মুকুন্দদাস
মুকুন্দদাস (১৮৭৮-১৯৩৪) চারণকবি। ঢাকার বিক্রমপুরে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর। রামানন্দ নামক এক সাধকের নিকট দীক্ষা নেওয়ার পর তাঁর নাম হয় মুকুন্দদাস। পরে গুরুপ্রদত্ত এ নামেই তিনি সর্বসাধারণের নিকট পরিচিত হন।
মুকুন্দদাসের পিতামহ ছিলেন একজন মাঝি। তাঁর পিতা গুরুদয়াল বরিশালে ডেপুটি আদালতে আরদালির কাজ করতেন। সে সূত্রে তাঁরা বরিশালের বাসিন্দা হন। মুকুন্দ বরিশাল জেলা স্কুল ও ব্রজমোহন স্কুলে এন্ট্রান্স পর্যন্ত লেখাপড়া করেন, কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। উনিশ বছর বয়সে বীরেশ্বর গুপ্তের কণ্ঠে কীর্তন শুনে তিনি তাঁর কীর্তনদলে যোগদান করেন। পরে তিনি নিজেই একটি দল গঠন করে সঙ্গীতচর্চায় মনোনিবেশ করেন।
এ সময়ে সারা দেশে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন চলছিল। বরিশালের কংগ্রেসনেতা অশ্বিনীকুমার দত্তের নিকট স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে মুকুন্দদাস দেশাত্মবোধক গান ও যাত্রা রচনা করে মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। বরিশাল হিতৈষী পত্রিকায় তাঁর গান প্রকাশিত হয়; মাতৃপূজা (১৯০৮) নামে গানের একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়। বিদেশী পণ্য বর্জন এবং ব্রিটিশের শাসন-শোষণের কথা তিনি অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাষায় বর্ণনা করেন। তাঁর রচিত ‘ছিল ধান গোলা ভরা/ শ্বেত ইঁদুরে করল সারা’ জাতীয় গানে ইংরেজ সরকার ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। বিচারে তিনি তিন বছর কারাদন্ড ভোগ করেন এবং জরিমানার অর্থ জোগান দিয়ে সর্বস্বান্ত হন।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুকুন্দ কিন্তু পিছু হটার পাত্র ছিলেন না। তিনি ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে স্বদেশপ্রেমের গান ও যাত্রাপালা লিখে ও গেয়ে জনসাধারণকে জাগিয়ে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে চারণকবির মর্যাদা দেন। সাধনসঙ্গীত, পল্লীসেবা, ব্রহ্মচারিণী, পথ, সাথী, সমাজ, কর্মক্ষেত্র প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এর কয়েকটি তাঁর জীবদ্দশায় এবং বাকিগুলি মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। মুকুন্দদাস সারাজীবনে সাতশত মেডেল এবং বহু পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু ‘চারণকবি’ উপাধির মাধ্যমেই তিনি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। [ওয়াকিল আহমদ]