে দেখা হয় না। আশা করা হয় যে, নারী তখনই এটি নিয়ে কথা বলবে যখন সে শারীরিকভাবে ক্ষতির শিকার হবে। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই নারীর যৌনতার সঙ্গে সামাজিকভাবে ‘সতী’ ও ‘অসতী’র নির্মাণ জড়িত হয়ে পড়ে। বিয়ে বর্হিভূত যেকোন ধরনের যৌনতার চর্চা নারীর ক্ষেত্রে সামাজিক ‘ভালো-মন্দ’-এর ক্যাটাগরি তৈরি করে। বাঙালি সংস্কৃতিতে এমন কোন দিকনির্দেশনা নেই যার সাহায্যে কেউ তার পরিণত যৌবন, আকাঙ্ক্ষা এবং যৌনাচরণ হতে উদ্ভূত সমস্যাবলির মোকাবেলা করতে পারে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় সে অনুভূতি সঞ্চয় করে কিছুটা পিতামহ বা পিতামহীর সহায়তায়, কিছুটা বাড়ন্তত বয়সে সঙ্গীদের সহায়তায়, আর কিছুটা পারিপাশ্বিক বোঝাপড়ায়। বাংলাদেশে শিশু বা তরুণ বয়সীরা তাদের পিতামাতার সঙ্গে এমন শ্রদ্ধাপূর্ণ দূরত্ব রেখে চলে যে, তাদের কাছ থেকে যৌনবিষয়ক কোন শিক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। এরূপ অভাব অবশ্য পূরণ করে দেয় রক্ত সম্পর্কের বা পাতানো কোন কোন আত্মীয়। তারা হাস্য-পরিহাসচ্ছলে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়। পিতামাতা এ ধরনের আলোচনা থেকে বিরত থেকে ব্যাপারটির স্পর্শকাতরতা, তাৎপর্য এবং এ সম্পর্কিত নৈতিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন।

প্রাচীন ভারতবর্ষের সাহিত্যে জীবনচক্রে আশ্রম ধর্মের ভাবধারা প্রতিফলিত। কার কোন ধাপে অবস্থান তার ওপর নির্ভর করে তার আচরণবিধি ও ধর্ম, অর্থাৎ যথাযথ কর্ম। অন্যান্য অধিকাংশ কৃষক সমাজের মতো বাংলাদেশেও জীবনের স্বীকৃত ধাপসমূহ যৌন আচরণ ও প্রজননসম্পর্কিত প্রত্যাশার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও বৈশিষ্ট্য এই যে, পুরুষের ও নারীর প্রত্যাশিত আচরণ অত্যন্ত বিপরীতমুখী। ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে সমাজে লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা পালন করার জন্য এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, তা স্বভাবতই ভিন্ন হয়ে পড়ে। প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থাবলিতে বর্ণিত আশ্র্রম কাঠামোতে বিন্যস্ত জীবনসোপান মূলত শুধু পুরুষদের জন্যই একটি তাত্ত্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে বিবেচিত হতো।

আশ্রমের প্রথম ধাপ, ব্রহ্মাচার হচ্ছে কোন বালকের শিক্ষার প্রারম্ভকাল। আধুনিক ভারতীয় ভাষাসমূহে ব্রহ্মাচার বলতে সংযম বোঝায়। শিশুর চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থায় জীবনের কোন আনন্দ বা ভোগসুখের অবকাশ ছিল না, কারণ এগুলি ছিল কাম (প্রেম ও সৌন্দর্যতত্ত্ব) বৈশিষ্ট্যমূলক, এবং আশ্রমের পরবর্তী ধাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আশ্রমের দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে গার্হস্থ্য, অর্থাৎ সাংসারিক দায়িত্ব পালনের স্তররূপে বিবাহ এবং বৈষয়িক বিষয়াদিও এর অন্তর্ভুক্ত। গার্হস্থ্য পর্যায়ে কাম-এর ভূমিকা ব্যাপক। আশ্রমের তৃতীয় ধাপ বানপ্রস্থ হচ্ছে বৈষয়িক বিষয়াদি হতে অবসর গ্রহণ। এ পর্যায়ে যৌনক্রিয়া কিংবা প্রজনন সঙ্গত বিবেচিত হয় না। বাংলাদেশে পরিণত বয়সে সংযম প্রত্যাশিত, সাবালকত্বের তারুণ্যে যৌনতার প্রাচুর্য গ্রহণযোগ্য, এবং নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে মধ্যবয়সে যৌনক্রিয়া, এমনকি অনাচারও প্রত্যাশিত।

বাল্যাবস্থায় (শৈশব প্রান্তে) লিঙ্গ পার্থক্য সম্বন্ধে সচেতনতা এতই প্রখর হয়ে ওঠে যে, সাধারণত খেলার জন্য বালকেরা বালকসঙ্গী এবং বালিকারা বালিকাসঙ্গিনী বেছে নেয়। এ স্তরে তারা সচেতন থাকে যে, যারা বিপরীত লিঙ্গভুক্ত তাদের সঙ্গে অধিক বন্ধুত্ব পরিহার্য। শিশুকন্যা মায়ের সঙ্গে এবং শিশুপুত্র বাবার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে থাকে। বাল্যাবস্থার শেষের দিকে শিশুদের মনে বিপরীত লিঙ্গভুক্ত শিশুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকাটা লজ্জার ব্যাপার বলে ধারণা গড়ে ওঠে। বিশেষ এক ধরনের বাঙালি অনুষ্ঠানে একজন মেয়ে আর একজন মেয়ের সঙ্গে সই হিসেবে আনুষ্ঠানিক সখ্য এবং একজন ছেলে আর একজন ছেলের সঙ্গে দোস্ত হিসেবে আনুষ্ঠানিক বন্ধুত্ব পাতায়। প্রথম রজঃস্রাবের পর বালিকাকে সাবালিকা ও তৎপূর্বে নাবালিকা ধরা হয়।

উপনিবেশিক কাল থেকেই পেশা হিসেবে গণিকা বৃত্তির আইনগত স্বীকৃতি বিদ্যমান। শহর এলাকায় পৌরসভা এ পেশার ছাড়পত্র দিতে পারে। তা নৈতিকতাবিহীন বিবেচিত হলেও, বেআইনি নয়। কাউকে বলপূর্বক নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপে বাধ্য করা বেআইনি। উভয়লিঙ্গের ক্ষেত্রে সমকামিতা এখন পর্যন্ত সামাজিকভাবে ততোটা আদৃত না হলেও কোন কোন রাষ্ট্রে এটি ধর্মীয় স্বীকৃতি পেয়েছে।  [কে.এম.এ আজিজ এবং ফয়েজ করিম]