গোবিন্দচন্দ্র
গোবিন্দচন্দ্র চন্দ্রবংশের সর্বশেষ রাজা। সম্ভবত ১০২০ থেকে ১০৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২৫ বছর তিনি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন লড়হচন্দ্র এবং সৌভাগ্যদেবীর পুত্র। তাঁর পরপরই দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্র শাসনের অবসান হয়।
দক্ষিণ ভারতের চোল রাজবংশের তিরুমুলাই লিপিতে ‘বঙ্গালদেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্র’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক ‘শব্দপ্রদীপ’ গ্রন্থেও তাঁর উল্লেখ রয়েছে। রাজত্বের ১২তম এবং ২৩তম বছরে উৎকীর্ণ দুটি মূর্তিলিপি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার রাজা হিসেবে তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। ময়নামতী তাম্রশাসনের ভিত্তিতে চন্দ্র বংশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। তাঁর তাম্রশাসনে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ও গুণাবলির কথা উল্লিখিত হয়েছে এবং আশা পোষণ করা হয়েছে যে, ব্রহ্মা তাঁর মঙ্গল বিধান করবেন, বিষ্ণু তাঁর দেহ বাঁচিয়ে রাখবেন এবং ইন্দ্র তাঁর সকল শত্রু ধ্বংস করবেন। সিংহাসনে আরোহণের কিছুদিনের মধ্যেই গোবিন্দ চন্দ্রকে চোল বংশীয় রাজেন্দ্র চোল এবং কলচুরি রাজ কর্ণের আক্রমণের ধকল সহ্য করতে হয়। গোবিন্দচন্দ্র এঁদের কাছে পরাজিত হন। এদুটি বৈদেশিক আক্রমণে গোবিন্দচন্দ্রের শক্তি অনেকাংশে হ্রাস পায় এবং শেষ পর্যন্ত চন্দ্র বংশের পতন ঘটে।
পিতার মতোই গোবিন্দচন্দ্র ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতি অনুসরণ করেন। যদিও তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ বৌদ্ধ হিসেবে নিজেকে উল্লেখ করতেন, তথাপি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও অন্যান্য উপাসনা রীতির প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল।
গবেষকগণ বাংলাদেশ ও ভারতের অন্যান্য অংশে ‘গোপী চন্দ্র’ বা ‘গোবীচন্দ্র’কে চন্দ্র বংশীয় রাজা গোবিন্দচন্দ্রের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন। কিন্তু ‘গোবিন্দচন্দ্রের গান’, ‘মানিকচন্দ্রের গান’, ‘ময়নামতীর গান’ ইত্যাদি লোকগাঁথার সঠিক সময় নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার। সাধারণভাবে লোকগাঁথার সকল সংস্করণ গোপীচন্দ্র বা গোবীচন্দ্র নামে বাংলার একজন রাজার কাহিনির সঙ্গে সম্পর্কিত যিনি সিংহাসন ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। লোকগাঁথার বিভিন্ন সংস্করণে গোবীচন্দ্রের যে বংশতালিকা পাওয়া যায় তা চন্দ্র বংশীয় রাজার বংশতালিকা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এগুলির অধিকাংশে গোবিন্দচন্দ্রের পিতা হিসেবে মানিকচন্দ্র এবং মাতা হিসেবে ময়নামতীর নাম পাওয়া যায়। মেহেরকুলের শাসক তিলকচন্দ্রের কন্যা ছিলেন ময়নামতী। রংপুর জেলার কোনো একটি স্থানে মেহেরকুল অবস্থিত ছিল বলে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন। আবার কেউ কেউ ময়নামতীর (চাঁদপুর জেলাধীন) অদূরে মেহেরকুলের অস্তিত্ব চিহ্নিত করেন। কিন্তু কুমিল্লায় ময়নামতী নামের অস্তিত্ব থেকে ধারণা করা হয় যে, তিলকচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্য সম্ভবত এ জেলাতেই অবস্থিত ছিল। যাহোক, কেবল নামের মিল ব্যতীত এমন আর কিছু নেই যা দিয়ে দুজন গোবিন্দচন্দ্রকে শনাক্ত করা যায়। [আকসাদুল আলম]
গ্রন্থপঞ্জি AM Chowdhury, Dynastic History of Bengal, Dhaka , 1967; RC Majumdar, History of Ancient Bengal, Calcutta , 1971.