বখশী হামিদ মসজিদ
বখশী হামিদ মসজিদ চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার অধীনে হিলসা গ্রামে একটি বড় পুকুরের পশ্চিমদিকে অবস্থিত। পুকুরটি এখনও বিদ্যমান এবং এর পশ্চিমপাড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি পাকাঘাট রয়েছে, যা সম্ভবত ওজু করার সুবিধার জন্য মসজিদের পাশে নির্মাণ করা হয়েছিল।
ইটের তৈরি মসজিদটি একটি বহির্দেয়াল দ্বারা ঘেরা। এর পূর্বদিকের ঠিক মাঝখানে মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের অক্ষে খিলান দ্বারা নির্মিত একটি তোরণ রয়েছে। মসজিদের বাইরের কোণগুলিতে অষ্টভুজাকৃতির পার্শ্ববুরুজ রয়েছে। বাইরে থেকে মসজিদের পরিমাপ ১১.৭৩ মি × ৭.৬২ মি এবং ভেতরদিকে ৮.৯৯ মি × ৪.৮৮ মি। লক্ষণীয় যে, এখানে পার্শ্ববুরুজগুলি মোটা দেয়ালের মধ্যে সন্নিবিষ্ট। এ ধরনের নির্মাণ কৌশল ঢাকার শাএয়’বা খান মসজিদ এ (আনু. ১৬৬৪ খ্রি) এবং নারায়ণগঞ্জের বিবি মরিয়ম মসজিদ এ (আনু. ১৬৮০ খ্রি) লক্ষ্য করা যায়। মসজিদটির খিলান দ্বারা নির্মিত পাঁচটি প্রবেশপথের তিনটি পূর্বদিকে এবং উত্তর ও দক্ষিণের প্রতিদিকে একটি করে। পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথ একেকটি অর্ধগম্বুজ ভল্টের নিচে নির্মিত এবং বাইরের দিকে এগুলি খাঁজকাটা নকশা ধারণ করে আছে।
অভ্যন্তরভাগে পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব কুলুঙ্গি তৈরি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অর্ধ অষ্টকোণাকার, কিন্তু পাশেরগুলি আয়তাকার। প্রধান মিহরাব ও কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের রয়েছে যথারীতি আয়তাকার অভিক্ষেপ, যার দুপাশে রয়েছে বৃত্তাকার ক্ষুদ্র বুরুজ। এ বুরুজগুলি প্যারাপেটের উপর পর্যন্ত উঠে গেছে এবং শীর্ষভাগে রয়েছে কলসচূড়াসহ স্থূল ধরনের ক্ষুদ্র গম্বুজ।
এ মসজিদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও ছাদ নির্মাণ কৌশল বাগ-ই-হামজাহ মসজিদ (১৬৮২ খ্রি) এবং মাহমুদ খান মসজিদ এর (আনু. ১৬৮৮ খ্রি) সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্যপূর্ণ। উভয় মসজিদই চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত। মসজিদের ভেতর থেকে দেখা যায় যে, একটি প্রধান গম্বুজের উভয় পাশে একটি করে অর্ধ-গম্বুজাকৃতির ভল্ট রয়েছে, কিন্তু বাইরের দিকে ছাদটি অষ্টকোণাকার পিপার উপর নির্মিত তিনটি অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ সহযোগে গঠিত। একই রকম দেখতে এ গম্বুজগুলির মধ্যে কেন্দ্রীয় গম্বুজটি অন্যগুলির তুলনায় বড়। দুপাশের গম্বুজ দুটি কৃত্রিম, যা অর্ধগম্বুজাকৃতি ভল্টের উপর স্থাপিত। সবগুলি গম্বুজের শীর্ষভাগ সুন্দর পদ্ম ও কলসচূড়া দ্বারা পরিশোভিত। কেন্দ্রীয় গম্বুজের ভেতরের দিকে রয়েছে একসারি পাতার অলংকরণ; গম্বুজের শীর্ষভাগ তিনটি প্রস্ফুটিত সংবদ্ধ রোজেট দ্বারা চিত্রিত।
বর্তমানে ইমারতটির ভেতর ও বাহির উভয় দিকে পলেস্তরায় আবৃত। পার্শ্ববুরুজগুলি এবং সীমা নির্ধারণী ক্ষুদ্র বুরুজগুলিতে রয়েছে চমৎকার কলসাকৃতির ভিত্তি এবং বুরুজগুলিকে আলঙ্কারিক বন্ধনী দ্বারা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্যারাপেট ও অষ্টকোণাকার পিপাগুলি বদ্ধ পদ্মপাঁপড়ি নকশা দ্বারা অলংকৃত। পূর্বদিকের খিলানপথগুলির প্রতিটি একটি করে আয়তাকার ফ্রেমে নিবদ্ধ। ফ্রেমগুলির উপরিভাগে এক সারি বদ্ধ পদ্মপাঁপড়ির অলংকরণ শোভা পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের ফ্রেমটি বৈচিত্র্যময় নকশাযুক্ত পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলংকৃত। নকশার মধ্যে রয়েছে প্রস্ফুটিত সংঘবদ্ধ রোজেট, জালি নকশা এবং বিভিন্ন ধরনের পরস্পর পরিবিদ্ধ নকশা। পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথের স্প্যান্ড্রেল (spandrel) স্টাকোর মাধ্যমে তৈরি ফুলেল-লতা দ্বারা অলংকৃত।
সবগুলি মিহরাবেই চতুষ্কেন্দ্রিক খিলান দেখা যায়, শুধু কেন্দ্রীয় মিহরাবের বাইরের দিকে বহুভাজ নকশাসমৃদ্ধ একটি অতিরিক্ত খিলান রয়েছে, যা অলংকৃত ইটের তৈরি নিমগ্ন স্তম্ভগুলি থেকে উৎসারিত। কেন্দ্রীয় মিহরাবটিকে একটি অভিক্ষিপ্ত আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে, যার উপরিভাগ পুনরায় একসারি বদ্ধ পদ্মপাঁপড়ি দ্বারা পরিশোভিত।
মুগল স্থাপত্য উপাদানসমূহের সাথে সুলতানি স্থাপত্য উপাদানের চমৎকার সংমিশ্রণে তৈরি এ মসজিদ স্থাপত্যের একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত। প্রথম উপাদানটি উপস্থাপিত হয়েছে পিপার উপর নির্মিত পদ্ম ও কলসচূড়াসহ গম্বুজ, সমান্তরাল প্যারাপেট, সীমানা নির্ধারণী ক্ষুদ্র বুরুজসহ অভিক্ষিপ্ত সম্মুখভাগ, অর্ধকোণাকার মিহরাব কুলুঙ্গি এবং স্টাকো অলংকরণের মাধ্যমে; পরেরটি উপস্থাপিত হয়েছে টেরাকোটা অলংকরণের মাধ্যমে।
মিহরাবের উপর স্থাপিত একটি আরবি শিলালিপিতে ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে সুলায়মান কররানী কর্তৃক একটি মসজিদ নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এর বিভিন্ন স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, বর্তমান মসজিদটি সম্পূর্ণরূপে একটি মুগল ইমারত। এটা অসম্ভব নয় যে, শিলালিপিটি অন্য কোন স্থান থেকে এনে এ মসজিদে লাগানো হয়েছে। আদি শিলালিপিটি পূর্বদিকের সম্মুখভাগে প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত ছিল, বর্তমানে হারিয়ে গেছে। সে থেকে এ স্থানটি খালি পড়ে আছে। স্থানীয়ভাবে প্রবাদ আছে যে, জনৈক বখশী হামিদ ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন এবং এখন পর্যন্ত মসজিদটি এ নামই ধারণ করে আছে। মনে হয় এ ধারণায় কিছুটা সত্য নিহিত আছে। [এম.এ বারি]