মিষ্টান্ন

মিষ্টান্ন  মিষ্টজাতীয় অন্ন বা খাবার। বাঙালির সামাজিকতা ও খাদ্যতালিকায় এর গুরুত্ব অনেক। জন্ম,  বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠান এবং যেকোনো শুভ সংবাদে পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা বাঙালি সমাজের এক চিরকালীন প্রথা। অনেকের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায়ও পরিমিত পরিমাণ মিষ্টান্নের ব্যবস্থা থাকে। হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণে মিষ্টির ব্যবহার বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। এভাবে সামাজিক ও ধর্মর্ীয় জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে মিষ্টান্ন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। প্রতিযোগিতা এবং রুচির পরিবর্তনের কারণে যেমন নানা রকম মিষ্টির উদ্ভব ঘটেছে, তেমনি অব্যাহত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই শিল্প এখন বাঙালির এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, যা দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বিস্তার লাভ করেছে।

প্রাচীনকালে ধান ও আখ চাষের ওপর ভিত্তি করে এই মিষ্টান্ন শিল্পের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। অতিথিকে ‘গুড়জল’ দিয়ে সম্মানিত করা ছিল বাঙালিদের একটি প্রাচীন রীতি। আখ, তাল ও খেজুর রস থেকে গুড় ও তালমিছরি তৈরির ধারা গড়ে ওঠে গ্রামে গ্রামে। গুড়ের সঙ্গে নারকেল, চিড়া, খৈ ও মুড়ি মিশ্রিত করে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। দুধ ও আতপ চালের সঙ্গে গুড় বা চিনি মিশিয়ে তৈরি হয় পায়েস, পিঠা-পুলি ইত্যাদি।

মধ্যযুগে ছানা আবিষ্কারের ফলে বাঙালির মিষ্টান্ন-সংস্কৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। ছানা ব্যবহারের আগে উদ্ভিজ্জ উপাদান হিসেবে বেসন, নারকেল, মুগডাল ও ময়দার ব্যবহার এবং প্রাণিজ উপাদান হিসেবে ক্ষীরের ব্যবহার হতে দেখা যায়। টকের সাহায্যে দুধকে ভেঙ্গে যা তৈরি করা হয় তাকে বলা হয় ছানা। এর সঙ্গে একটি সংস্কার বা বিশ্বাস জড়িয়ে আছে। দুধকে ভেঙ্গে ছানা তৈরি করা হয় বলে তা অবাঙালি ভারতীয়দের কাছে অচ্ছুৎ ও অভোজ্য। এজন্য বাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ক্ষীরকেন্দ্রিক মিষ্টান্ন-সংস্কৃতির ধারা গড়ে উঠেছে। ছানার তৈরি মিষ্টিতে কোনো আমিষ থাকে না। তাই বৈষ্ণবরা নিরামিষভোজী হওয়ায় বৈষ্ণব র্ধমের প্রসারের যুগে (১৬ শতক থেকে) ছানার মিষ্টির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।

মিষ্টান্নকে আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু করার জন্য নানা রকম পন্থা অবলম্বন করা হয়। যেমন পায়েসের মধ্যে তেজপাতা, এলাচগুঁড়া, কিসমিস, কাজুবাদাম এবং কমলার খোসা কুচিয়ে দেওয়া হয়। পিঠা-পুলিতে নানা রকম আকৃতি ও বর্ণ দেওয়া হয়, যেমন: লাল, নীল, সবুজ, হালকা গেরুয়া ও খয়েরি রঙের জীবজন্তু ও ফলফলাদির আকৃতিবিশিষ্ট পিঠা-পুলি তৈরি করা হয়। নানা রকম ছাঁচের সাহায্যে তৈরি মিষ্টিতে প্রতিফলিত হয় প্রস্ত্ততকারীর শিল্পমনস্কতার পরিচয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বিভিন্ন রকম সন্দেশের কথা উল্লেখ করা যায়, যেমন: বাঘ, হরিণ ও  হাঁস সন্দেশ; আতা, আম, জামরুল, খরমুজ, কাঁঠাল, লেবু ও নারকেল সন্দেশ; গোলাপফুল ও চালতা ফুল সন্দেশ ইত্যাদি। এসব সন্দেশকে আবার স্বাদ-বর্ণ-গন্ধময় করার জন্য জাফরান, কমলালেবুর খোসা, পালং শাকের রস ইত্যাদিও মেশানো হয়।

মধ্যযুগে কৃত্তিবাসের জন্মস্থান ফুলিয়ার হারাধন ময়রা আবিষ্কার করেন রসগোল্লা। রসগোল্লা আবিষ্কারের পর মিষ্টিশিল্পে বিপ্লব আসে; ক্রমে মধ্যযুগের লাড়ু-ক্ষীরে লাগে আধুনিকতার ছোঁয়া। বাগবাজারের নবীনচন্দ্র রায় ১৮৬৮ সালে আবিষ্কার করেন স্পঞ্জ রসগোল্লা। ক্রমশ মিষ্টিশিল্পের বিকাশের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। লালমোহনের মতো এক প্রকার লাল মিষ্টির নামকরণ করা হয় লেডিকেনি গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং-এর (১৮৫৬-১৯৬২) স্ত্রীর সৌন্দর্যের স্মারক হিসেবে। লেডিকেনিই কৃষ্ণরূপ ধারণ করে হয়েছে কালোজাম। রসগোল্লা রাজকীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে তার সাদা রূপের জন্য। এর রূপান্তরের পথ ধরেই একে একে আবির্ভূত হয়েছে রাজভোগ, রসমালাই, ক্ষীরমোহন, রসকদম্ব, দানাদার, ছানার মুড়কি প্রভৃতি মিষ্টি।

আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে একেক অঞ্চলে একেক ধরনের মিষ্টি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। মূলত রসগোল্লা মোটিফকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে আধুনিক মিষ্টান্নশিল্পের প্রধান ধারা। অখন্ড বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে বিশেষ বিশেষ মিষ্টান্ন তৈরির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। নদীয়ার কৃষ্ণনগরের সরভাজা ও সরপুরিয়া, বর্ধমানের সীতাভোগ ও মিহিদানা, মেদিনীপুরের বাবরশাহ, বীরভূমের মোরববা, মালদার রসকদম্ব এবং জলপাইগুঁড়ির ছাঁচি দইয়ের প্রসিদ্ধি বহু প্রাচীন। সাধারণত মিষ্টি তৈরির প্রাথমিক উপাদানসমূহের সহজলভ্যতা, সহজাত গুণাবলি, মিশ্রণপদ্ধতি এবং জলবায়ুর প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে মিষ্টি তৈরির এই আঞ্চলিক ধারাসমূহ গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে পোড়াবাড়ির (টাঙ্গাইল) চমচম, মুক্তাগাছার (ময়মনসিংহ) মন্ডা, কুমিল্লার প্যাড়া ও রসমালাই, ফরিদপুরের মালাইকারী, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, ঢাকার অমৃতি, জিলিপি, প্রাণহরা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন

পোড়াবাড়ির চমচম  এর শুরু প্রায় দেড়শ বছর আগে। উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলার অধিবাসী রাজা রামগোর এর নবরূপ দান করেন। তাঁর পৌত্র মতিলাল গোর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এর আধুনিক রূপ দেন। এর প্রধান উপকরণ দুধ, চিনি ও ময়দা। সেসঙ্গে যমুনা-ধলেশ্বরীর পানির সহজাত গুণ, কড়া পাক ও দুধের বিশুদ্ধতা এর গুণগত মান বৃদ্ধি করে। পানির বিশেষ গুণের কারণে সিরা কাটে ভাল। আর চিনির গায়ে দ্রবণ থাকে বলে এই মিষ্টি অন্যান্য মিষ্টি থেকে কম পচনশীল হয়। চমচমের ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় শুকনো দুধে তৈরি এক প্রকার গুঁড়া মাওয়া।

মুক্তাগাছার মন্ডা  বৃত্তাকার ও চ্যাপটা এক ধরনের ছানার সন্দেশ, যার ব্যাস সাধারণত দেড় থেকে দুই ইঞ্চি হয়ে থাকে। এর বিশেষত্ব হলো খাঁটি দুধ, পরিমিত পাক ও উপাদানসমূহের সুষ্ঠু মিশ্রণ। বিশেষ কৌশলে তৈরি ছানার এই মিষ্টি হয় মোলায়েম।

কুমিল্লার প্যাড়া ও রসমালাই  মন্ডার চেয়ে কম ব্যাসার্ধবিশিষ্ট মিষ্টান্ন হচ্ছে প্যাড়া। এটি দুধের ঘন ক্ষীরের সঙ্গে চিনির ঘন দ্রবণ মিশিয়ে তৈরি করা হয়। রসমালাই হচ্ছে ছোট আকৃতির লম্বাটে ধরনের রসগোল্লা। এটি ক্ষীরের মধ্যে ডোবানো থাকে। ঢাকা ও রংপুরেও রসমালাই তৈরি হয়, তবে তার রসগোল্লার আকৃতি গোলাকার। মালাই শব্দটি ফারসি ‘বালা’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ সর বা ক্ষীর। রসমালাই মানে সরে বা ক্ষীরে ডোবানো রসগোল্লা। রসমালাইয়ের রং হালকা বাদামি।

ফরিদপুরের মালাইকারি  দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি লম্বা এবং দেড় ইঞ্চির মতো চওড়া চ্যাপটা এক ধরনের রসগোল্লা। তবে এ রসগোল্লা রসমালাইয়ের মতো ক্ষীরে ডোবানো থাকে না। এর গায়ে ঘন সর বা ক্ষীর লাগানো থাকে, তাই রঙ হয় হালকা বাদামি।

নাটোরের কাঁচাগোল্লা  ছানাকে ঘন চিনির সিরায় ডুবিয়ে বিশেষভাবে পাক দেওয়ার পর ছেঁকে নেওয়া এক ধরনের রসগোল্লা।

রাজশাহীর রসকদম্ব  অনেকটা কদমফুল সদৃশ গোলাকৃতির শুকনো মিষ্টি। চিনির তৈরি ছোট ছোট বুটি দিয়ে এর উপরিভাগ আবৃত করা হয়। বুটিগুলির নিচেই থাকে ছানা ও মাওয়াতে মেশানো সন্দেশের বল। রসকদম্বের এরূপ আকৃতি হওয়ার পেছনে আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে। রাজশাহী ও মালদার উষ্ণাঞ্চল কদমফুলের জন্য বিখ্যাত।  বৈষ্ণবসাহিত্য থেকে লোকগাথা, পল্লীগীতি পর্যন্ত সর্বত্র এর গুণগাথা প্রচারিত। তাই মিষ্টির আকৃতি নির্মাণে শিল্পীদের মনে কদমফুল প্রভাব ফেলেছে।

বগুড়ার দই  আগেকার দিনে উত্তর বাংলায় শুকনো মৌসুমে গরু-মোষের চারণভূমিতে তৈরি করা হতো অস্থায়ী গো-শালা বা মহিষের আবাস, আর এসব গো-শালাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল দেশীয় পদ্ধতিতে দই তৈরির শিল্প। ‘বাথান’ ও ‘ভাওয়া’-কে কেন্দ্র করে যেমন উত্তরবঙ্গে এক সময় গড়ে উঠেছিল ভাওয়াইয়া গানের ধারা, তেমনি একইভাবে গড়ে উঠেছিল অন্যতম দুগ্ধশিল্প দইয়ের ধারা। এক মণ খাঁটি দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে তা থেকে দশ সেরের মতো দই পাওয়া যায়। তাই বগুড়ার দই স্বাদের দিক থেকে অনেকটা ক্ষীরের মতো।

সাভারের রসগোল্লা  এর বিশেষত্ব রন্ধনপদ্ধতি ও উপাদানসমূহের মিশ্রণপ্রণালীর মধ্যে নিহিত। জমাটাকার করার জন্য এই মিষ্টির ছানায় মেশানো হয় পরিমিত পরিমাণ ময়দা। রাজভোগের মতোই কড়া পাকে তৈরি করা হয় এ মিষ্টি। কড়া পাকের ফলে এর রঙ হয় অনেকটা পোড়ামাটি বা বাদামি রঙের, কিন্তু খেতে খুবই মোলায়েম এবং সুস্বাদু।

ঢাকার অমৃতি, জিলিপি ও প্রাণহরা  অমৃতি ও জিলিপি তেলেভাজা দুটি প্রাচীন মিষ্টান্ন। মাষকলাই ডালের গুঁড়া, বেসন ও ময়দা অমৃতি ও জিলিপির প্রধান উপাদান। সঠিক মাত্রায় তেলে ভেজে ঘন চিনির সিরায় ডুবিয়ে একে খাবারোপযোগী করে তোলা হয়। ছানার সঙ্গে মাওয়া ও সুগন্ধি মিশিয়ে হূদয় হরণকারী প্রাণহরা তৈরি করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের জনাই-এর মনোহরা মিষ্টান্ন আর ঢাকার প্রাণহরা বিখ্যাত হয়েছে মন ও প্রাণ হরণের বৈশিষ্ট্যে।

ঢাকায় এক সময় মিষ্টান্ন তৈরির প্রাচীনতম ও বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছিল মরণচাঁদ অ্যান্ড সন্স। এর সুখ্যাতি তখন দেশের বাইরেও পরিব্যাপ্ত ছিল। তবে প্রতিষ্ঠানের মূল শিল্পীর মৃত্যুর পরে সঙ্গত কারণেই মিষ্টির গুণগত মানে পরিবর্তন ঘটেছে। তা হলেও বর্তমানে প্রথম শ্রেণীর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এটি একটি। অন্যগুলি হচ্ছে আলাউদ্দিন সুইটমিট, বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার, বনফুল, যাদব ঘোষ, মহন চাঁদ ইত্যাদি। [মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি]