মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র

মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র  (১৮৬৫-১৯৪৮)  জাতীয়তাবাদী নেতা। ১৮৬৫ সালের ৫ জুন হুগলি জেলার বন্দিপুরে এক  ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। সাউথ সুবারবন স্কুলে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়। ১৮৮৪ সালে তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে কলকাতার  প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ এবং ১৮৮৬ সালে ইংরেজিতে এমএ পাস করেন। কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৮৮৭ সালে তিনি বহরমপুর কলেজে যোগদান করেন এবং ১৮৯০ সালে বিএল ডিগ্রি লাভ করে কলকাতা হাইকোর্টের উকিল হন। ১৮৯৫ সালে তিনি ‘ভাগবত চতুষ্পাঠী’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠন করেন।

স্যার  আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সতীশচন্দ্রের সহপাঠী।  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরশিবনাথ শাস্ত্রীব্রজেন্দ্রনাথ শীলরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরবিপিনচন্দ্র পালঅশ্বিনীকুমার দত্ত, স্বামী  বিবেকানন্দ প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এবং তাঁদের দ্বারা তিনি বিভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত  হয়েছেন। শিক্ষাবিষয়ক আত্মনির্ভরতার দৃষ্টান্তস্বরূপ সতীশচন্দ্র  ডন সোসাইটি (১৯০২) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর সম্পাদক হন। এটি ছিল ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের রিপোর্টের প্রতিবাদে সৃষ্ট একটি অরাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। বঙ্গীয় ছাত্রযুবকদের আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিতকরণ, তাদের মধ্যে ধর্মীয় ও নীতিশিক্ষার বিকাশ ঘটানো, মানসিক শক্তিবৃদ্ধি ও চরিত্রগঠনই ছিল এর উদ্দেশ্য। এছাড়া জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও দেশপ্রেমের উদ্বোধন এবং হাতে-কলমে কারিগরি শিক্ষা ও স্বদেশী শিল্পের সার্বিক উন্নয়নও এ প্রতিষ্ঠানের আদর্শ বলে পরিগণিত হতো।

শিক্ষাবিষয়ে স্বাদেশিকতা প্রবর্তনে ডন সোসাইটির দান অপরিসীম। ১৯০৫ সালের ৫ নভেম্বর সোসাইটির আহবানে জাতীয় শিক্ষা উদ্বোধনের জন্য এক বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়। বিপুল জনসমাবেশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং  হীরেন্দ্রনাথ দত্ত সে সভায় বক্তব্য রাখেন। সতীশচন্দ্র ছাত্রদের প্রতি  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ ও সেখানকার পরীক্ষা বর্জনের আহবান জানান। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (NCE, ১৯০৬) প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রভূত অবদান রাখেন। এর অধীনে Bengal National College স্থাপিত হলে  অরবিন্দ ঘোষ এর প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন এবং সতীশচন্দ্র হন তত্ত্বাবধায়ক। ১৯০৭ সালে অরবিন্দ পদত্যাগ করলে সতীশচন্দ্র অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন, কিন্তু অসুস্থতার কারণে পরের বছরই পদত্যাগ করেন। ১৯০৫ সালের ১০ অক্টোবর  জারিকৃত ‘কারলাইল সার্কুলার’ (Carlyle Circular)-এর বিরুদ্ধেও সতীশচন্দ্র প্রতিবাদ করেন।

স্বদেশী আন্দোলনের সূত্রপাত ও সফলতায় সতীশচন্দ্রের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ছাত্রদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রচার করেন। ১৯০৫ সালে  স্বদেশী আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই স্বদেশী শিল্পায়নের জাগরণে ডন সোসাইটি বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে। এ সময় সতীশচন্দ্রের সম্পাদনায় মাসিক  ডন (১৮৯৭) জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ও প্রচারে বিশেষ সুনাম অর্জন করে। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষিত যুবকরা এ পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন এবং নানা স্থানে বক্তৃতার মাধ্যমে ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। ডন পত্রিকা ছিল তাঁদের মুখপত্র, যা শিক্ষাক্ষেত্রেও বিরাট অবদান রাখে। সতীশচন্দ্র ১৯১৩ সাল পর্যন্ত এটি সম্পাদনা করেন। বন্দে মাতরম্ নামক দৈনিক ইংরেজি পত্রিকার সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। গান্ধীজির অহিংস আন্দোলন (১৯২২) তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এ আন্দোলনে গান্ধী গ্রেফতার হলে তিনি সবরমতীতে যান এবং কিছুদিন Young India পত্রিকা প্রকাশে সহায়তা করেন। ১৯৩০ সালে তিনি রাজেন্দ্রপ্রসাদের বিহার বিদ্যাপীঠ পরিদর্শন করেন এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন।

সতীশচন্দ্র ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও ধর্মপ্রাণ সাধু পুরুষ। তবে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি,  বর্ণপ্রথা এবং প্রাদেশিকতার বিরোধী ছিলেন। শিক্ষাবিস্তার ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ ব্রতী। সময়োপযোগী উপযুক্ত মানুষ তৈরি করার জন্যই তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১৮ এপ্রিল কাশীতে তাঁর মৃত্যু হয়।  [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]