বর্ণপ্রথা
বর্ণপ্রথা উপমহাদেশে আর্যীকরণের পর সামাজিক শ্রেণিসমূহকে বিন্যস্ত করেছিল। তাত্ত্বিকভাবে এ বিন্যাসে শ্রেষ্ঠত্বের ক্রম নির্ধারিত হতো সংশ্লিলষ্ট বিভিন্ন বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ তাঁদের চরিত্রে ও কর্মে যে সব গুণাগুণের প্রকাশ ঘটাতেন তার ওপর ভিত্তি করে। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাহ্মণরা ছিলেন ‘সত্ত্বা’র রক্ষক, এবং সে হিসেবে তাদের পবিত্রতম বলে গণ্য করা হতো। অন্য কথায়, ব্রাহ্মণদের পবিত্রতার প্রতিমূর্তি বলে বিশ্বাস করা হতো, এবং তাদের পৃথিবীর দেবতা হিসেবে গণ্য করা হতো। লক্ষ্যণীয় যে, পবিত্রতার এ মাত্রা ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের গুণাগুণের প্রতীক, যথাক্রমে ‘রজ’ ও ‘তম’-এর ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী বলে বিবেচিত হতো। আর সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের সবচেয়ে নিচু স্তরে থাকা শুদ্রদের এ রকম কোনো গুণই ছিল না বলে মনে করা হতো। চারভাগে বিভক্ত এ শ্রেণিবিন্যাসের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক যৌক্তিকতার ভিত্তি ছিল ঋগ্বেদের পুরুষ সুক্ত মন্ত্র, যার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
উপমহাদেশে আর্যায়নের প্রক্রিয়া বহিরাগতদের ক্রমান্বয়ে আত্মীভূত করে এবং বিভিন্ন বর্ণের, বিশেষত নিম্নবর্ণের সম্প্রদায়সমূহের সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটায়। পরবর্তীকালের জাতি-প্রথায় বর্ণ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ আরো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বর্ণ ব্যবস্থায় মোটা দাগের যে শ্রমবিভাগ প্রতিভাত ছিল, জাতিপ্রথায় তারই বিস্তারিত প্রকাশ লক্ষ করা যায়, যার মধ্য দিয়ে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর পেশাগত স্বাতন্ত্র্য এবং তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে তা নির্ধারিত হয়।
বাংলায় আর্য-সংস্কৃতির ক্রমবিস্তারের ফলে নির্দিষ্ট পেশায় নিয়োজিত সামাজিক গোষ্ঠীর লোকদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে শ্রেণি-বিভাজনের ব্যবস্থা চালু হয়। চাষী, ব্যবসায়ী, কারিগর ও সেবাপ্রদানকারী জাতসমূহ বর্ণের পরিভাষা অনুসারে শূদ্র বলে পরিচিতি লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে, কোনো বিশেষ পেশায় দক্ষতা অর্জনকারী শ্রেণিসমূহে লোকজনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে জাতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়, বর্ণের সংখ্যাকে যা বহুগুণে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, জাতিসমূহের পেশাগত শ্রেণির অধীন জনগণের বেশির ভাগের ওপর দায়িত্ব বর্তায় সমাজের প্রয়োজন মিটানোর। ফলে বর্ণ নয়, জাতি-প্রথার ভিত্তিতে হিন্দু সমাজের কাঠামো গড়ে ওঠে। এভাবে প্রাত্যহিক সামাজিক জীবনে বর্ণ তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। বাংলার মতো অঞ্চলসমূহে, যেখানকার আদি অধিবাসীদের মধ্যে কোন ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্য শ্রেণি ছিল না, সেখানে ব্রাহ্মণগণও জাতি হিসেবে পরিগণিত হতো, যদিও তাঁদেরকে বর্ণশ্রেষ্ঠ অর্থাৎ বর্ণসমূহের মধ্যে উচ্চতম হিসেবেও উল্লেখ করা হতো।
কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, জাতি ও পেশার মধ্যে সম্বন্ধের প্রতি জোর দেওয়ার ফলে জাত-প্রথার সমর্থকগণ উৎপাদন ও বণ্টনের একটি অ-প্রতিযোগিতামূলক বন্দোবস্তের ভিত্তি স্থাপনের চেষ্টা করছিল, যা প্রত্যেক ব্যক্তির জীবিকানির্বাহের উপায় ও ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সাধারণভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা খ্রিস্টীয় সাত শতক থেকে ভারতীয় স্থানীয় আর্থিক ব্যবস্থায় বিরাজমান সীমিত সম্পদ এবং ঘাটতি ও স্থবির অবস্থাসমূহের চাপের মধ্যে স্বচ্ছন্দভাবে উৎপাদন ও বণ্টনের নিশ্চয়তা প্রদান করে।
ভারতের নানা অংশে বর্ণ ব্যবস্থায় বিভিন্নতা বিরাজ করত। এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে, বিশেষভাবে স্মৃতি সাহিত্য থেকে বর্ণ ব্যবস্থা সম্পর্কে যে অস্পষ্ট ধারণা জন্মে, তা প্রাচীন বাংলায় বিরাজমান সামাজিক অবস্থার সাথে পুরোপুরিভাবে মানানসই নয়। এ কথা স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে, এ প্রাচীন স্মৃতিসমূহের কোনটিই বঙ্গদেশে রচিত হয়নি। সুতরাং প্রাচীন স্মৃতি সাহিত্যের পৃষ্ঠা থেকে বর্ণের উপর ভিত্তি করে বঙ্গীয় সমাজের শ্রেণিবিভাজন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য আহরণ করার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক হবে। কয়েকজন পন্ডিত যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এগারো শতকের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলে রচিত স্মৃতি সাহিত্য এত কম পাওয়া যায় যে সেগুলো বাংলার সামাজিক দৃশ্যপটের উপর আলোকপাত করতে পারে না। অধিকন্তু, নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক প্রমাণের উপর ভিত্তি করে কেবল অনুমান করা সম্ভব যে, এগারো শতকের পরবর্তী সময় থেকে বাংলায় সামাজিক ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থের সঙ্কলকগণ হিন্দু সামাজিক প্রথার ক্রমোচ্চ শ্রেণি বিভাজনের ব্যাপারে ব্রাহ্মণদের যথাযথভাবে বর্ণিত যুক্তির ভিত্তিকে সচেতনভাবে গ্রহণ করেছেন।
সেন-বর্মণ শাসনকালে বাংলায় কয়েকটি স্মৃতি ও অন্যান্য সাহিত্য রচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভবদেব ভট্ট ও জীমূতবাহনের লেখনী বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। প্রকৃতপক্ষে, এ পুঁথিসমূহ সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য জোগায় এবং বাংলার অতীতের উপর ঐতিহাসিক আখ্যান নির্মাণের জন্য ইতিহাসবিদগণ এগুলি ব্যবহার করতে পারেন।
এ স্মৃতিসমূহ ও অন্যান্য সাহিত্য ছাড়াও পৌরাণিক পুঁথিসমূহ, যথা- ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ বাঙালি সমাজ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। একই সময়ে বংশবৃত্তান্ত সংক্রান্ত পুঁথিসমূহের মধ্যেও কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য নিহিত আছে। একইভাবে, বল্লালচরিত নামে দুটি পুঁথিও পাওয়া যায়। এর একটি পুঁথি নবদ্বীপের রাজা বুদ্ধিমন্ত খানের নির্দেশে আনন্দ ভট্ট কর্তৃক রচিত হয় বলে অনুমান করা হয়। পুঁথিটি ১৫১০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত। তবে এর প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড বল্লালসেন এর নির্দেশে ১৩০০ শক সনের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে গোপাল ভট্ট রচনা করেন বলে অনুমান করা হয়।
বর্ণ ব্যবস্থা সম্পর্কে বৃহদ্ধর্মপুরাণে যে চিত্র অাঁকা হয়েছে তা বল্লালচরিত থেকে উদ্ভূত চিত্র থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক। বৃহদ্ধর্মপুরাণে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের ভিন্নরূপে শ্রেণিবিভক্ত করা হয়েছে এবং শূদ্রদের দুটি বৃহৎ শ্রেণি চিহ্নিত হয়েছে, যথা, সৎ শূদ্র (যাদের নিকট থেকে উচ্চতর জাতের লোকজন খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতে পারত) এবং অসৎ শূদ্র (যাদের সংস্পর্শকে অপবিত্রকর বলে বিবেচনা করা হতো। সামাজিক শ্রেণিবিভাজন অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের অব্যবহিত পরেই ছিল অম্বস্থ (বৈদ্য) ও করণ বা কায়স্থগণ। একইভাবে, শাঁখারি, মোদক, তন্তুবায়ী, দাস (চাষী), কর্মকার, সুবর্ণবণিক এবং অন্যান্য আরও উপ-জাত ও সঙ্কর জাতসমূহও বৃহদ্ধর্মপুরাণের বর্ণনায় স্থান পেয়েছে।
অন্যদিকে বল্লালচরিতে যে বর্ণনা রয়েছে তা পৌরাণিক পুঁথিসমূহের বর্ণনা থেকে অনেকটা পৃথক। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে যুক্তি দেখানো যায় যে, বল্লালসেনের সময় বাংলায় জাত ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। উদাহরণস্বরূপ বল্লালচরিত-এর রচয়িতাদের মতে সুবর্ণবণিকগণকে অপবিত্র শূদ্রদের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয় এবং তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধান ব্রাহ্মণদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। বল্লালচরিত-এর রচয়িতাগণ দৃঢ়ভাবে আরও বলেছেন যে, বণিক (ব্যবসায়ী) ও দাস (আজ্ঞাধীন চাষী)-দের চ্যালেঞ্জ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে বল্লালসেন কৈবর্তদের সৎ শূদ্রের পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করেন। শুধু তাই নয়, মালাকার, কুম্ভকার ও কর্মকারদেরও সৎ শূদ্রের পর্যায়ে উন্নীত করা হয়।
কিন্তু এর চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, বৃহদ্ধর্মপুরাণে তাঁতি, গন্ধবণিক, কর্মকার, তৌলিক (পান-সুপারি ব্যবসায়ী), কুমার, শাঁখারি, কাঁসারি, বারুজীবী (বারুই), মোদক ও মালাকারদের উত্তম-সঙ্কর জাত হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হলেও সুবর্ণবণিকদেরকে (স্বর্ণকার) জল-অচল (যাদের নিকট থেকে ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চ জাতের লোকজনদের খাদ্য ও পানি গ্রহণ নিষিদ্ধ) জাতসমূহ যেমন ধীবর (জেলে) ও রজকদের (ধোপা) সাথে এক শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। বল্লালচরিত-এর মধ্যে এ প্রপঞ্চটি ব্যাখ্যা করতে কতিপয় যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্যে এরকম রূপান্তর সংঘটিত হয়। উল্লেখ্য, বল্লালচরিত-এর বর্ণনা ইতিহাসবিদদের নিকট পুরোপুরিভাবে গ্রহণযোগ্য না হলেও এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, তা ষোল ও সতেরো শতকে রচিত বংশবৃত্তান্ত সংক্রান্ত পুঁথিসমূহের চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য।
পাল যুগের উপাত্তসমূহ থেকে প্রথমবারের মতো কৈবর্তদের সম্পর্কে কিছু প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক তথ্য মেলে। কৈবর্তদের প্রধান ব্যক্তি দিব্য অথবা দিবেবাক পাল রাজত্বে একজন ক্ষমতাবান কর্মকর্তা ছিলেন। কতিপয় সামন্ততান্ত্রিক ভূ-স্বামীর সহযোগিতায় ষড়যন্ত্র করে তিনি পাল কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করেন। দ্বিতীয় মহীপালের মৃত্যুর পর বাংলার কতিপয় অংশ কৈবর্ত অধিরাজ দিব্য ও তাঁর উত্তরাধিকারী রুদোক ও ভীমের হাতে চলে যায়। এসব ঐতিহাসিক ঘটনা শেষ পর্যন্ত বিশেষত উত্তর বাংলায় কৈবর্তদের সামাজিক অবস্থায় পরিবর্তন আনয়ন করে থাকতে পারে। পালযুগের উপাত্তসমূহ হিন্দুসমাজ বহির্ভূত অস্পৃশ্য জাতসমূহের ব্যাপারেও কিছুটা তথ্য জোগায়। সরকারি ভূমি অনুদানের মাধ্যমে যারা উপকৃত হয়েছে পালযুগের তাম্রশাসনসমূহে অন্তর্ভুক্ত এরকম নামের তালিকা থেকে দেখা যায় যে, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের অব্যবহিত পরেই আছে ব্রাহ্মণগণ এবং তাদের পর পর্যায়ক্রমে আসে বিভিন্ন চাষী সম্প্রদায়। ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্যদের কোন উলেখ নেই। কিন্তু এ ধরনের সামাজিক শ্রেণিসমূহ ছাড়া মেধ, অন্ধ্র ও চন্ডাল প্রভৃতি আরও কয়েকটি শ্রেণি ছিল। সকল প্রকার সামাজিক শ্রেণির মধ্যে চন্ডালদের সর্বনিম্ন বলে গণ্য করা হতো। ভবদেব ভট্টের মতো সামাজিক টীকা প্রদানকারিগণ তাদেরকে অন্ত্যজ জাতি বলে উল্লেখ করেছেন। চর্যাগীতিতে অন্য কয়েকটি নীচু জাত, যথা, ডোম অথবা ডোম্ব, চন্ডাল, শবর ও কাপালিকদের সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যায়। মধ্যযুগের কিছু পুঁথিতে নির্দেশিত হয়েছে যে, এ ধরনের নিম্নতর জাতসমূহের সাথে ব্রাহ্মণদের সংসর্গ নিষিদ্ধ ছিল।
ভবদেব ভট্ট নিম্নতর শ্রেণিসমূহ, যথা, চন্ডাল, পুক্কশক ও কাপালিকদের অস্পৃশ্য হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন। কাপালিকগণ অসভ্য সম্প্রদায় হিসেবে পরিগণিত হতো, যারা উদ্ভট আচার-অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রথা অনুসরণ করত। প্রধানত পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী শবরগণও নিম্নতর জাত হিসেবে পরিগণিত হতো। তবে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে তারা অন্ত্যজ জাতি বলে গণ্য ডোম ও চন্ডালদের চেয়ে উচ্চ সামাজিক মর্যাদায় আসীন ছিল।
অন্ত্যজ জাতি অথবা অস্পৃশ্য শ্রেণিসমূহ ব্যাধ/বনার, কাপালিক/কোল (আদিবাসী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত), কঞ্চ (কোচে হিসেবেও উল্লিখিত এবং সাধারণভাবে আদিবাসী শ্রেণিভুক্ত), হাড়ি (যাদেরকে হাঁড়ি বলেও অভিহিত করা হতো), ডোম, বাগতিত (বাগদি), শরক (যারা প্রাচীন শ্রবক সম্প্রদায়ের একটি অংশ), বলগ্রাহী ও চন্ডালদের দ্বারা গঠিত। অন্ত্যজ জাতসমূহের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বাইরে ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সমাজের ভৃত্য হিসেবে পরিগণিত হতো এবং তাই তাদেরকে নিম্নতম সামাজিক অবস্থান প্রদান করা হতো। চর্যাগীতি থেকে বাংলায় অস্পৃশ্য সম্প্রদায়সমূহের পেশা সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাঁশ থেকে জিনিসপত্র তৈরি, বৃক্ষ কর্তন, নৌকা চালনা, মদ তৈরি ও শিকারে নিয়োজিত ছিল। এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে, এ অন্ত্যজ জাতিসমূহের অনেকে বিভিন্ন রকমের জাদুবিদ্যা চর্চা করত বলেও বিশ্বাস করা হয়।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই যে, দশ থেকে পনেরো শতক পর্যন্ত বাংলায় অন্ত্যজ হিন্দু জাতিসমূহকে ওপরে তোলার লক্ষ্যে তেমন কোনো বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। প্রকৃতপক্ষে, এ সময় তাদের শ্রেণি-পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটেছে খুবই কম। জনসংখ্যার বৃহদংশ নিম্নতর জাতসমূহ দ্বারা গঠিত হওয়ার কারণে শ্রেণি-পরিবর্তনের সম্ভাব্য উপায়গুলোও তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। বিকল্প কাজের সুযোগ না থাকায় বংশপরম্পরায় কোন একটি নির্দিষ্ট পেশায় দীর্ঘকাল যাবৎ নিয়োজিত থাকার ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবে কঠোর সামাজিক অনুশাসনের জন্ম দেয়, সনাতন শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠানেও এর প্রভাব লক্ষ্যণীয় ছিল। একইভাবে, যদি শ্রেণি-উত্তরণের উপায়সমূহ বংশপরম্পরায় কোন একটি জাতের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় তবে সামাজিক শ্রেণি-বিভাজনে তাদের অবস্থান এক রকম চিরস্থায়ী হয়ে ওঠে এবং এর পেশাসহ জাতটির কর্তব্যসমূহ অলঙ্ঘনীয় বলে মনে হয়। অন্য কথায় বলতে গেলে, যথাযথভাবে জাতের কর্তব্যপালনও প্রায়ই নিম্নতর অথবা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়সমূহের স্বার্থের পরিপন্থী কঠোর সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়। [রাজশেখর বসু]
গ্রন্থপঞ্জি নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস : আদি পর্ব, (১ম সংস্করণ), কলকাতা, ১৩২৬ বাংলা সন; Hitesranjan Sanyal, Social Mobility in Bengal, Calcutta. 1981.