প্রবাদ
প্রবাদ লোকপরম্পরাগত বিশেষ উক্তি বা কথন। জীবন, জগৎ ও সমাজ সম্পর্কে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত এই প্রবাদ লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা। প্রবাদ অতীতের বিষয় হয়েও সমকালকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করে। আধুনিক যুগে প্রায় সব ধরনের রচনায় প্রবাদ ব্যবহূত হয়। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন, বক্তৃতা, এমনকি দৈনন্দিন কথাবার্তায়ও প্রবাদের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
প্রবাদ ক্ষুদ্রতম রচনা; একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য থেকে ছন্দোবদ্ধ দুই চরণ পর্যন্ত এর অবয়বগত ব্যাপ্তি। তবে ক্ষুদ্র হলেও তা পূর্ণাঙ্গ ভাবদ্যোতক ও অর্থবহ হয়ে থাকে। যেকোনো প্রবাদ মানুষের ব্যবহারিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধি থেকে জন্ম নেয়। ‘অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’, ‘জোর যার, মুলুক তার’ ইত্যাদি প্রবাদের গড়ন অাঁটসাট; বাড়তি একটি শব্দও নেই। স্বল্প কথায় এত বেশি অর্থবহন-ক্ষমতা প্রবাদ ছাড়া লোকসাহিত্যের অন্য কোনো শাখার নেই।
প্রবাদ সমাজমানসে জন্ম নিয়ে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপ বদলায় এবং এক সময় একটি স্থায়ী রূপ লাভ করে। কখনো কখনো একই প্রবাদ কিছুটা পরিবর্তনসহ অঞ্চলভেদে একাধিক রূপেও প্রচলিত থাকে। যেমন ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ অথবা ‘ধান ভানতে মহীপালের গীত’ প্রবাদটির মৌলিক কাঠামো বা অর্থের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ‘শিব’ কৃষিদেবতা, আর ‘মহীপাল’ পাল বংশের শক্তিশালী রাজা। প্রবাদটির জন্মেতিহাসের দিক থেকে শিব আগে; অতএব প্রথমটি মৌলিক প্রবাদ; পরবর্তীকালে শিবের স্থলে মহীপাল যুক্ত হয়েছে। তুচ্ছ কাজে গুরুতর বিষয়ের অবতারণা বোঝাতে এই প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়।
প্রবাদে যেমন দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে, তেমনি এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় একটি জাতি বা সমাজের জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, চৈতন্য, ঐতিহ্য, শিক্ষা এবং লোকমনের বদ্ধমূল ধারণা। প্রবাদ সম্পর্কে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মনীষীদের দেওয়া সংজ্ঞা থেকে এর যে বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটে ওঠে তা হলো: ক. প্রবাদে জাতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, পরিণত বুদ্ধি (elder wisdom) এবং লোকমনে প্রবাহিত সত্যকথন প্রকাশিত হয়; খ. প্রবাদের অবয়ব হলো একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য; গ. উপমা, বক্রোক্তি, বিরোধাভাস প্রভৃতি অলঙ্কারযোগে তা গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, একটি সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থপূর্ণ বাক্যই হলো প্রবাদ; কিন্তু অর্থপূর্ণ বাক্যাংশ প্রবাদ নয় তা ‘বাগ্ধারা’ (idioms) বা ‘প্রবাদকল্প বাগ্ভঙ্গি’ (proverbial phrases)।
যে পটভূমি বা বিশেষ অর্থে একটি প্রবাদ সৃষ্টি হয়, প্রয়োগকালে তার অর্থব্যাপ্তি ঘটতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে মূলের স্থান-কাল-পাত্র পরিবর্তিত হয়ে যায়। ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’ প্রবাদটির জন্মোৎস হয়তো কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতা, কিন্তু বর্তমানে এর প্রয়োগ-ব্যাপ্তি ঘটেছে; বাইরে সদ্ভাব রেখে ভেতরে অসৎ উদ্দেশ্য পোষণ করা এমন যেকোনো আচরণ বোঝাতে এখন প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়। ‘চোরের মার বড় গলা’, ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ ইত্যাদি প্রবাদ দ্বারা শুধু চোর ও চৌর্যবৃত্তির কথাই বোঝায় না, বরং নানা শ্রেণির অসৎ ব্যক্তি ও তাদের অসৎ কর্মকান্ডও বোঝায়। ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ একটি বাস্তব ঘটনা, কিন্তু কোনো সাধারণ ঘটনার মাধ্যমে সামাজিক বা রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি করা বোঝাতে এই প্রবাদ প্রযুক্ত হয়। ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’ প্রবাদটিও কোনো এক নটের অদক্ষতা থেকে উদ্ভূত, কিন্তু বর্তমানে কেউ কোনো বিষয়ে নিজের অক্ষমতাকে গোপন করার জন্য কোনো অসার যুক্তি উত্থাপন করলে এই প্রবাদের উল্লেখ করা হয়। এভাবে দেখা যায় কোনো প্রবাদ সৃষ্টি হওয়ার সময় তার যে অর্থ থাকে, কালক্রমে তার প্রসার ঘটে।
প্রবাদ সম্পর্কে জার্মানিতে বলা হয়: ‘As the country, so the proverb.’ যে দেশ যেমন, তার প্রবাদও তেমন। স্কটল্যান্ডে বলা হয়: ‘As the people, so the proverb.’ যেমন মানুষ, তেমন তার প্রবাদ। উভয়ের সমন্বয় করে বলা যায়, যে দেশের মানুষ যেমন, সে দেশের প্রবাদও তেমন। অর্থাৎ একটি দেশের প্রকৃতি, পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, জীবজন্তু, জাতীয় জীবনের নানা ধারা, তার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ, পরিবার, ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় নিয়ে প্রবাদ রচিত হয়। প্রবাদে একটি দেশ ও জাতির জীবনপ্রবাহের নানা চিত্র পাওয়া যায়। সেগুলি খন্ড হলেও খাঁটি চিত্র; কারণ প্রবাদ লোকমনের সত্যরূপ বহন করে।
প্রবাদ যেহেতু বুদ্ধিপ্রধান রচনা, সেহেতু অনুমান করা হয় যে, মানুষ প্রবাদের সৃষ্টি ও প্রয়োগকৌশল লোকসাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় অপেক্ষাকৃত পরে আয়ত্ত করেছে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে মিশরের প্যাপিরাসের গল্পে প্রবাদের প্রয়োগ আছে। ভারতীয় বেদ-উপনিষদেও প্রবাদ আছে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে কয়েকটি প্রবাদ আছে। ‘আপনা মাসে হরিণা বৈরি’ প্রবাদটি চর্যাপদকর্তা ভুসুকু ব্যবহার করেন; তাঁর আবির্ভাবকাল এগারো শতক। চৌদ্দ শতকে বড়ু চন্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এবং ষোল শতকে মুকুন্দরাম চন্ডীমঙ্গলে একই প্রবাদ ব্যবহার করেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি ও প্রসার ঘটলে প্রবাদের ব্যবহার আরও বিস্তৃত হয়।
প্রবাদের শ্রেণিকরণ একটি জটিল বিষয়। বেশির ভাগ প্রবাদ-সঙ্কলনে প্রবাদসমূহকে অক্ষরানুক্রমে বিন্যস্ত করা হয়। আর্চার টেলর ও বি.জে হুইটিং প্রবাদগুলিকে প্রধানত বিশেষ্য, বিশেষণ বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো শব্দ ধরে শেª্রণকরণ করেন। তাঁদের অনুসরণে ‘অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’, ‘দুই সতীনের ঘর, খোদায় রক্ষা কর’ প্রবাদ দুটিকে ‘শোক’ ও ‘সতীন’ শব্দের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এরকম বর্গীকরণ দ্বারা প্রবাদের কোষ বা সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশ করা সহজ, কিন্তু প্রবাদের চরিত্র-বিশ্লেষণ দুরূহ।
লোকসাহিত্যের অন্য শাখার মতো প্রবাদেও মানুষ, সমাজ ও পরিবেশের কথা অনিবার্যভাবে এসেছে। ‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’, ‘খাল কেটে কুমির আনা’, ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়’, ‘মরা হাতির দাম লাখ টাকা’, ‘হাতি খাদে পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে’, ‘হাতি-ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল’, ‘ঘুঘু দেখছ, ফাঁদ দেখনি’ ইত্যাদি প্রবাদে মানুষের স্বভাব, চরিত্র ও অবস্থার কথা বলা হয়েছে। ‘খাওন দেওয়ার মুরোদ নাই, কিল মারার গোঁসাই’, ‘টাকা থাকলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়’, ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ ইত্যাদি প্রবাদের ভিত্তি অর্থ। ধন-বৈষম্য ও শ্রেণি-শোষণের চিহ্ন আছে এসব প্রবাদে; অর্থ অপব্যয়ের দিকটিও ফুটে উঠেছে।
‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’, ‘আপ ভাল তো জগৎ ভাল’, ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ ইত্যাদি প্রবাদে আত্মমুখী চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। আবার ‘দশের লাঠি একের বোঝা’, ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’, ‘যেদিকে দশ সেদিকেই খোদা’ প্রবাদগুলিতে সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি ও ঐক্যবোধের পরিচয় আছে। ‘রাখে আল্লা মারে কে’, ‘কপালের লিখন না যায় খন্ডন’, ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়’ প্রবাদগুলিতে অদৃষ্টবাদের কথা আছে। ‘খাটে খাটায় দ্বিগুণ পায়, বসে খাটায় অর্ধেক পায়’, ‘বসে খেলে রাজার ভান্ডার ফুরায়’ ইত্যাদি প্রবাদে কর্মবাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ‘যে গরু দুধ দেয়, তার লাথিও ভাল’, ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল’ প্রবাদে বস্ত্তবাদী ও নৈরাশ্যবাদী দুটি বিপরীতধর্মী দর্শন প্রকাশ পেয়েছে।
নরনারীর স্বভাব-চরিত্র, পেশা ইত্যাদি বিষয়ক প্রবাদের সংখ্যা অজস্র। পরিবার ও সমাজসূত্রে সম্পর্কিত যত নর-নারী আছে, তাদের প্রায় সবার স্বভাব-চরিত্র ও আচরণ নিয়ে বহু প্রবাদ রচিত হয়েছে। সেসব প্রবাদে প্রধানত তাদের সমালোচনাই করা হয়েছে; গুণ অপেক্ষা দোষের দিকটিই বেশি ধরা পড়েছে। মা-বাবা, মাসি-পিসি, বধূ, শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ, জা, ভাসুর, দেবর, শ্যালক, নাতি-নাতনি, সতীন, সৎমা, সখী ইত্যাদি সম্পর্কে শত শত প্রবাদ আছে। সেগুলির মধ্যে বাবা, মা ও মাসি ব্যতীত অন্যদের নিন্দা, ব্যঙ্গ ও হীন দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। বিশেষত নারীর নিন্দা সমধিক। ‘ঝি জব্দ শিলে, বউ জব্দ কিলে’, ‘শাশুড়ি মল সকালে, খেয়ে দেয়ে সময় থাকে তো কাঁদব আমি বিকালে’, ‘ননদিনী রায়বাঘিনী, দাঁড়িয়ে আছে কাল-সাপিনী’, ‘শ্বশুরবাড়ি মধুর হাড়ি, তিনদিন পর ঝাঁটার বাড়ি’, ‘দুই সতীনে ঘর, খোদা-ই রক্ষা কর’ ইত্যাদি প্রবাদ এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এগুলির রচয়িতা নারী; নারীর পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানগত কারণে স্বামীর আত্মীয়-স্বজনকে সুদৃষ্টিতে দেখা বা তাদের প্রতি সুবিচার করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। যে সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা স্বীকৃত নয়, সে সমাজেই এমন প্রবাদের সৃষ্টি হয়।
‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’, ‘মোগল-পাঠান হদ্দ হলো ফারসি পড়ে তাঁতি’, ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার’, ‘আনাড়ি বৈদ্যে কান নষ্ট, কাঠমোল্লায় ঈমান নষ্ট’, ‘ঘুষ পেলে আমলা তুষ্ট’, ‘কড়ি দিয়ে কিনব দই, গয়লানি মোর কিসের সই’, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’, ‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে’, ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ ইত্যাদি প্রবাদে বিভিন্ন পেশার মানুষের চরিত্র বর্ণিত হয়েছে।
প্রবাদ ভাষার এক অমূল্য সম্পদ। প্রবাদ বক্তব্যকে সুসংহত ও অর্থবহ করে, জোরালো ও ধারালো করে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ভাষায় ‘সুন্দরীর অলক-তিলকের ন্যায় প্রবাদবাক্যগুলি ভাষায় সৌন্দর্য ফুটাইয়া তোলে।’ যুগ যুগ ধরে রচিত প্রবাদগুলি বাংলা ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। [ওয়াকিল আহমদ]
আরও দেখুন লোকসাহিত্য।
গ্রন্থপঞ্জি আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোকসাহিত্য, ১ম খন্ড, কলকাতা, ১৯৬৩; শীলা বসাক, বাংলা ধাঁধার বিষয়বৈচিত্র্য ও সামাজিক পরিচয়, কলকাতা, ১৯৯০; আশরাফ সিদ্দিকী, লোকসাহিত্য (২ খন্ড, ১৯৯৪), ঢাকা; Maria Edward Leach (ed), Standard Dictionary of Mythology, Folklore and Legends, Vols. I, II, New York, 1949; Antti Arne and Stith Thompson, The Types of Folkfates, Helsinki, 1964.