মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি আত্মরক্ষামূলক একটি নারী সংগঠন। এ সমিতি ১৯৪০-এর দশকে সাম্যবাদীদের দ্বারা গঠিত হয়। একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক পরিবেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এ সংগঠনের জন্ম। The Communist Party of India (CPI) ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক এবং নারীসহ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সকল লোকজনকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৯৩৬ সালে The All India Kisan Sabha (AIKS), The All India Students Federation (AISF) এবং The Writers and Artists Association প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আন্দোলনের প্রধান অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়। এই একই অনুপ্রেরণা থেকে The Indian Peoples Theatre Association (IPTA) এবং মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠিত হয়েছিল। একটি আনুষ্ঠানিক সংগঠন গড়ে তোলার চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৪২ সালে Women's Self-defence League প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠন ঐ একই বছরে বাংলার বিভিন্ন জেলায় বহু মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করে এবং সবশেষে কেন্দ্রীয় সংগঠনের সঙ্গে একীভূত হয়ে ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি (এম.এ.আর.এস) নামে আত্মপ্রকাশ করে।
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সংগঠকগণ ‘মেহনতি’ (শ্রমজীবী) নারীর সমস্যা নিরসনের উপায় বের করার চেষ্টা করেন এবং আর্থ-সামাজিক ও আইনগত সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত নারীদের ‘মুক্তি’র ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁরা তাঁদের সংগঠনে বর্গাচাষি, ভূমিহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠী, কৃষক, দিনমজুর এবং আদিবাসী পরিবারের নারীদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁরা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নারীদেরকেও সমবেত করার চেষ্টা করেন এবং তাদেরকে সকল প্রকার অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করার জন্য প্রণোদিত করেন। সর্বোপরি, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীদেরকে ‘অধস্তন মানসিকতা’ পরিত্যাগ করতে এবং দলীয় মনোবল ও শ্রেণি সংহতির মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী হতে উৎসাহ প্রদান করে।
সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সকল মতাবলম্বীর সমন্বয়ে নারীদের জন্য একটি সাধারণ প্লাটফর্ম গঠনের উদ্দেশ্যে এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণ (এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন রেণু চক্রবর্তী, কমলা মুখোপাধ্যায়, ইলা রেইড, গীতা মল্লিক ও মণিকুন্তলা সেন) একটি ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। নাজিমুন্নেসা আহমেদ, রাবেয়া বেগম, মাকসুদা বেগম, লাইলা আহমেদ, তাসমিনা খাতুনের মতো মুসলিম নারীরাও এতে যোগদান করেন। ১৯৩৫ সালে কলকাতা হাইকোর্টের একমাত্র নারী অ্যাডভোকেট এবং ধাঙ্গড়দের (মেথর) মাতাজী হিসেবে সুপরিচিত সকিনা বেগমও ১৯৪০ সালের ২৬ মার্চ ধাঙ্গড়দের ধর্মঘটে সফল নেতৃত্ব দেওয়ার পর মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি সামাজিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমর্থন পাওয়ার লক্ষ্যে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি তিনটি মৌলিক কর্মসূচি গ্রহণ করে: ১. প্রতিরক্ষা; ২. রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি ও জাতীয় সরকার গঠন এবং ৩. অনাহার ও মৃত্যু থেকে জনগণকে রক্ষা। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রথম দুটি কর্মসূচি, বিশেষ করে ‘গান্ধীকে মুক্তি দাও’ প্রচারাভিযান একদল জাতীয়তাবাদী নেতা এবং বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী এবং হাজরা বেগম যথাক্রমে কলকাতা (১৯৪৩) এবং বরিশালে অনুষ্ঠিত (১৯৪৪) এই সমিতির প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভানেতৃত্বের দয়িত্ব পালন করেন। আশাপূর্ণা দেবী, রাণী মহলানবীশ, লীলা মজুমদারের মতো অনেক খ্যাতিমান লেখিকা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির ঘরে বাইরে পত্রিকায় নিয়মিতভাবে লিখতেন। নেলী সেনগুপ্তা, জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী, শান্তিসুধা ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা মিত্র, ফুলরেণু দত্ত, কল্পনা দত্ত, হামিদা মোমিন, শাহজাদী বেগম, ছবেদা খাতুন এবং রেবেকা বেগমের মতো অনেক বিখ্যাত কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেত্রী এসব প্রাদেশিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। অবশ্য রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকায় কংগ্রেস এবং লীগের মহিলা শাখার মধ্যে সংহতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। ভারত ছাড় আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকায় কংগ্রেস অসন্তুষ্ট হয় এবং সেই সময় থেকে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি সিপিআই-এর মহিলা শাখা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির তৃতীয় কর্মসূচি গৃহীত হয় মূলত যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ পরিণতি থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য। ১৯৩৯ সালে এ.আই.এস.এফ-এর শাখা হিসেবে গঠিত ছাত্রী সংঘের (All Bengal Girl Students Association, [ABGSA]) সদস্যবৃন্দ মূলত এই কর্মসূচি পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সংঘের কার্যকরী কমিটি ছিল ক্ষুদ্র পরিসরে প্রায় ঐক্যবদ্ধ একটি ফ্রন্ট। এই সংঘ কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টিসহ সকল বামপন্থী দলের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে। সংঘের সদস্যগণ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কার্যাবলির মৌলিক করণীয় দিক নির্ধারণ করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে কলকাতার কলেজসমূহ জেলা শহরে স্থানান্তরিত হলে এই সংঘ ১৯৪১ সালের মধ্যে বহু জেলায় এর শাখা স্থাপন করে। এসব শাখার সদস্যগণ ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ত্রাণকার্য সংগঠনে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিকে সক্রিয় সাহায্য প্রদান করেন। তাঁরা লঙ্গরখানা, দুধ বিতরণ কেন্দ্র, শিশুসেবা কেন্দ্র ইত্যাদি গঠন করেন। সহানুভূতি এবং দক্ষতার সঙ্গে এসব কাজ পরিচালনার জন্য তাঁরা দুর্গতদের আস্থা অর্জন করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রথম দুটি প্রাদেশিক সম্মেলনের (১৯৪৩ ও ১৯৪৪) অর্ধেক প্রতিনিধি অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত এবং দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকা থেকে অংশগ্রহণ করেন।
দুর্ভিক্ষের সময় সরকারের ত্রাণকার্য বিতরণে অদক্ষতা সমিতির দৃষ্টিগোচর হয় এবং অত্যন্ত কঠোর ভাষায় সরকারের খাদ্যনীতির সমালোচনা করে। সমিতি দাবী করে যে, খাদ্যস্বল্পতার কারণে দুর্ভিক্ষ হয়নি, বরং খাদ্য মজুত এবং সুষম বণ্টন না হওয়ার কারণেই দুর্ভিক্ষ হয়েছে। সরকারের ত্রাণনীতির বিরুদ্ধে সমিতি প্রতিবাদ সভার আয়োজনসহ ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহের দাবি করে। সমিতি কালোবাজারি এবং মজুতদারির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। এমনকি অনেক সময় তাদের মজুদ খাদ্যশস্য বিক্রি করতে বাধ্য করে। ‘সরকার সকলের জন্য খাদ্য ব্যবস্থা করবে’- এটিই তাদের প্রধান শ্লোগানে পরিণত হয়।
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি কলকাতাসহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় নারীদের ভুখা মিছিল সংগঠিত করে। ১৯৪৩ সালের ২০ জানুয়ারি দিনাজপুরে জনৈক কলেজ ছাত্রী কর্তৃক (অলকা মজুমদার, যিনি পরবর্তীসময়ে ছাত্রী সংঘের সেক্রেটারি হন) প্রথম ভুখা মিছিল সংগঠিত হয়। এই মিছিলে বিপুল সংখ্যক রাজবংশী নারীরা অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী স্মরণীয় ভুখা মিছিলটি ১৯৪৩ সালের ১৭ মার্চ অ্যাসেম্বলি হাউজের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। এই মিছিলে প্রায় পাঁচ হাজার ভুখা নারী অংশগ্রহণ করেন। মিছিলে অংশগ্রহণকারী নারীগণ বৃহত্তর কলকাতার বিভিন্ন বস্তি এবং উত্তর-দক্ষিণ উপনগরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসেন। তারা বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হককে ১০০ মণ চাল বিতরণে বাধ্য করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি বাঁকুড়া, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ঢাকা, বরিশাল, বগুড়া, খুলনা এবং ময়মনসিংহ জেলায় একই ধরনের ভুখা মিছিল সংগঠিত করে। ওই মিছিলে বিপুল সংখ্যক মুসলিম নারী অংশগ্রহণ করেন। প্রশাসনিক কারণে খাদ্য দুষ্প্রাপ্যতার বিরুদ্ধে এ ধরনের সংগঠিত প্রতিবাদ ভারতের নারী আন্দোলনের একটি নতুন ও অভিনব বৈশিষ্ট্য।
দুর্ভিক্ষ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। মানবসভ্যতার প্রতি হুমকি ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রচারাভিযানের গুরুত্ব তারা সকল স্তরের নারীর নিকট তুলে ধরেন। The Indian Peoples Theatre Association (IPTA) এবং এর স্থানীয় দলসমূহ ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রচারাভিযানের প্রধান মাধ্যম ছিল। সুচিত্রা মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, শোভা সেন, প্রীতি ব্যানার্জী, সাধনা রায় চৌধুরীর মতো কিছু ছাত্রী (যাঁরা পরবর্তীকালে সংগীত ও নাটকে বিখ্যাত হন) আইপিটিএ-এর সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন, যা সাধারণ নারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্যাগণ স্থানীয় সভা-সমিতির পাশাপাশি বিভিন্ন শহর, শিল্পবস্তি এবং গ্রামে এসব সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। স্থানীয় নারীগণ ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন কিনা তা জানা যায়নি, তবে তাদের জীবনধারায় চিত্তবিনোদনের একমাত্র উৎস হিসেবেই সম্ভবত তারা এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আগ্রহ সহকারে উপস্থিত হতেন। এই সাংস্কৃতিক কার্যক্রম মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির শাখা গঠনের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। ১৯৪৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে সারা বাংলার ২৭টি জেলায় ৩৯০টি প্রাথমিক কমিটি ছিল। এর দুই-তৃতীয়াংশ কমিটি বর্তমান বাংলাদেশেই গঠিত হয়েছিল। ১৯৪৩ সালে এর সদস্যা সংখ্যা ছিল ২২,০০০, যা ১৯৪৪ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৩,০০০-এ উন্নীত হয়।
দুস্থ ও নিঃস্ব নারীদের সামাজিক জীবন পুনর্গঠনে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির একটি মুখ্য ভূমিকা ছিল। দুর্ভিক্ষের কারণে নিঃস্ব ও পরিবার পরিত্যক্তা বিপুল সংখ্যক মহিলা সহজেই দেহ-ব্যবসার শিকার হয়। সরকারের যৌনব্যাধি বিভাগের মেডিক্যাল রিপোর্টে প্রকাশ করা হয় যে, ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে বাংলায় পতিতার সংখ্যা বিশ হাজার থেকে পয়তাল্লিশ হাজারে উন্নীত হয়েছে। এই চরম দুর্দশা থেকে দুর্ভিক্ষ পীড়িত নারীদের রক্ষা এবং পুনর্বাসিত করতে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ১৯৪৪ সালের শেষ দিকে নারী সেবা সংঘ প্রতিষ্ঠা করে। এটি ছিল উনিশ জন নারী এবং ত্রাণ সংগঠনসমূহের সমন্বয়ে গঠিত একটি শীর্ষ কমিটি। এভাবে দুস্থ ও নিঃস্বদের সামাজিক জীবন পুনর্গঠনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা উপদলীয় রাজনৈতিক স্বীকৃতির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করে। আত্মনির্ভরতা এবং আত্ম-কর্মসংস্থান ছিল সংঘের প্রধান লক্ষ্য। নোয়াখালী, তমলুক, বসিরহাট, হাওড়া, ফলতা, জয়নগর, ২৪ পরগনা এবং বরিশালে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। একই উদ্দেশ্য নিয়ে মনোরমা বসু বরিশালে নারী জ্ঞানভবন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের কার্যালয়গুলি দুস্থ ও নিঃস্ব মহিলাদের প্রধান আশ্রয়স্থল ছিল। উভয় সংগঠনই তাদেরকে হাতের কাজ এবং হস্তশিল্প সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। নারী সেবা সংঘের দক্ষিণ কলকাতার কার্যালয় ছিল দরিদ্র কৃষক ও আদিবাসী মহিলাদের হস্তশিল্প উৎপাদন ও বিক্রয় কেন্দ্র। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করতে এবং মহিলাদের (হিন্দু মহিলা) বিবাহ বিচ্ছেদ ও পৈতৃক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার লাভের জন্যও সংগ্রাম করে।
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব না দিলেও কৃষক এবং আদিবাসী নারীদের মধ্যে প্রতিরোধের চেতনা এবং শ্রেণি সংহতি বিকাশের ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে অবদান রাখে। এই আন্দোলন ১৯টি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং এতে আধিয়ার সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যক লোক জড়িত ছিল। আধিয়ারদের অধিকাংশ এসেছিল তফসিলি সম্প্রদায় ও আদিবাসী শ্রেণি থেকে। আন্দোলনে পুরুষরা গ্রেপ্তার হলে বা আত্মগোপন করলে এসব সামাজিক গোষ্ঠী থেকে আগত নারীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে এবং নিজেদেরকে স্থানীয় নেত্রী হিসেবে সংগঠিত করে প্রকৃত মহিলা শক্তি প্রদর্শন করে। তারা প্রায়ই পুলিশদের পরাভূত করত। দিনাজপুর, রংপুর, মেদিনীপুর এবং ২৪ পরগনার সংগ্রামে মুসলিম কৃষক নারীদের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, মুসলিম পরিবারেও বিপ্লবী নারীর জন্ম হয়েছে। নারীদের মধ্যে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির পূর্বকার্যাবলির ফলেই তাদের জাতি এবং সম্প্রদায়গত সংহতি সম্ভব হয়।
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি দুর্ভিক্ষ চলাকালে ত্রাণকার্য পরিচালনার সময় নারী কৃষকদের সামন্ততান্ত্রিক অন্যায় ও শোষণ সম্পর্কে সচেতন করে। এছাড়াও এই সমিতি নতুন ধাঁচে মহিলা কৃষকদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সেগুলিকে বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের আন্দোলনে যুক্ত করার চেষ্টা করে। তেভাগা আন্দোলনের সময় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি বহু প্রতিবাদ সভা করে এবং দিনাজপুরে ধর্ষণের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য কমিটি গঠন করে। এ ক্ষেত্রে আত্মরক্ষা সমিতির দুজন সদস্য রাণী মিত্র এবং বীণা গুহ সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন। The All India Kisan Sabha (AIKS) সহ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নারী কৃষকদের সমষ্টিগত চুক্তিতে তাদের নিজস্ব ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করে। ফলে লক্ষ্য করা যায় যে, তেভাগা আন্দোলনের সবচেয়ে সক্রিয় কেন্দ্রসমূহে পুরুষের তুলনায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি কখনোই এককভাবে নারী-পুরুষের পার্থক্যকে গুরুত্ব দেয়নি, বরং শুধু নারীবাদী সংগঠন হিসেবে এর কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ ছিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সমিতি তাদের কাজের ধারাবাহিকতায় দুটি মূল্যবান সংগঠন রেখে যায়। পশ্চিমবাংলার সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি সংগঠন গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি (সিপিআই মার্কসিস্ট দলের অধিভুক্ত) এবং মহিলা সমিতি (সিপিআই দলের অধিভুক্ত) মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিরই উত্তরসূরি। [তৃপ্তি চৌধুরী]
গ্রন্থপঞ্জি Renu Chakraborty, Communists in Indian Women’s movement; মণিকুন্তলা সেন, সেদিনের কথা; A Cooper, Share Cropping and Share Croppers’ movement in Bengal, 1930-50, (1988); A Majumdar, Peasant protest in Indian politics:Tebhaga movement in Bengal, 1993.