মেট্রোপলিটান আদালত
মেট্রোপলিটান আদালত বাংলাদেশের বিভাগীয় সদরে অথবা মেট্রোপলিটন শহরে অবস্থিত একটি স্বতন্ত্র ম্যাজিস্ট্রেসি। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি) অনুসারে এ আদালতের গঠন, কার্যবিধি, ক্ষমতা ও এখতিয়ার নির্ধারিত হয়। কার্যবিধিটি গোড়ার দিকে দুই ধরনের আদালতকে স্বীকৃতি দিয়েছিল: দায়রা আদালত ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এ দুটি আদালত সমন্বয়ে গঠিত হয় অধস্তন বিচারবিভাগ এবং তা ন্যস্ত হয় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণাধীনে।
১৯৭৬ সালে মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রবর্তিত হওয়ার পর একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৭৬ সালে কার্যবিধিটি সংশোধিত হয় এবং কার্যকর হয় ১৯৭৯ সালে। এই সংশোধিত অধ্যাদেশ মোতাবেক শুরুতে ঢাকার জন্য এবং পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীর জন্য আলাদা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসি স্থাপিত হয়। এই সংশোধনের দ্বারা ফৌজদারি কার্যবিধি বর্তমানে মূলত দুই ধরনের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে স্বীকৃতি দেয়। প্রথমটি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং দ্বিতীয়টি মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত।
ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধিত ভাষ্য সরকারকে একটি মেট্রোপলিটন এলাকায় একজন মূখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করে। একজন বা একাধিক অতিরিক্ত মূখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের ব্যবস্থাও বিধিতে রাখা হয়েছে। এধরনের অতিরিক্ত মূখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধি বা সাময়িকভাবে বলবৎ সরকারের অন্যকোন আইনবলে মূখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সকল অথবা যে কোন ক্ষমতা লাভ করতে পারেন। ফৌজদারি কার্যবিধি নির্দিষ্ট মামলাসমূহের বা বিশেষ শ্রেণীর মামলার বা যেকোন মেট্রোপলিটন এলাকায় বা এর অংশের কোন ব্যাক্তিকে সাধারণ মামলার ব্যাপারে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষমতা প্রদানের অধিকার সরকারকে দিয়েছে। বিধিতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের বেঞ্চ গঠনের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। মুখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রণীত বিধি সাপেক্ষে যেকোন দুই বা ততোধিক মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট একসঙ্গে একটি বেঞ্চ হিসেবে বসতে পারেন।
প্রত্যেক মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে যে মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে সে এলাকার সকল স্থানে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমা বিস্মৃত। একইভাবে মুখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তার এখতিয়ারভুক্ত এলাকার মধ্যে নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। ফৌজদারি বিধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকারের পূর্ব-অনুমোদন সাপেক্ষে মুখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে নিম্নোক্ত পর্যায়ে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাও প্রদান করা হয়েছে: ক. মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কার্যাবলী পরিচালনা ও বণ্টন এবং আচরণমালা নির্ধারণ; খ. মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের বেঞ্চ গঠন; (গ) এ বেঞ্চের অধিবেশনের সময় ও স্থান নির্ধারণ; ঘ. সেশন চলাকালে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে তা দূর করার পদ্ধতি নির্দেশ এবং ঙ. জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক অধস্তন ম্যাজিস্ট্রেটের উপর তার সাধারণ নিয়ন্ত্রণক্ষমতাবলে নিষ্পত্তিযোগ্য অন্য যেকোন বিষয়।
অতিরিক্ত মূখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটসহ সকল ম্যাজিস্ট্রেট এবং এসব ম্যাজিস্ট্রেটের বেঞ্চসমূহ মূখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের অধীন। এসব ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনের ব্যাপারে মূখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সময় সময় ফৌজদারি বিধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিধি প্রণয়ন করতে অথবা বিশেষ নির্দেশ জারি করতে পারেন। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলি শুধু মেট্রোপলিটন পুলিশ সংক্রান্ত বিধি লঙ্ঘন নয়, দন্ডবিধি লঙ্ঘনের মামলারও বিচার করতে পারে। মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্টের অধীন মামলার ক্ষেত্রে একজন পুলিশ কর্মকর্তার লিখিত রিপোর্টের ভিত্তিতেই কেবল কোনো অপরাধ আদালতের বিচারের আওতায় আসতে পারে। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটটের ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের কারাদন্ড, আইন মোতাবেক নির্জন কারাবাসের দন্ড, অনূর্ধ্ব ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং বেত্রাঘাতের নির্দেশ প্রদান। জরিমানা অনাদায়ে আদালত আইনানুগভাবে কারাদন্ড প্রদান করতে পারে।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের উপরে রয়েছে দায়রা আদালত। এক বা একাধিক জেলা নিয়ে গঠিত দায়রা আদালতকে সাধারণত দায়রা বিভাগ বলা হয়। ১৯৭৬ সালে সংশোধিত ফৌজদারি বিধি অনুসারে মেট্রোপলিটন দায়রা আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। মেট্রোপলিটন এলাকা একটি দায়রা ডিভিশন হিসেবে গণ্য হয়। সংশোধিত বিধিতে কিছু অস্থায়ী ধারা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, কার্যবিধি অনুসারে মেট্রোপলিটন দায়রা আদালত প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত মেট্রোপলিটন এলাকার আওতাভুক্ত দায়রা আদালত তার ক্ষমতা ও কার্যক্রম প্রয়োগ অব্যাহত রাখবে। এতে উল্লিখিত আছে যে, মেট্রোপলিটন দায়রা আদালত প্রতিষ্ঠিত হলে এ আদালত প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্বে মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত দায়রা আদালতে মুলতবি সকল মামলা ও কার্যাবলি এই দায়রা আদালত নিষ্পত্তি করবে। আইনের এ ধারার উদ্দেশ্য ছিল কোনোরূপ শূন্যতা সৃষ্টি না করে বিচার প্রক্রিয়া অবাধ ও সুশৃঙ্খল রাখা। এ ব্যবস্থা এজন্যই প্রয়োজনীয় ছিল যে, নতুন আদালত প্রতিষ্ঠা একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রট কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত সকল মামলাই দায়রা আদালতে আপিলযোগ্য।
এ কার্যবিধির অধীনে দায়রা আদালতকে কেবল মারাত্বক ও গুরুতর ধরনের অপরাধসমূহের বিচারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে যাতে অপরাধীর মৃত্যুদন্ড বা পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে। বিধিটি অবশ্য সরকারকে মুখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা একজন অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধ ব্যতীত অন্য সকল অপরাধ বিচারের দায়িত্ব প্রদানের ক্ষমতা দিয়েছে। এমনকি, দায়রা জজ কোন মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রদান করলে এই দন্ডাদেশও হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদনসাপেক্ষ হবে। ১৯৭৬ সালে বিধিটি সংশোধন করে মেট্রোপলিটন দায়রা আদালত প্রতিষ্ঠার বিধান যুক্ত করা এবং ১৯৭৯ সালের আগস্ট মাস থেকে তা কার্যকর করা হলেও, ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এধরনের আদালত প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেট্রোপলিটন দায়রা আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে। এসব আদালত ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৮ সালে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া আইনের মাধ্যমে চূড়ান্তরূপ লাভ করে। ফলশ্রুতিতে মুখ্য মেট্রোপলিটান আদালতসহ অন্যান্য আদালতে বিচারক ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়োগ দেয়া হয়। মুখ্য মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট মুখ্য বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে অভিহিত। প্রশাসনিক ক্যাডারভুক্ত ইতোপূর্বে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নামে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ তাদের বিচারিক ক্ষমতা এখন আর নেই। [এ.এম.এম শওকত আলী]