মিত্র, কৃষ্ণকুমার
মিত্র, কৃষ্ণকুমার (১৮৫২-১৯৩৬) ব্রাহ্ম সমাজ ও স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। ১৮৫২ সালে ময়মনসিংহ জেলার বাঘিল গ্রামে এক রক্ষণশীল কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা গুরুপ্রসাদ মিত্র ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন ভূস্বামী এবং নির্ভীক দেশপ্রেমিক। তিনি নিজগ্রামে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। ১৮৮১ সালে কৃষ্ণকুমার রাজনারায়ণ বসুর চতুর্থ কন্যা লীলাবতী দেবীকে ব্রাহ্মমতে বিবাহ করেন।
শৈশবে ময়মনসিংহের হার্ডিঞ্জ ভার্নাকুলার স্কুলে কৃষ্ণকুমারের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পরে তিনি জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৮৭০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মাসিক দশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৭৬ সালে তিনি জেনারেল অ্যাসেম্ব্লিজ ইনস্টিটিউশন থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কিছুদিন আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।
কৃষ্ণকুমার ছেলেবেলায় তাঁর পিতা এবং স্থানীয় ব্রাহ্মনেতা ও তাঁর স্কুলশিক্ষক গিরিশচন্দ্র সেনের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এ ক্ষেত্রে কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর ভূমিকাও কম ছিল না। ১৮৬৯ সালে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। পরের বছর অঘোরনাথ গুপ্তের সংস্পর্শে এসে তাঁর আদর্শদ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। ব্রাহ্ম নেতৃবৃন্দের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শই তাঁর জীবনে ব্রাহ্মধর্মকে মুখ্য বিষয়রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৮৭৬ সালে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনে যোগদান করেন এবং এর যুগ্মসম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৮৭৯ সালে কৃষ্ণকুমার এ.এম বসুর সিটি স্কুল ও কলেজে শিক্ষক নিযুক্ত হয়ে কলকাতা আসেন এবং পরে এ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ও তত্ত্বাবধায়ক পদে অধিষ্ঠিত হন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় কৃষ্ণকুমার এ কলেজে যুক্ত থাকলে সরকার কলেজের অনুমোদন প্রত্যাহার করে নেওয়ার ভীতি প্রদর্শন করলে ১৯০৮ সালে তিনি কলেজের কাজে ইস্তফা দেন।
কলকাতায় কলেজ জীবনে আনন্দমোহন বসু, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, কালীশঙ্কর শুকুল, শ্রীনাথ চন্দ প্রমুখের সঙ্গে কৃষ্ণকুমারের মিত্রতা ছিল। এঁদের প্রভাবে তিনি স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করেন। কৃষ্ণকুমার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং তাঁরা একত্রে রাজনৈতিক প্রচার ও সিভিল সার্ভিস রুলের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে উত্তর ভারত সফর করেন। ১৮৯০ সালে নীলচাষীদের সংগ্রামে তিনি অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় কংগ্রেসের জন্মলগ্ন (১৮৮৫) থেকে তিনি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু ১৯২১ সালে মাহাত্মা গান্ধী প্রবর্তিত অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধিতা করেন।
১৮৮৩ সালে কৃষ্ণকুমার কালীশঙ্কর প্রমুখের সহযোগিতায় সঞ্জীবনী নামে একটি জাতীয়তাবাদী বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং তিনি এর সম্পাদক নিযুক্ত হন। পত্রিকার শীর্ষদেশে ‘সাম্য, স্বাধীনতা, মৈত্রী’ এ আদর্শবাণী মুদ্রিত হতো। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও অধিক এ পত্রিকা কৃষ্ণকুমারের জনসংযোগের মাধ্যম ছিল। সঞ্জীবনীর এক দুঃসাহসিক সাংবাদিক হিসেবে তিনি তখন অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি তাঁর রচনায় দেশবাসীর সুপ্ত জাতীয় চেতনাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। তিনি ‘চা অথবা কুলির রক্ত’ নামক প্রবন্ধে তীব্র ভাষায় শ্রমিকদের প্রতি আসামের চা-বাগানের মালিকদের হিংস্র অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ্যে তুলে ধরেন। তাঁর প্রতিবাদের ফলে সরকার শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এছাড়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা এবং লবণ কর হ্রাসের জন্য অক্লান্ত সংগ্রাম তাঁর সাংবাদিক জীবনের স্মরণীয় কৃতিত্ব। তিনি স্বদেশী আইনের (Home rules) দাবি করেন এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপনের আবেদন জানান। সরকার তাঁর তীব্র সমালোচনায় ভীত ছিল।
কৃষ্ণকুমার বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের (১৯০৫-১১) প্রথম সারির নেতাদের অন্যতম ছিলেন। এ আন্দোলনের মূল পরিকল্পনা প্রচার এবং আন্দোলনের পূর্ব ও পরবর্তী জনমত গঠনে সঞ্জীবনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সরাসরি বিদেশী পণ্য বর্জন নীতির সমর্থন ও প্রচার চালান এবং সঞ্জীবনীতে বিদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারে অস্বীকৃতি জানান। ১৯০৬ সালে বরিশালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি পুলিশী অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানান। ১৯০৮ সালে মানিকতলা বোমা মামলায় অরবিন্দ ঘোষ গ্রেপ্তার হলে কৃষ্ণকুমারের উদ্যোগে চিত্তরঞ্জন দাশ ওই মামলায় অরবিন্দের কৌঁসুলি নিযুক্ত হন। এভাবে তিনি এবং তাঁর পত্রিকা স্বদেশী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অপরাধে ১৯০৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তিনি আগ্রা জেলে কারারুদ্ধ হন।
কৃষ্ণকুমার ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজসংস্কারক। আজীবন পৌত্তলিকতা, জাতিভেদপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছেন। নারী নির্যাতন বিষয়েও তিনি সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি গঠন করেছিলেন ‘নারী রক্ষা সমিতি’। তিনি মদ্যপানের বিরোধী ছিলেন এবং গ্রামাঞ্চলে উন্মুক্ত পানশালা স্থাপনের জন্য সরকারের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি এর বিরুদ্ধে জনমত গঠনের লক্ষ্যে আন্দোলন করেন। এক্ষেত্রে সঞ্জীবনীর ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষ্ণকুমার ছিলেন একজন গোঁড়া ব্রাহ্ম, উদার সমাজবাদী, উদ্যমী সংস্কারক এবং সুদক্ষ সাংবাদিক। রাজনীতিতে মধ্যপন্থী হলেও তিনি মনেপ্রাণে একজন স্বদেশী ছিলেন। সঞ্জীবনীর মাধ্যমে তিনি ভারতের জাতীয় আন্দোলনে উজ্জ্বল অবদান রেখে গেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা: মহম্মদ-চরিত, বুদ্ধদেব-চরিত ও বৌদ্ধধর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রভৃতি। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]