মিত্র, ইলা
মিত্র, ইলা (১৯২৫-২০০২) প্রখ্যাত রাজনীতিক ও কমিউনিস্ট নেত্রী। জন্ম ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায়। পিতা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা- অবিভক্ত বাংলার ডেপুটি অ্যাকাউনটেন্ট জেনারেল। মা মনোরমা সেন। তিন বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে ইলাই ছিলেন জ্যেষ্ঠ।
তিনি ১৯৪০ সালে বেথুন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর ১৯৪২ সালে বেথুন কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯৪৪ সালে একই কলেজ থেকে অনার্সসহ বি.এ পাস করেন। এর চৌদ্দ বছর পর ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে এম.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্রাবস্থায়ই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গে। পর্যায়ক্রমে তিনি যুক্ত হন গার্লস স্টোরস কমিটি, ছাত্র ফেডারেশন, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। মন্বন্তরের সময় তিনি একদিকে খাদ্য আন্দোলন ও ভুখা মিছিলে যোগদান করেছেন, লঙ্গরখানা পরিচালনায় সহায়তা করেছেন, অন্যদিকে খাদ্যাভাব, কাপড়ের সংকট, মহামারী এবং বিশেষত নারী-ব্যবসায়ীদের হাত থেকে অসহায় মেয়েদের বাঁচাতে তাঁর সংগঠন সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
বিবাহসূত্রে ১৯৪৫ সালে তাঁকে চলে আসতে হয় চাঁপাই নবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরে। সামন্ত পরিবারের রক্ষণশীলতাকে ভেঙ্গে, তখনকার পল্লীর অচলায়তনকে অতিক্রম করতে তিনি যুক্ত হন মেয়েদের জন্য গড়া নতুন স্কুলের সঙ্গে, শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীসময়ে পরিবারের শ্রেণি-অবস্থানকে অতিক্রম করে, কমিউনিস্ট নেতা ও স্বামী রমেন্দ্রনাথ মিত্র এর সঙ্গে, তিনি যুক্ত হন জমিদারি উচ্ছেদ ও জোতদারি শোষণের বিরুদ্ধে স্থানীয় পর্যায়ের আন্দোলনে। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে নোয়াখালীর হাসনাবাদে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজেও তিনি অংশ নেন।
১৯৪৬-৪৭ সালে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের উপর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বাংলার ১৯টি জেলায় গড়ে ওঠে তেভাগা আন্দোলন, তা পরিব্যপ্ত থাকে ১৯৪৯-৫০ সাল পর্যন্ত। তেভাগার দাবিতে রাজশাহী জেলার, বিশেষভাবে নাচোলের কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ইলা মিত্র অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন।
আদিবাসী কৃষকদের মধ্যে তাঁর এতটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল যে, তারা তাঁকে শুধু বিশ্বাসই করতেন না, সে সঙ্গে নিজেদের একজন বলেও ভাবতেন। ইলা মিত্র ক্রমশ হয়ে ওঠেন সাঁওতাল ও অন্যান্য কৃষকদের ‘রাণীমা’। সাঁওতাল মেয়েদের ভেতরে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার এবং তাদেরকে সংগঠনে টেনে আনার ক্ষেত্রে ইলা মিত্র সবিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন। বরেন্দ্র এলাকায় প্রচলিত ব্যবস্থায় বিশ আড়ি (কাঠা/ ধামা) ধান কাটা ও মাড়ানোর জন্য জমিতে চাষাবাদ করেছেন যে কৃষক বা ঐ উদ্দেশ্যে নিযুক্ত মজুর পেতেন তিন আড়ি ধান। ঐ ধানের পরিমাণ বাড়িয়ে সাত আড়ি করা এবং ফসলের তেভাগা প্রতিষ্ঠার দাবিতে তাঁর ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে তা জায়গা করে নিয়েছে কালোত্তীর্ণ স্থানীয় লোকগীতিতে। একটি আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তুলতে যে যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়, নাচোল বিদ্রোহে তিনি তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তাঁর কর্মকান্ডের দ্বারা জনমনে স্থায়ী আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তবে নাচোলের তেভাগা আন্দোলন শেষাবধি সফল হয়নি। কৃষকদের সঙ্গে সংঘর্ষে দারোগাসহ চারজন পুলিশ নিহত হওয়ার সূত্রে পাকিস্তানি শাসকবর্গ আদিবাসীদের ওপর প্রচন্ড নিপীড়ন চালাতে শুরু করলে নাচোলের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। ইলা মিত্র নিজে চরম লাঞ্ছনার শিকার হন, এ ছাড়া তাঁকে এক নম্বর আসামি করে অনিমেষ লাহিড়ী, বৃন্দাবন সাহা, শেখ আজাহার হোসেনসহ মোট ৩১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রুজু করা হয় এবং বিচারে ইলা মিত্রসহ ২৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। তবে তাঁর মুক্তির দাবিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সহ বিভিন্ন মহল সোচ্চার হন। নাচোলে সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের বিষয়টি পূর্ব বাংলার সংসদে উত্থাপনের চেষ্টা মুসলিম লীগ সরকার প্রতিহত করে। তবে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় হীরেন মুখার্জী ইলা মিত্রের বিষয়টি জোরালোভাবে উত্থাপন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হলে চিকিৎসার প্রয়োজনে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে কলকাতা যাবার পর ইলা মিত্র আর পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেননি।
ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিশ্চিত না হওয়ায় প্রচন্ড দুরবস্থায় কয়েক বছর বস্তিতে জীবনযাপন করেন। এরপর এম.এ পাস করে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন। ১৯৬২-৭৮ সময়ের মধ্যে মানিকতলা নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি পর পর চারবার পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে দুবার তিনি ছিলেন বিধান সভায় কমিউনিস্ট পার্টির ডেপুটি লিডার। ভারতে শিক্ষা আন্দোলন ও নারী আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালনকারী ইলা মিত্র ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক পর্যায়ের নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে তিনি জনমত সংগঠিত করতে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নেন। রাজনৈতিক কারণে পশ্চিম বাংলাতেও তিনি চার বার (১৯৬২ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত) কারাবরণ করেন। যদিও ভারত সরকার তাঁকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ হিসেবে এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার অ্যাথলেটিক্সে অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করে। এ ছাড়া হিরোশিমার মেয়ে গ্রন্থানুবাদের জন্য তিনি সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কার লাভ করেন। ইলা মিত্রের অসাধারণ সাহসী ও সংগ্রামী জীবন বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার প্রগতিশীল মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন লেখকের লেখায়, কবির কবিতায়, পত্রিকার প্রতিবেদনে ইলা মিত্রের সাহসী ও সংগ্রামী ভূমিকার কথা উপমা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। ১৩ অক্টোবর ২০০২ সালে ইলা মিত্রের কলকাতায় মৃত্যু হয়। [মেসবাহ কামাল]