বর্মণ বংশ

বর্মণ বংশ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা শাসনকারী রাজবংশ। এগারো শতকের শেষ এবং বারো শতকের প্রথমার্ধে এ বংশ বাংলায় শাসন করত। তিনটি তামত্তশাসন এবং ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর শিলালিপি থেকে বর্মণদের ইতিহাস জানা যায়। সিংহপুরে রাজত্বকারী যাদব বংশের সাথে বর্মণরাজগণ তাদের সম্পর্ক দাবি করেন। বর্তমান চিকাকোল ও নরাসন্নপেতার মধ্যস্থলে কলিঙ্গের (উত্তর উড়িষ্যা) সিঙ্গপুরমকে প্রাচীন সিংহপুর বলে মনে করা হয়। মোটামুটিভাবে পাঁচ শতকের শুরু থেকে বারো শতকের শেষ পর্যন্ত কলিঙ্গের সিংহপুর রাজ্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। খুব সম্ভবত কলচুরী রাজা কর্ণের বঙ্গ অভিযানের সময় তাঁর সঙ্গেই বর্মণদের বাংলায় আগমন ঘটে। রাজেন্দ্র চোলের পথ অনুসরণ করেই হয়ত কর্ণ উড়িষঞ্ঝা হতে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা আক্রমণ করেছিলেন। ধারণা করা হয় যে, কর্ণের সহগামী হিসেবে বাংলায় এসে বর্মণগণ এখানে থেকে যান এবং পরবর্তীতে নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

ভোজবর্মণের বেলাব তাম্রশাসনে প্রদত্ত জাতবর্মণের সামরিক অভিযানের বর্ণনা হতে এ বিষয়ে মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, জাতবর্মণই এ বংশের প্রথম রাজা যিনি সার্বভৌম শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জাতবর্মণের পিতা বজ্রবর্মণ সাহসী যোদ্ধা, একজন কবি এবং পন্ডিত হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন। কর্ণের কন্যা বীরশ্রীর সঙ্গে জাতবর্মণের বিবাহ এবং পালদের কাছ থেকে উত্তর বাংলা দখলকারী দিব্যের উল্লেখ থেকে জাতবর্মণের ক্ষমতায় আরোহণের সময় নির্ধারণ করা হয় ১০৫০ এবং ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। কর্ণের কন্যার সঙ্গে জাতবর্মণের বৈবাহিক সম্পর্কের বিষয়টি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত বর্মণ পরিবারের রাজনৈতিক ভাগ্য উত্থানের ক্ষেত্রে এ বিবাহ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কর্ণের বঙ্গ আক্রমণ ছিল চন্দ্র সাম্রাজ্যের উপর শেষ আঘাত এবং গৈাবিক্টদচক্টদন্ড অথবা তাঁর উত্তরসূরির পরপরই বর্মণগণ ক্ষমতা দখল করে। স্বাধীন শাসক হিসেবে জাতবর্মণের উত্থান ঘটেছিল উত্তর বাংলায় দিব্যের ক্ষমতা অধিকারের অল্প কিছু পূর্বে অথবা সমসাময়িক কালে। এই দিব্যের বিরুদ্ধে জাতবর্মণ যুদ্ধ করেছিলেন বলে জানা যায়।

বেলাব তাম্রশাসনে উল্লিখিত অব্দ এর ওপর জাতবর্মণের আঘাতের ঘটনা থেকে নিশ্চিতই ধারণা করা যায় যে, তিনি পাল রাজা রামপালএর সঙ্গে সংগ্রামে জড়িত হয়েছিলেন। রামপালের শাসনের শুরুতে পাল সাম্রাজ্যের অনিশ্চিত অবস্থা সম্ভবত পালদের সঙ্গে তাঁকে অস্ত্রধারণে প্রলুব্ধ করে। তাঁর অপর দুজন প্রতিপক্ষ গোবর্ধন এবং কামরূপরাজকে শনাক্ত করা সম্ভব হয় নি। জাতবর্মার উত্তরসূরি কে ছিলেন তা নির্ধারণ করাও কঠিন। তবে কিছু তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ধারণা করা হয় যে, হরিবর্মণ ছিলেন জাতবর্মণের উত্তরসূরি। হরিবর্মণের পর তাঁর ভাই সামলবর্মণ সিংহাসনে আরোহণ করেন। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর প্রশস্তিলিপিতে হরিবর্মণদেবের নাম উল্লিখিত আছে। হরিবর্মণদেবের অধীনে ভবদেব যুদ্ধ এবং শান্তি বিষয়ক মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্মণ বংশের হরিবর্মণ এবং ভুবনেশ্বর প্রশস্তিলিপিতে উল্লিখিত হরিবর্মণদেব সম্ভবত অভিন্ন। হরিবর্মণের রাজত্বের ১৯তম এবং ৩৯তম রাজ্যাংকে অনুলিপিকৃত দুটি বৌদ্ধ পান্ডুলিপিতে এ রাজার নাম উল্লিখিত হয়েছে এবং দ্বিতীয় পান্ডুলিপির ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে, হরিবর্মণ দীর্ঘ ৪৬ বছর রাজত্ব করেছেন। ভুবনেশ্বর শিলালিপিতে প্রদত্ত তথ্য থেকেও এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হরিবর্মণ দীর্ঘদিন রাজত্ব করেন।

উত্তর বাংলা পুনরুদ্ধারে রামপাল এর সাফল্য প্রত্যক্ষ করে হরিবর্মণ রামপালকে তুষ্ট করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল নিজ রাজ্যকে পাল আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখা। উড়িষ্যার দিকে হরিবর্মণের শাসন সম্প্রসারিত হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। ভুবনেশ্বর শিলালিপি এবং বজ্রযোগিনী তাম্রশাসনে হরিবর্মণের একটি পুত্র সন্তানের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। জাতবর্মণের অপর পুত্র সামলবর্মণ ছিলেন পরবর্তী রাজা। বাংলার বৈদিক ব্রাহ্মণগণের কুলজি শাস্ত্রে তাঁর নাম বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে এবং বলা হয়ে থাকে যে, সামলবর্মণের রাজত্বকালে বৈদিক ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষগণ মধ্যদেশ থেকে বাংলায় আগমন করেন। বর্মণদের সঙ্গে শ্রীলংকার রাজা প্রথম বিজয়বাহুর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। খুব সম্ভবত সামলবর্মণের কন্যা ত্রৈলোক্যসুন্দরীর সঙ্গে শ্রীলংকার এই রাজার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল।

সামলবর্মণের পুত্র ভোজবর্মণ ছিলেন সম্ভবত বর্মণ বংশের শেষ জ্ঞাত রাজা। বিক্রমপুর ‘জয়স্কন্ধবার’ থেকে ভোজবর্মণের রাজত্বের ৫ম বছরে বেলাব তাম্রশাসন প্রকাশিত হয়। বর্মণ রাজারা ছিলেন বৈষ্ণব, কিন্তু তাঁরা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। প্রজ্ঞাপারমিতা পাঠের জন্য পুরস্কারস্বরূপ ভীমদেব নামে একজন ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধের প্রতি অথবা প্রজ্ঞাপারমিতা মন্দিরের উদ্দেশ্যে ভূমি দানের জন্য সামলবর্মণের বজ্রযোগিনী তাম্রশাসন উৎকীর্ণ করা হয়।

দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার চারজন বর্মণ রাজা সম্পর্কে জানা যায়, যাঁরা মোটামুটিভাবে ৬০/৭০ বছর রাজত্ব করেন। ভোজবর্মণের শাসনের সময় অথবা তাঁর রাজত্বের পরপরই সেনগণ তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করেন।  [আবদুল মমিন চৌধুরী]