পাল শাসন
পাল শাসন আট শতকের মাঝামাঝি সময়ে গোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ বিভিন্ন উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে প্রায় চারশ’ বছর বাংলা শাসন করে। এ বংশের আঠারো জন রাজার দীর্ঘ শাসনামলে উত্থান-পতন লক্ষ করা গেলেও প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পাল শাসন যে একটা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাল রাজাদের ইতিহাসকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়: (১) ধর্মপাল (আ. ৭৮১-৮২১ খ্রি.) ও দেবপাল-এর (আ. ৮২১-৮৬১ খ্রি.) শাসনামল। এ আমল ছিল প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার যুগ; (২) স্থবিরতার যুগ (আ. ৮৬১-৯৯৫ খ্রি.)। প্রথম মহীপাল (আ. ৯৯৫-১০৪২ খ্রি.) অবশ্য এ স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে পাল বংশের গৌরব পুনরুদ্ধার করেন, যার জন্য তাঁকে পাল বংশের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়; (৩) অবনতি ও অবক্ষয়ের যুগ। রামপাল (আ. ১০৮২-১১২৪ খ্রি.) তাঁর তেজোদ্দীপ্ত শাসন দ্বারা এ অবক্ষয়কে সাময়িকভাবে রোধ করার প্রয়াস পান। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্য আর বেশি দিন টিকে থাকে নি। বারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেন বংশের উত্থানের ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
পাল বংশের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার যুগ ছিল ধর্মপাল ও দেবপালের তেজোদ্দীপ্ত শাসনকাল। এ যুগের পাল রাজারা উত্তর ভারতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন। উত্তর ভারতে প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য তাঁরা পশ্চিম ভারতের গুর্জর-প্রতিহার এবং দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটদের সাথে এক ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে লিপ্ত হন। বাংলায় যখন পাল বংশের উত্থান ঘটে দক্ষিণ ভারতে তখন রাষ্ট্রকূটগণ চালুক্যদের নিকট থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয় এবং গুর্জর-প্রতিহারগণ মালব ও রাজস্থানে নিজেদের শক্তি সংহত করে। যশোবর্মন ও ললিতাদিত্যের ঝটিকা আক্রমণে উত্তর ভারতে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সুতরাং পরবর্তী দুপুরুষ ধরে কনৌজকেন্দ্রিক উত্তর ভারতের শূন্যতা পূরণে অভিলাষী এ তিন শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
ধর্মপালের শাসনামলে দুটি পর্যায়ে এ ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধ চলে। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ভাগ্য বিপর্যয় দেখা দিলেও প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি কিছু সাফল্য লাভ করেন। তিনি কনৌজ পর্যন্ত স্বীয় প্রভাব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন এবং তাঁর অনুগৃহীত চক্রায়ুধকে কিছুকালের জন্য সেখানকার সিংহাসনে বসান। বাংলা ও বিহারের বাইরে কনৌজ পর্যন্ত পাল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়। অন্যান্য দিকেও হয়ত তিনি তাঁর রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সাফল্যের পরিমাণ সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়েও ধর্মপাল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। কিন্তু তিনি যে বাংলা ও বিহারের বাইরেও স্বীয় প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন সে সম্পর্কে তেমন কোনো সন্দেহ নেই। পাল বংশের ইতিহাসে ধর্মপালের নাম একজন বিখ্যাত বিজেতা হিসেবে উল্লিখিত হয়। তাঁর নেতৃত্বে উত্তর ভারতে বাংলার কর্তৃত্ব বেশ কিছুকাল ধরে অব্যাহত থাকে।
ধর্মপাল ছিলেন একজন একনিষ্ঠ বৌদ্ধ এবং বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। বিক্রমশীলা বৌদ্ধবিহার (কলগং থেকে প্রায় ১০ কিমি উত্তরে এবং বিহারের ভাগলপুর থেকে প্রায় ৩৯ কিমি পূর্বে পাথরঘাটা নামক স্থানে) তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। নয় থেকে বারো শতক পর্যন্ত এটি ছিল সমগ্র ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম। পাহাড়পুর এর (বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায়) সোমপুর মহাবিহার ধর্মপালের অপর একটি বিশাল স্থাপত্য কর্ম।
ধর্মপালের পুত্র ও উত্তরাধিকারী দেবপাল পিতার অনুসৃত আক্রমণাত্মক নীতি অব্যাহত রাখেন। উত্তর ভারতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাঁর সময়েও অব্যাহত থাকে। তিনি হয়ত প্রাথমিক কিছু সাফল্য লাভ করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গুর্জর-প্রতিহারগণ কনৌজ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হয়। তবে পাল সাম্রাজ্য দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িষ্যা এবং উত্তর-পূর্বে কামরূপ এর দিকে বিস্তার লাভ করে।
ধর্মপাল ও দেবপালের শাসনামল পাল সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তির যুগ। এ দুজন শাসক বাংলার দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল এবং বিহারে পাল সাম্রাজ্য সংহত করেন। তাঁদের আমলে প্রথমবারের মতো বাংলা উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে বাংলা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। কিন্তু দেবপালের মৃত্যুর সাথে সাথেই এ গৌরবময় যুগের অবসান ঘটে এবং শুরু হয় স্থবিরতার যুগ। এ স্থবিরতা ক্রমশ পাল সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়।
পাল সাম্রাজ্যের স্থবিরতা পাঁচজন রাজার শাসনামলব্যাপী একশত বছরেরও অধিককাল ধরে চলে। ধর্মপাল ও দেবপালের আমলে যে শৌর্যবীর্য ও শক্তির প্রকাশ ঘটে, এ আমলে তা ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। এ সময় সাম্রাজ্য বিস্তারের আদৌ কোনো চেষ্টা করা তো হয়ই নি, বরং বৈদেশিক হামলা এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করার শক্তিও পাল রাজাদের ছিল না। দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কম্বোজগণ পশ্চিম ও উত্তর বাংলার অংশবিশেষে অনেকটা স্বাধীন হয়ে ওঠে। কিছুকালের জন্য পাল সাম্রাজ্য শুধু বিহারের অংশবিশেষে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। শিলালিপি থেকে কম্বোজ গৌড়পতিদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়।
প্রথম মহীপাল (আনুমানিক. ৯৯৫-১০৪৩ খ্রি.) পাল সাম্রাজ্যের হারানো শৌর্য অনেকটা ফিরিয়ে আনেন এবং সাম্রাজ্যে নতুন প্রাণশক্তির সঞ্চার করেন। তিনি উত্তর ও পশ্চিম বাংলার হূতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন এবং পালবংশের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করে সাম্রাজ্যের ভিত সুদৃঢ় করেন। কিন্তু মহীপাল ও রামপালের মধ্যবর্তী রাজাদের রাজত্বকালে এ বংশের গৌরব সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। উত্তর ভারতের শক্তিসমূহের কলচুরি ও চন্দেল পুনঃপুনঃ আক্রমণ পাল রাজাদের দুর্বলতাই প্রকাশ করে। দ্বিতীয় মহীপাল এর রাজত্বকালে (আনুমানিক. ১০৭৫-১০৮০ খ্রি.) পালবংশের এ দুর্বলতা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। এ সময় কৈবর্ত প্রধান দিব্য এক সামন্ত বিদ্রোহের মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলে (উত্তর বাংলা) স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই বিচ্ছিন্নতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উত্তর বাংলায় দিব্য-র সাফল্য এ প্রবণতার উজ্জ্বল উদাহরণ।
রামপালের (আনু. ১০৮২-১১২৪ খ্রি.) শৌর্যবীর্য ও শক্তি ছিল পাল বংশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ আলোকচ্ছটা। তিনি উত্তর বাংলায় পাল আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে পালদের রাজ্য বিস্তারের সক্ষমতা প্রমাণ করেন। কিন্তু এ সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী এবং তাঁর উত্তরাধিকারীগণ এতই দুর্বল ছিলেন যে সাম্রাজ্যের ক্রমাগত পতন রোধে তাঁরা ব্যর্থ হন। এ পরিস্থিতিতে সম্ভবত পালদের অধীনস্থ একজন সামন্ত রাজা বিজয়সেন শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পান এবং বারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে পালদের বাংলা থেকে উৎখাত করেন। এভাবে বিজয়সেনের নেতৃত্বে বাংলায় এক নতুন শক্তি সেনবংশের উদ্ভব হয়। সেনগণ ছিলেন দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট অঞ্চল থেকে আগত ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয়।
প্রায় চারশ বছর স্থায়ী পাল বংশের শাসন বাংলায় একটি সুদৃঢ় সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুযোগ বয়ে আনে। এ শাসন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। পালগণ একটা সফল প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাদের ভূমিভিত্তিক সাম্রাজ্য কৃষি নির্ভর ছিল। পাল অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য তেমন গুরুত্ব পায় নি। ব্যবসায়িক কর্মকান্ড সম্ভবত দেশের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ কিংবা বড়জোর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে প্রসারিত ছিল। আট শতকের পর তাম্রলিপ্তি বন্দরের পতন সমুদ্রপথে বাংলার বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব থেকে পালদের বঞ্চিত করে।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালদের দীর্ঘ শাসন বাংলায় এক ধরনের উদার ধর্মীয় আবহ সৃষ্টি করে। এ আমলে হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রীতি ও সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। পালগণ ধর্মক্ষেত্রে উদার নীতি প্রবর্তন করেন। হিন্দু দেব-দেবী ও রাজকার্যে উচ্চপদে নিয়োজিত ব্রাহ্মণদের পৃষ্ঠপোষকতা শাসকবর্গের বিচক্ষণতার পরিচায়ক। ফলে দু ধর্মের মধ্যকার দূরত্ব হ্রাস পায় এবং পারস্পরিক সংশ্লিলষ্টতার কারণে নতুন নতুন আচার-পদ্ধতির উন্মেষ ঘটে। ক্রমে ক্রমে বাংলায় বৌদ্ধদের মধ্যে তান্ত্রিক মতবাদ ও রীতিনীতির জন্ম হয়। পাল যুগের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিমন্ডল পারস্পরিক সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের মনোভাব জাগ্রত করে। এ মনোভাব বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাসের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
শিল্পকলার ক্ষেত্রে বহুবিধ সাফল্যের জন্যও পালযুগ গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধ বিহারের স্থাপত্যরীতির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয় পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারে। এ স্থাপত্যরীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের পরবর্তী স্থাপত্য কাঠামোকে প্রভাবিত করে। বাংলার পোড়ামাটির ফলক শিল্প এ যুগে চরম উৎকর্ষ লাভ করে। পালদের ভাস্কর্য শিল্প পূর্ব-ভারতীয় শিল্প রীতির একটা বিশেষ পর্যায় হিসেবে স্বীকৃত হয়। পাল যুগেই বাংলার ভাস্করগণ তাদের শৈল্পিক প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। এ যুগের সাহিত্য কর্মের অতি সামান্য অংশই কালের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছে। তথাপি উত্তর বাংলার কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম এক অসামান্য নিদর্শন হয়ে আছে। রামচরিতমের শ্লেলাকগুলির প্রত্যেকটি দ্ব্যর্থবোধক। পরবর্তী যুগের কাব্য সংকলনে দশ ও এগারো শতকের কবিদের রচিত অনেক শ্লেলাক স্থান পেয়েছে। এ যুগে তালপাতায় লেখা কিছু সচিত্র বৌদ্ধ পান্ডুলিপি চিত্রশিল্পের উৎকর্ষের সাক্ষ্য বহন করে। এ সকল সাফল্যের বিষয় বিবেচনা করে পাল যুগকে সংগত কারণেই বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গৌরবময় যুগ হিসেবে গণ্য করা যায়। [আবদুল মমিন চৌধুরী]
গ্রন্থপঞ্জি RC Majumdar (ed), History of Bengal, vol-1, Dhaka, 1948; Abdul Momin Chowdhury, Dynastic History of Bengal, Dhaka, 1968; RC Majumdar, History of Ancient Bengal, Kolkata, 1974; নিহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব), কলকাতা, ১৪০০ বা.স।