মহাযান
মহাযান বৌদ্ধধর্মের দুটি মূল ধারার একটি, অন্যটি হীনযান। ‘মহা’ অর্থ মহৎ বা উৎকৃষ্ট এবং ‘যান’ অর্থ মার্গ, উপায় বা শকট। বুদ্ধ নির্দেশিত নির্বাণে উপনীত হতে যে মহৎ মার্গ বা উপায় অবলম্বন করা হয় তারই নাম মহাযান। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে বৌদ্ধ সংঘে সংঘাত শুরু হয়। তাঁরা থেরবাদ এবং মহাসাংঘিক এ দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে এ দুটি ধারা থেকে আবার মোট আঠারোটি ধারার উদ্ভব হয়, যার একটি মহাযান পন্থা। এটি মহাসাংঘিক ধারার অন্তর্ভুক্ত।
মহাযানীরা বোধিসত্ত্ব মতবাদে বিশ্বাসী। বোধিসত্ত্ব হচ্ছেন তিনি, যিনি বারবার জন্মগ্রহণ করেন এবং অপরের পাপ ও দুঃখভার গ্রহণ করে তাদের আর্তি দূর করেন। তিনি একা নির্বাণ বা মুক্তি লাভ না করে বরং জগতের সকলের মুক্তির জন্য কাজ করেন এবং প্রত্যেক জীবের মুক্তি অর্জনের পর তিনি পরিনির্বাপিত হন। মহাযানের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে এই বোধিসত্ত্বের আদর্শ অর্জন করা।
মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রধানত মাধ্যমিক শূন্যবাদ এবং যোগাচার বিজ্ঞানবাদ এ দুটি ভাগে বিভক্ত। মাধ্যমিক শূন্যবাদে বাহ্যিকভাবে যাকে জীবন বলা হয় তার কোনো পারমার্থিক অস্তিত্ব নেই; প্রত্যেক বস্ত্ত এক নিঃসার ভ্রান্তিমাত্র। দার্শনিক নাগার্জুন এ মতের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। আর যোগাচার বিজ্ঞানবাদে বলা হয়েছে যে, সকল বাহ্যবস্ত্তই ভ্রান্তিমাত্র, অসৎকল্পিত; একমাত্র বিজ্ঞানই সৎ। এছাড়া মহাযানের মধ্যে বহু তান্ত্রিক শাখা বিদ্যমান, যেমন মন্ত্রযান, তন্ত্রযান, কালচক্রযান, বজ্রযান ইত্যাদি। তত্ত্বগত দিক থেকে এগুলি মৌলিক কোনো মতবাদ নয়। এগুলি মূলত বৌদ্ধধর্ম এবং হিন্দুধর্মের সংমিশ্রণে উদ্ভূত ধর্মদর্শনভিত্তিক কতগুলি গৌণ মতবাদ।
মহাযানীদের মতে বুদ্ধ হচ্ছেন ঈশ্বর এবং সিদ্ধার্থ গৌতম তাঁর প্রতিভূ। তাঁদের মতে গৌতম বুদ্ধের আগে ২৬জন বুদ্ধ অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সিদ্ধার্থ ২৭তম বুদ্ধ এবং ২৮তম বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটবে। ধর্মরূপে তিনি বিশ্বের নিয়ন্তা এবং জীবের মুক্তির জন্য তিনি বারবার পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। নাগার্জুন ব্যতীত এ মতবাদের আরো কয়েকজন বিখ্যাত দার্শনিক হলেন চন্দ্রকীর্তি, অসঙ্গ, বসুবন্ধু, দিঙ্নাগ, ধর্মকীর্তি, অশ্বঘোষ, অতীশ দীপঙ্কর প্রমুখ। জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, মঙ্গোলিয়া, চীন, তিববত, ভিয়েতনাম, নেপাল, ভুটান প্রভৃতি দেশের মানুষ মহাযান পন্থার অনুসারী। [রেবতপ্রিয় বড়ুয়া]