থেরবাদ

থেরবাদ আদি ও মৌলিক বৌদ্ধ ধর্মদর্শন। পালি ‘থের’ শব্দ থেকে এর এরূপ নামকরণ হয়েছে। ‘থের’ শব্দের অর্থ স্থবির, স্থিত, স্থিতধী, স্থিতিশীল ইত্যাদি। অর্থাৎ যিনি সংসার ত্যাগপূর্বক ভিক্ষুত্বে উপনীত হয়ে কমপক্ষে দশ বছর নিরন্তর ব্রহ্মচর্য পালনে স্থিতিশীল থাকেন তাঁকেই বলা হয় ‘স্থবির’ বা ‘থের’। কথিত হয় যে, গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে অনুষ্ঠিত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রথম সঙ্গীতিতে (সম্মেলনে) এ রীতির প্রচলন হয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এখনও এ ধারা বর্তমান। ভিক্ষুসংঘের এ থের অভিধা থেকেই ‘থেরবাদ’ শব্দের অভ্যুদয়।

খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে বৌদ্ধধর্মের গোড়া পত্তন হয়। সে সময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান নির্দেশক ছিলেন স্বয়ং  গৌতম বুদ্ধ। পরবর্তীতে বুদ্ধপ্রদত্ত বাণী ও নির্দেশনার সংকলনে তৈরি হয় বৌদ্ধধর্মগ্রন্থ  ত্রিপিটক। ত্রিপিটক পালি ভাষায় রচিত। এতে বৌদ্ধ ধর্মদর্শন ছাড়াও বৌদ্ধধর্মের প্রধান ধারক ও বাহক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জীবনাচারের প্রতিটি বিষয়ের নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত আছে। পালি ত্রিপিটকে বর্ণিত আদি ও মৌলিক বৌদ্ধ ধর্মাচার ও দর্শনকেই বলা হয় থেরবাদ।

বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিকাশের ধারাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের পূর্ব পর্যন্ত সাড়ে পাচঁশ বছর প্রথম অধ্যায়; খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত দ্বিতীয় অধ্যায় এবং অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত তৃতীয় অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ের  বৌদ্ধধর্ম ছিল পূর্ণাঙ্গ থেরবাদ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে  মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের উদ্ভব হয়। এ সময় সংস্কৃতসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত পালি ত্রিপিটকের খন্ডিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এতে মূল ত্রিপিটকে বর্ণিত বিনয়ের চিরাচরিত কঠোর নিয়মাবলি বহুলাংশে শিথিল করা হয়। এ শিথিলকৃত ধারার বিনয়-অনুসারিগণ বা মহাযানপন্থিগণ থেরবাদকে রক্ষণশীল বৌদ্ধধর্ম, স্থবিরবাদ নামে আখ্যায়িত করেন। দ্বিবিধ ধারার এ বৌদ্ধ মতাদর্শে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম, চতুরার্য সত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ এবং শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার অনুশীলনে পরম শান্তি ‘নির্বাণ’ লাভের সাধনা থেরবাদ ও মহাযান উভয় মতবাদেই অনুসৃত হয়। শুধু আচার-অনুষ্ঠানের দিক থেকে এ দুই মতবাদে কিছুটা বৈসাদৃশ্য রয়েছে।

থেরবাদ বৌদ্ধধর্মানুসারিগণ বুদ্ধের প্রদর্শিত নীতি-আদর্শ অনুসারে নিজের অন্তঃকরণ হতে অবিদ্যা, তৃষ্ণা ও মোহ ধ্বংস করে শমথ ও বিদর্শন ভাবনায় (ধ্যান) পূর্ণতা অর্জনপূর্বক নির্বাণ লাভ এবং নির্বাণোত্তর বুদ্ধস্থানে উন্নীত হওয়ার সাধনা করে। অপরদিকে মহাযানপন্থিগণ বুদ্ধের  বোধিসত্ত্ব জীবনের আদর্শকেই বিশেষভাবে অনুশীলন করে। তারা তিন রকমের পারমিসমূহের পূর্ণতাপূর্বক সর্ব জীবের দুঃখ নিরাকরণের লক্ষ্যে নিজের সর্বস্ব ত্যাগ, এমনকি নিজের জীবন ও কুশলকর্মার্জিত পুণ্যফলও পরহিতে বিতরণের প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে নিরবচ্ছিন্ন কর্মসাধনার দ্বারা নির্বাণ লাভ এবং তদনন্তর সম্যক সম্বুদ্ধত্বে উপনীত হওয়ার সাধনা করে। মহাযান সংস্কৃতিতে আনুষ্ঠানিকতা কম, কিন্তু থেরবাদে বহুমাত্রিক আনুষ্ঠানিকতা বিদ্যমান।

সপ্তম-অষ্টম শতকে বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে মহাযানের প্রচলন ছিল বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের বাঙালি ও উপজাতীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিশুদ্ধ থেরবাদ বৌদ্ধধর্মেরই অনুশীলন করেন। শুধু এ একটি মাত্র মতাদর্শই বাংলাদেশের সর্ব অঞ্চলের বৌদ্ধদের মধ্যে বিরাজিত। তাই বাংলাদেশের বৌদ্ধদের বলা হয় থেরবাদী বৌদ্ধ। [সুমন কান্তি বড়ুয়া]