বিজয়সেন

বিজয়সেন (আনু. ১০৯৭-১১৬০ খ্রি.) প্রাচীন বাংলায় সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা। শতাধিক বছর বাংলা শাসনকারী সেন বংশীয় বিজয়সেনের পূর্বপুরুষগণ কর্ণাটদেশ থেকে বাংলায় আসেন। তাঁর সময়ের দলিলপত্র থেকে এটি ধারণা করা  হয় যে, তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পালদের অধীনে রাঢ় এলাকায় একজন অধঃস্তন শাসক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। রামপালকে বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে যে ১৪ জন সামন্তরাজা সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে নিদ্রাবলীর বিজয়রাজ ছিলেন একজন। সম্ভবত বিজয়রাজ ও বিজয়সেন অভিন্ন ব্যক্তি। হেমন্তসেনের পুত্র বিজয়সেনই সেন বংশ এর স্বাধীন শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন।

বিজয়সেন পাল রাজাদের দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। রামপালকে সাহায্য করার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি রাঢ়ে স্বাধীন ক্ষমতা অর্জন করেন। পরে তিনি পালদেরকে পরাজিত করে গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। তাঁর রানী বিলাসদেবী ছিলেন শূরবংশের রাজকন্যা। রামচরিতম্ গ্রন্থে সন্ধ্যাকর নন্দী এগারো শতকের প্রথমার্ধে দক্ষিণ রাঢ়ে শূরবংশের অস্তিত্ব ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। একই উৎসে রামপালকে সাহায্যকারী সামন্ত রাজাদের তালিকায় অপরমন্দরের (হুগলি জেলার মান্দারনের সঙ্গে অভিন্ন বলে শনাক্তীকৃত) রাজা লক্ষ্মীশূর-এর নামেরও উল্লেখ রয়েছে। শূরবংশের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক বিজয়সেনকে রাঢ়ে তাঁর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। উড়িষ্যার রাজা অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গের সঙ্গে তাঁর মৈত্রী স্থাপনের কথাও বলা হয়ে থাকে। এই মৈত্রী নিশ্চিতভাবেই তাঁর রাজনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল। আনন্দভট্টের বল্লালচরিত গ্রন্থে তাকে ‘চোড়গঙ্গ সখ’ (চোড়গঙ্গের বন্ধু) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, রামপালের মৃত্যুর পরপরই বিজয়সেন বাংলায় স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। দেওপাড়া প্রশস্তিতে উল্লেখ রয়েছে যে, বিজয়সেন নান্য, বীর, রাঘব এবং বর্ধনকে পরাজিত করেন। তিনি কামরূপ ও কলিঙ্গ রাজগণকে পরাভূত করেন। গৌড়ের রাজাকে তাঁর রাজ্য থেকে দ্রুত পলায়নেও তিনি বাধ্য করেন। বিজয়সেনের প্রতিপক্ষদেরকে শনাক্ত করা খুব বেশি কঠিন নয়। অপর একজন কর্ণাট প্রধান মিথিলার রাজা নান্যদেব (আনু. ১০৯৭-১১৪৭ খ্রি.)-এর সঙ্গে নান্যকে অভিন্ন বলে শনাক্ত করা হয়েছে। বীর ছিলেন সম্ভবত রামপালের ‘সামন্তচক্র’-এর সদস্য কোটাটবীর বীরগুণ। বর্ধনকে অভিন্ন হিসেবে চিন্তা করা হয় কৌশাম্বীর রাজা দ্বোরপবর্ধন অথবা গোবর্ধন (যাঁর বিরুদ্ধে মদনপাল বিজয় অর্জন করেছিলেন)-এর সঙ্গে। সম্ভবত বীর ও বর্ধন এ দুজন সামন্তরাজকে নিজের অধীনে নিয়ে আসার জন্য বিজয়সেন তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। কেননা এ দুজনও ক্ষমতার জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। রাঘব ও কলিঙ্গরাজ ছিলেন সম্ভবত অভিন্ন ব্যক্তি। রাঘব ছিলেন উড়িষ্যারাজ চোড়গঙ্গের পুত্র। তিনি সম্ভবত ১১৫৭ থেকে ১১৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উড়িষ্যায় রাজত্ব করেন। সুতরাং বিজয়সেনের রাজত্বের শেষভাগে রাঘবের সাথে তাঁর সংঘর্ষ হতে পারে। রাঘবের পিতা অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গের সঙ্গে বিজয়সেনের বন্ধুত্ব থাকলেও রাঘবের সাথে সংঘর্ষে উপনীত হওয়া খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। রাঘবের আগ্রাসী পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেওয়া ছিল রাঘবের বিরুদ্ধে বিজয়সেনের সংঘর্ষের কারণ। দেওপাড়া প্রশস্তিতে উল্লেখ থেকে বিজয়সেন এবং কামরূপ রাজের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে জানা গেলেও বিজয়সেন যে প্রদেশটি দখল করে নিয়েছিলেন, একথা নিশ্চিতভাবে মনে করার কোন কারণ নেই। যদিও তা একেবারে অসম্ভব ছিল না। বিজয়সেন কর্তৃক পরাজিত কামরূপরাজ ছিলেন খুব সম্ভবত কুমারপালের মন্ত্রী বৈদ্যদেব, যিনি অথবা যাঁর উত্তরসূরি পরবর্তীকালে কামরূপে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এটিও অসম্ভব নয় যে, বৈদ্যদেব অথবা তাঁর উত্তরসূরি নব প্রতিষ্ঠিত সেন সাম্রাজ্যে অভিযান পরিচালনা করেন এবং বিজয়সেন কর্তৃক বিতাড়িত হন।

যে গৌড়রাজকে বিজয়সেন দ্রুত পলায়নে বাধ্য করেছিলেন তিনি যে শেষ পালরাজা মদনপাল সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সে সময় মদনপালের কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ ছিল উত্তর বাংলায়। পালদের লিপিতাত্ত্বিক উৎস থেকে একথা জানা যায় যে, উত্তর বাংলার ওপর মদনপালের কর্তৃত্ব বজায় ছিল তাঁর রাজত্বের ৮ম বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ১১৫২-৫৩ খ্রিস্টাব্দের পরই পালদের পতন ঘটে। খুব সম্ভবত ১১৫২-৫৩ খ্রিস্টাব্দের কিছু পরে বিজয়সেন উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা থেকে পালদেরকে বিতাড়িত করে সেখানে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। দেওপাড়া প্রশস্তি সূত্রে জানা যায় যে, বিজয়সেন রাজশাহী শহরের ১১.২৬ কিমি. পশ্চিমে তাঁর শিলালিপি প্রাপ্তিস্থানে প্রদ্যুম্নেশ্বরের এক মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এখানে স্মর্তব্য যে, মদনপালের অষ্টম রাজ্যাঙ্কের পর কোন পাললিপি উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলায় পাওয়া যায় নি। দেওপাড়া প্রশস্তিতে আরও উল্লেখ রয়েছে যে, বিজয়সেন গঙ্গার স্রোত ধরে কোন এক পাশ্চাত্য শক্তির বিরুদ্ধে বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন। খুব সম্ভবত বিহার পর্যন্ত রাজ্য বিস্তারকারী গাহাড়বালদের বিরুদ্ধেই তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন। অবশ্য উল্লিখিত লিপি উৎস থেকে এই নৌ অভিযানে বিজয়সেনের সাফল্য সম্বন্ধে কোন স্বচ্ছ ধারণা করা যায় না।

বিজয়সেন  বঙ্গ (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা)-এর উপরও তাঁর আধিপত্য সম্প্রসারণ করেন বলে বলা হয়ে থাকে। এগারো শতকের শেষ পাদ হতে বারো শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা শাসনকারী বর্মন রাজবংশের রাজধানী বিক্রমপুর থেকে বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসন প্রকাশিত হয়। সুতরাং মনে করা যেতে পারে যে, বারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্মনদেরকে হটিয়ে বিজয়সেন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় সেন প্রভুত্ব বিস্তার করেন। এভাবে বারো শতকের মাঝামাঝি সময়েই বিজয়সেন বর্মন শাসনের উচ্ছেদ ও পালদেরকে বিতাড়িত করে সমগ্র বাংলার ওপর সেনবংশের শাসন প্রতিষ্ঠায় সফল হন। অন্যান্য সকল শত্রুকে পরাজিত করার মাধ্যমে তিনি বাংলায় তাঁর সাম্রাজ্য সংহত করে দীর্ঘ ৬২ বছর রাজত্ব করেন। তিনি ছিলেন একজন শৈব। বেদ বিশেষজ্ঞ ব্রাহ্মণ ও দরিদ্রদের প্রতি তিনি উদার ছিলেন। তিনি ‘পরমমাহেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি ‘অরিরাজ-বৃষভশঙ্কর’ গৌরবসূচক উপাধিও গ্রহণ করেন। বিজয়সেনের কৃতিত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে কবি শ্রীহর্ষ তাঁর বিজয়প্রশস্তি এবং গৌড়োর্বিশকুলপ্রশস্তি (গৌড়ের রাজপরিবারের প্রশস্তি) রচনা করেছিলেন, এরূপ মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।  [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]