বাগদি

বাগদি দ্রাবিড় বংশোদ্ভূত নিম্নশ্রেণির কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়, এদের মধ্যে আদিবাসীসুলভ নানা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন উপশ্রেণীর বাগদি বসবাস  করে।

বাগদি সমাজে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর বাইরে বিয়ে হবার রীতি নেই। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায়, বিশেষ করে তাদের সম্পত্তি যেন তাদের সম্প্রদায় বহির্ভূত কেউ ভোগ করতে না পারে, তাই শ্রেণির অভ্যন্তরেই তাদের বিবাহ কড়াকড়িভাবে সীমিত রাখা হতো। আজকাল অবশ্য বিবাহ প্রথায় অনেকটা নমনীয়তা এসেছে। বর্তমান বাগদিদের মধ্যে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কম। আর্থিক অবস্থা সাপেক্ষে কোন পুরুষের বহু বিবাহে বাধা নেই। একজন বাগদি একই সাথে দুই বোনকে বিয়ে করতে পারে।

বাগদিদের বহুবিধ আচার-অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে নেওয়া, তবে বিভিন্ন আদিসমাজে প্রচলিত প্রকৃতি পূজা এবং মনোজ্ঞ কিছু প্রথাও তারা সংরক্ষণ করে। আনুষ্ঠানিক বিয়ের আগে একটি মহুয়া গাছের সঙ্গে বরের কৃত্রিম বিয়ে হয়। সাঙ্গাবিবাহ আচারের মাধ্যমে একজন বিধবার পুনর্বিবাহের অনুমতি আছে। একজন ব্রাহ্মণের পৌরোহিত্যে তা অনুষ্ঠিত হয়, তবে তাতে কোন মন্ত্রপাঠ হয় না। বাগদি শ্রেণিভুক্ত জ্যেষ্ঠদের মতে, যেসব স্ত্রী বাঁজা, অসতী বা অবাধ্য, তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ অনুমোদিত ছিল। বিবাহ বিচ্ছেদের পর পরিত্যক্তা স্ত্রীর ছয়মাস পর্যন্ত প্রাক্তন স্বামী থেকে ভরণ-পোষণ পাবার অধিকার ছিল। বাগদিদের সব উপশ্রেণীই সামাজিকভাবে উচ্চতর শ্রেণির কাউকে তাদের গন্ডিতে বরণ করে নিতে পারত। সর্পদেবী মনসা তাদের নিকট আধ্যাত্মিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাগদি সমাজে কিছু জ্যেষ্ঠ ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে অনুসৃত বিধিবিধান ছিল বেশ সহজ।

বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন উপশ্রেণিতে বাগদিদের পেশা বিভিন্ন ধরনের: কেউ মৎস্যজীবী, কেউ পাল্কিবাহক, কেউ চুনাপাথর উৎপাদক, কেউ চটের থলি প্রস্ত্ততকারক এবং কেউ তাঁতি। বাগদিদের অধিকাংশই সচরাচর কোন রায়তের অধীনে চাষবাসে নিয়োজিত থাকত, তবে তুলনামূলকভাবে খুব কম বাগদিই দখলিস্বত্বমূলক ভাগচাষি হতে পারত। পুরানো কাল থেকেই বাংলার এ অঞ্চলে বাগদিদের এক বড় অংশ দিনমজুর হিসেবে কাজ করত। তাদের পাওনা পরিশোধ করা হতো নগদ অর্থে বা দ্রব্যের মাধ্যমে। অভিবাসী চাষিদের বেলায় বিশেষত যারা ভাগ-জোত প্রথায় অন্যদের জমি চাষ করে দিত, তাদের প্রাপ্য দেওয়া হতো উৎপাদিত ফসলের অর্ধাংশ বা আরও কম।

বাগদিদের সামাজিক অবস্থান ধর্মীয়ভাবে নির্ধারিত হতো হিন্দুদের সর্বনিম্নস্তরে। তাদের মধ্যে অনেকেই গো-মাংস বা শূকর মাংস ভক্ষণ করে, যদিও প্রচলিত হিন্দু প্রথানুযায়ী কিছুসংখ্যক বাগদি যেকোন প্রকার মাংস ভক্ষণ হতে বিরত থাকে। বর্তমানে সমাজের এক স্তর হতে আরেক স্তরে যেভাবে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক সুযোগ সুবিধা, প্রথা ও মূল্যবোধের রূপান্তর ঘটছে, তাতে বাগদিরা সমাজের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। ফলে তাদের জীবন ধারণের মান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক অবস্থানেরও পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন আধুনিক প্রতিষ্ঠানে তাদের আত্তীকরণ ঘটছে।  [এস.এম মাহফুজুর রহমান]