পাল ভাস্কর্য
পাল ভাস্কর্য চারশ বছরের অধিককাল স্থায়ী (আট শতকের মধ্যভাগ থেকে বারো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত) বাংলা ও বিহারে বিস্তৃত বিশাল পাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ভাস্কর্য শিল্পের অনেকগুলি কেন্দ্র একই সঙ্গে সক্রিয় ছিল। এ সমস্ত কেন্দ্রের শিল্প সম্ভার শুধু বৈচিত্র্যপূর্ণই ছিল না, সংখ্যার দিক থেকেও ছিল প্রচুর। এ পর্যন্ত কয়েক হাজার ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলি বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন জাদুঘরে। এগুলির মধ্যে বেশ কিছু ভাস্কর্য ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি জাদুঘরেও দেখা যায়।
পাহাড়পুরের ভাস্কর্যগুলি বাদ দিলে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রাপ্ত আদি পাল ভাস্কর্যের সংখ্যা খুবই নগণ্য। বাংলায় প্রাপ্ত আদি পাল ভাস্কর্যের অনুরূপ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে নালন্দা, কুর্কিহার, বোধগয়া এবং মগধের (দক্ষিণ বিহার) নানা প্রত্নস্থল থেকে। আদি পাল পর্বে বিহারে প্রাপ্ত ভাস্কর্যের শিল্পরীতি বাংলার ভাস্কর্য নির্মাণে অনুসরণ করা হয়েছে।
পাল ভাস্কর্যের উদ্ভব গুপ্ত পরবর্তী ভাস্কর্য রীতির সাথে জড়িত। অবশ্য পরবর্তীসময়ে পাল ভাস্কর্য এ রীতি থেকে সরে আসে। এ সরে আসার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ধ্রুপদী রীতির সঙ্গে বাংলার স্থানীয় রীতির মিশ্রণ। সাত শতকের মাঝামাঝি থেকে আট শতকব্যাপী এ মিশ্ররীতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে এবং নয় শতকের সূচনালগ্নেই তা একটি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত শিল্পরীতিতে পরিণত হয়। প্রধানত ধর্মীয় প্রয়োজনই ভাস্কর্য নির্মাণে শক্তি ও উৎসাহ যুগিয়েছিল। তাই ধর্মীয় গ্রন্থে দেব-দেবীদের রূপ ও দৈহিক সৌন্দর্যের যে ধারণা পাওয়া যায় সেই অভিব্যক্তির আন্তরিক প্রকাশ ঘটাতে ভাস্করগণ চেষ্টা করতেন। পুরুষ বা নারী যে কোন মূর্তির দেহে পার্থিব ও অপার্থিব ভাব ফুটিয়ে তোলা হতো। এ জাতীয় মূর্তিগুলির দেহ বিন্যাসে ইন্দ্রিয় আকর্ষণের ভাব স্পষ্ট ছিল। নারী মূর্তি গড়ায় অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়পরায়ণতার ছোঁয়া থাকলেও পুরুষ মূর্তি নির্মাণেও ভারসাম্য রক্ষা করা হতো।এসব পুরুষ মূর্তির স্ফীত স্কন্ধদেশ থেকে দেহ কোমর পর্যন্ত ক্রমশ সরু হয়ে আসত। এভাবে পৌরুষদীপ্ত রূপ প্রকাশ করে এগুলিও সমান আকর্ষণীয় করে নির্মাণ করা হতো।
আদি পাল ভাস্কর্যের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নমুনা পাওয়া গিয়েছে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে আদি পাল ভাস্কর্যের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নমুনা পাওয়া গিয়েছে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে। ধর্মপাল কর্তৃক নির্মিত বিখ্যাত সোমপুর মহাবিহার এর কেন্দ্রীয় মন্দিরের ভিত্তি দেয়ালে স্থাপিত পাথরের ৬৩টি ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে। চমৎকারভাবে খোদিত অর্ধ ডজন ভাস্কর্য এবং আরও এক ডজন স্বতন্ত্রভাবে গড়া হিন্দু দেব-দেবীর ভাস্কর্য ব্যতীত অধিকাংশ ভাস্কর্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলির সাবলীল ও দৃষ্টিনন্দন গতিময়তা। এগুলি সাদামাটাভাবে নির্মিত এবং মনে হয় দেশিয় কোন ধারা থেকে উৎসারিত। এ ভাস্কর্যগুলি মোটামুটিভাবে একই আকৃতির এবং ধূসর বা সাদা বেলে পাথর দিয়ে গড়া। বিষয়বস্ত্ত এবং ভাস্কর্যের গঠনরীতির দিক থেকে এগুলি মন্দিরের সম্মুখ দেয়ালে অলঙ্কৃত বিপুল সংখ্যক পোড়ামাটির ফলকের প্রায় অনুরূপ ছিল। কৃষ্ণের কেশী হত্যা, কৃষ্ণ কর্তৃক যমলার্জুন বৃক্ষ উৎপাটন, এবং কয়েকজন পন্ডিতের ভাষ্য মতে, স্বর্গের নর্তকীরূপী একজন তরুণীর চমৎকারভাবে খোদিত ব্যতিক্রমধর্মী কিছু রিলিফ কেবল চিত্তাকর্ষকই নয়, বরং অভিব্যক্তিক, জীবন্ত ভাব এবং অপূর্ব গতিময়তার কারণে এগুলি অসামান্যও বটে। স্বতন্ত্রভাবে গড়া দেব মূর্তিগুলির মধ্যে তুলনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মূর্তির একটি হচ্ছে পদ্মপাণি। এটি মন্দিরের দক্ষিণ দিকের ভিত্তি দেয়ালের মাঝে স্থাপিত ছিল। এটিকে বিশেষভাবে মন্দিরের জন্যই তৈরি করা বলে মনে হয়। শিল্পরীতির বিবেচনায় এ মূর্তিটি স্পষ্টতই অন্যান্য মূর্তির চেয়ে অনেকটা উন্নত।
বর্ধমানে প্রাপ্ত এবং কলকাতার আশুতোষ জাদুঘরে সংরক্ষিত হরিহরের মূর্তিটি আদি পাল ভাস্কর্যের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। শিল্পশৈলীর দিক থেকে এ মূর্তি ও গয়ায় (বিহার)-র সন্নিকটে বরাবর পাহাড়ের সুর্জন গিরিতে প্রাপ্ত সূর্য মূর্তি (আট শতকের শেষ দিকে) প্রায় একই ধরনের। আট শতকের শেষদিকের কিছু ভাস্কর্য বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির মধ্যে অগ্রদিগুণ থেকে প্রাপ্ত এবং কলকাতার আশুতোষ জাদুঘরে সংরক্ষিত গরুড়াসন বিষ্ণু মূর্তি উল্লেখযোগ্য। বিহারের বোধগয়া থেকে প্রাপ্ত এবং বোধগয়া জাদুঘরে সংরক্ষিত বিষ্ণু মূর্তির সঙ্গে এ মূর্তিটি গঠন শৈলীগত দিক থেকে অভিন্ন। অন্যান্য মূর্তিগুলির দেহগঠন ও অলঙ্করণ প্রায় একই ধরনের। ভাস্কর্যের কাঠামোটির উপরের দিক ছিল গোলাকার এবং এর কিনারা ছাড়া বাকি অংশে কোন অলঙ্করণ ছিল না।
আট শতকের শেষদিকে গড়া ভাস্কর্যের গঠনশৈলী নয় শতকের ভাস্কর্যেও লক্ষ্য করা যায়। এ সময়ের সাধারণ প্রবণতা ছিল পূর্ণ অবয়ব মূর্তি নির্মাণ। কালো পাথর খোদাই করে রুচিশীল প্রকাশভঙ্গিতে তৈরি করা হতো অধিকাংশ মূর্তি। এর কোমল গঠনরীতিতে মাংস ও চামড়ার খাঁজ স্পষ্ট ছিল।নয় শতকের তারিখ সংবলিত মূর্তিগুলির মধ্যে বোধগয়ার দরজার উপরে
ধর্মপালের ২৬তম রাজ্যাঙ্কের সূর্য মূর্তি এবং বিগ্রহপালের রাজত্বকালের ক্ষুদ্রায়তন বিষ্ণু ও হাতিকে বশ করার চেষ্টারত বুদ্ধ মূর্তির ভাস্কর্যের কথা বলা যায়। এগুলি ছাড়াও নয় শতকের প্রস্তর মূর্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঢাকার সুখবাসপুরে প্রাপ্ত তারা মূর্তি, কুমিল্লা অঞ্চলে প্রাপ্ত এবং জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত বুদ্ধ মূর্তি, রাজশাহী জাদুঘরে সংরক্ষিত পাথরে নির্মিত সূর্য মূর্তি এবং দিনাজপুরের মঙ্গলবাড়িতে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তি।
বাংলা ও বিহার থেকে বেশ কিছু পাল ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে। বিহারে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হচ্ছে দ্বিতীয় গোপালের প্রথম রাজ্যাঙ্কের বাগীশ্বরী, সৌগতি-সন্দর্শন লোকেশ্বর এবং অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি। বাংলায় তারিখ সংযুক্ত কমপক্ষে তিনটি মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এগুলির মধ্যে দ্বিতীয় গোপালের প্রথম রাজ্যাঙ্কের একটি, বাঘাউড়াতে প্রাপ্ত প্রথম মহীপালের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কের দুটি এবং রাজবাড়িতে প্রাপ্ত ও বর্তমানে ঢাকাস্থ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত একই শাসকের সময়ের একটি গণেশ মূর্তি রয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল হতে প্রাপ্ত বেশ কিছু ভাস্কর্যের সময় শিল্পশৈলীর বিচারে দশ শতকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দিনাজপুরের সুরোহরে প্রাপ্ত ঋষভনাথ-এর প্রস্তর মূর্তি; রাজশাহীর নাগাইলে প্রাপ্ত গরুড় মূর্তি; বগুড়ার সিলিমপুরে প্রাপ্ত বরাহ মূর্তি; উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত এবং বর্তমানে কলকাতাস্থ ভারতীয় জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত মনসা মূর্তি; রাজশাহীর খিদ্রপলিতে প্রাপ্ত মনসা মূর্তি; রাজশাহীর ধোনাদিতে প্রাপ্ত তারা মূর্তি; দিনাজপুরের মঙ্গলবাড়িতে প্রাপ্ত দুর্গা মূর্তি এবং বগুড়ার পাওগাছাতে প্রাপ্ত ইন্দ্রাণী মূর্তি।উপরে উল্লিখিত বাগীশ্বরী মূর্তির শিল্পরীতির অভিন্ন অনুকরণে পাথরের তৈরি ভৃকুটি তারা মূর্তি পাওয়া গিয়েছে ভবানীপুরে। এটি বর্তমানে ঢাকাস্থ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
উপরে উল্লিখিত দশ শতকের ভাস্কর্যগুলি দেখলে স্পষ্টতই বোঝা যায় নয় শতকের ভাস্কর্যের শিল্পমান এ শতকেও বজায় ছিল। পুরুষ মূর্তিগুলির ছিল সুবিশাল দেহ এবং গঠনরীতিতে সুনিয়ন্ত্রিত প্রাণশক্তির বহিঃপ্রকাশ। দেহের বহিরঙ্গের স্ফীত অংশ শক্তির প্রকাশ বলে বিবেচিত হতো। প্রায় সবগুলি মূর্তিই ছিল উঁচু রিলিফে নির্মিত। এই যুগের কোন কোন মূর্তিতে দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লম্বাকরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৮২ সালে পাহাড়পুর বিহারের ৩৭নং সেলে ভগ্নাবস্থায় প্রাপ্ত বুদ্ধের মস্তকবিহীন ব্রোঞ্জ মূর্তিটি দীর্ঘদেহী মূর্তির অন্যতম উদাহরণ।
দশম শতকের শেষদিকে প্রথম মহীপাল কর্তৃক দ্বিতীয় পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় বাংলায় শিল্পকলা চর্চার প্রথম পুনর্জাগরণ ঘটে। এ সময়ে বাংলার শিল্পিগণ মগধের শিল্প ঐতিহ্য থেকে সরে আসেন। রাজনৈতিক শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবে শিল্পসৃষ্টির উদ্যোগ শুরু হয় এবং এগারো শতক ব্যাপী এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকে।
যদিও ঢাকার নিকট প্রাচীন বিক্রমপুর ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার শিল্পকলার অন্যান্য কেন্দ্রসমূহ বেশ সক্রিয় ছিল, তথাপি উত্তরবঙ্গের শিল্পিরাই এগারো শতকের প্রকৃষ্টতম ভাস্কর্য নিদর্শনগুলি নির্মাণ করেছিলেন।এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, এগারো শতকে হিন্দু-ভাস্কর্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। বৌদ্ধ মূর্তিসমূহের মধ্যে অধিকাংশই ছিল নারী মূর্তি। বাংলায় রেনেসাঁর শিল্প নিদর্শনসমূহ স্থানীয় ভাস্কর্যের বিভিন্ন ধারার সমন্বয়ের ফল।
রেনেসাঁকালীন আদি নিদর্শনের মধ্যে একটি হচ্ছে বাঘাউড়াতে প্রাপ্ত প্রস্তর নির্মিত বিষ্ণু মূর্তি, যা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। তারিখ সংবলিত এ ভাস্কর্যটি পরবর্তী দুই-তিন শতকের শিল্পরীতির নির্ধারক বলে ধরা হয়ে থাকে। তারিখ সংযুক্ত আরও দুটি পাথরের ভাস্কর্য রয়েছে এর একটি ফরিদপুরের কুলকার্ণিতে প্রাপ্ত সূর্য মূর্তি এবং অপরটি ঢাকার পাইকপাড়ায় প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তি। এ মূর্তিগুলির আলোকে তারিখবিহীন কয়েকটি মূর্তিকে এগারো শতকের বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে প্রথমেই উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত পাথরের বিষ্ণু মূর্তির কথা বলতে হয়, যা বর্তমানে কলকাতাস্থ ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মূর্তি-লক্ষণ এবং শিল্পশৈলীর দিক থেকে এ মূর্তিটি উপরে উল্লিখিত বাঘাউরাতে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তির প্রায় অনুরূপ। এ দুই মূর্তিরই মুখমন্ডল লাবণ্যময়, কিন্তু নিচের অংশ, বিশেষ করে পা দুটি দৃঢ় ও নমনীয়তাবর্জিত।
এগারো শতকের কিছু মূর্তিতে বিস্তৃত গঠনশৈলী পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের প্রস্তর মূর্তির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বাগেরহাটের শিববাটিতে প্রাপ্ত বুদ্ধ মূর্তি। এটি বর্তমানে ঢাকার কমলাপুর বৌদ্ধবিহারে সংরক্ষিত আছে। শিখর মন্দিরের অভ্যন্তরে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় আসীন বুদ্ধ মূর্তি ছাড়াও এটিতে বিভিন্ন ভাগে রয়েছে অন্যান্য দেবতা ও বুদ্ধের জীবনের নানা ঘটনা। একই ধরনের গঠনশৈলী সম্পন্ন অন্য দুটি ভাস্কর্য সম্পর্কে জানা যায়: একটি আবিষ্কৃত হয়েছে বিহারে যা বর্তমানে কলকাতাস্থ ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত। অন্যটি কর্ণফুলি নদী থেকে উদ্ধার করে চট্টগ্রামের বেতাগিতে অবস্থিত রত্নাঙ্কুর বিহারে সংরক্ষিত রয়েছে।
এগারো শতকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তান্ত্রিক বৌদ্ধ মূর্তি নির্মিত হয়েছিল। এদের মধ্যে হেরুকা, মারিচী এবং মঞ্জুবর উল্লেখযোগ্য। এসব মূর্তি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে এবং তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে ঢাকাস্থ জাতীয় জাদুঘর, কুমিল্লার ময়নামতী জাদুঘর এবং রাজশাহী জাদুঘরে।নিয়ামতপুরে প্রাপ্ত এবং রাজশাহী জাদুঘরে সংরক্ষিত সদাক্ষরি লোকেশ্বরের কালো পাথরের মূর্তিটি নতুন ধরনের বোধিসত্ত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য। তবে, বর্তমানে রাজশাহী জাদুঘরে সংরক্ষিত কালো পাথরে নির্মিত বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী মূর্তিটি এগারো শতকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভাস্কর্য।
আপাতদৃষ্টিতে এটিকে বিষ্ণুর প্রতিকৃতি বলে মনে হয়। এটি সুপরিজ্ঞাত যে, ভারতীয় মূর্তিতত্ত্ব এবং দেব মূর্তিতে মানবীয় রূপ প্রদানে একই ধরনের ও বিপরীতধর্মী অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। এ মূর্তিটি নির্মাণে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, বুদ্ধের প্রতিকৃতির সমান্তরালে হিন্দু দেবতার প্রতিকৃতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা ছিল। দুই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখা কিংবা হিন্দু দেবতার চেয়ে বৌদ্ধ দেবতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা - যে কোন একটি উদ্দেশ্যেই এটি করা হয়েছিল।
সূক্ষ্ম খোদাই ছিল এগারো শতকের হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির উল্লেখযোগ্য দিক। এ ধারার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে শিয়ালদিতে প্রাপ্ত (বর্তমানে আমেরিকার একটি জাদুঘরে সংরক্ষিত) বিষ্ণু এবং বগুড়া জেলার ছাতিয়ান গ্রামে প্রাপ্ত ও রাজশাহী জাদুঘরে সংরক্ষিত সরস্বতীর প্রস্তরমূর্তি। একই যুগের অপর একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প নিদর্শন হচ্ছে উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত এবং কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত ছয় হাত বিশিষ্ট পাথরের গণেশ মূর্তি। বগুড়া জেলার বেলামলায় প্রাপ্ত ও রাজশাহী জাদুঘরে সংরক্ষিত এগারো শতকের বিশালাকৃতির ব্রোঞ্জ মূর্তিসমূহ যেমন, গজলক্ষ্মী ও বিষ্ণু এবং রংপুরে প্রাপ্ত ও ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত বিষ্ণু ত্রিবিক্রম মূর্তি এযুগের সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা মূর্তির উল্লেখযোগ্য নির্দশন।
পাল রাজবংশের শেষ শক্তিশালী রাজা রামপালএর সময় বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের দ্বিতীয় পুনরুত্থান ঘটে। এ যুগের বেশ কিছু ভাস্কর্য পরবর্তী যুগের ভাস্কর্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল।
এ কারণে এ দুই শতকের ভাস্কর্যকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কষ্টকর। সামান্য কয়েকটি উদাহরণ বাদ দিলে এগারো শতকের অনেক বৈশিষ্ট্যই বারো শতকে অব্যাহত ছিল। তাই বাংলার বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত শত শত তারিখবিহীন ভাস্কর্যের সময় নির্ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ থেকে বারো শতকের বৌদ্ধ দেব-দেবীর বেশ কিছু মূর্তি পাওয়া গেছে, কিন্তু বিপুল সংখ্যক হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তির সংখ্যার তুলনায় এগুলি নিতান্তই সামান্য ছিল। এতে বোঝা যায়, এ সময় ধর্ম হিসেবে বৌদ্ধ মতবাদ ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় এসে পৌঁছেছিল।
এ কথা বলা যেতে পারে যে, প্রারম্ভিক পর্যায়ে ধর্মীয় অনুভূতির সরল ও অকৃত্রিম অভিব্যক্তি নিয়ে পাল ভাস্কর্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যদিও প্রথম দিককার ভাস্কর্য ছিল ভারী ধরনের, তবুও এদের নির্মাণশৈলী ছিল উন্নত। দশ শতকে ভাস্কর্যে পোশাক-পরিচ্ছদ ও গয়নার ব্যবহার এবং পশ্চাৎপট অলঙ্করণ ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পায়। মূর্তির আকৃতি ক্রমে ক্রমে বড় হয়ে উঠে। পাশাপাশি মূর্তির দৈহিক গঠনের ব্যাপারে ভাস্করদের ছিল বিশেষ মনোযোগ। মূর্তি চেহারায় একটি বিশেষ ভাবের প্রকাশ ঘটে এবং তাতে ফুটে উঠতো ধ্যানমগ্নতা। এগারো শতকের ভাস্কর্যসমূহের পশ্চাৎপটের পাথরে লতাপাতা ও নানা উদ্ভিদ বিষয়ক অলঙ্করণ শোভা পায়। মূল মূর্তির গায়ে দেখা যায় অলঙ্কারের বাহুল্য এবং পাথর খোদাই করে সূক্ষ্ম কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হতো। মূর্তির দেহ অনেক বেশি দীর্ঘ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর সচল ভঙ্গিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, চেহারায় একটি আড়ষ্ট ভাব চলে আসে, পোশাক ও অলঙ্কারের ব্যবহার অনেক কমে যায় এবং দীর্ঘদেহী মূর্তিকে ঘিরে অনেক ছোট ছোট মূর্তি স্থাপন ও বিস্তৃতভাবে অলঙ্করণ শুরু হয়। দু’একটি চমৎকার উদাহরণ ব্যতীত এগারো শতকের শেষদিকে এবং বারো শতকে পাল ভাস্কর্যসমূহ ছিল গতানুগতিক। এ অবস্থা পাল ভাস্কর্যের অধঃপতনের ইঙ্গিত বহন করে। [শামসুল আলম]
গ্রন্থপঞ্জি NK Bhattasali, Iconography of Buddhist and Brahamanical Sculptures in the Dacca Museum, Delhi, 1929; JC French, The Art of the Pala Empire of Bengal, Oxford, 1928; Susan L Huntington, ‘Some Aspects of Bengal Stone Sculpture in Bangladesh’, Lalitkala, Dhaka Museum; Stella Kramrisch, ‘Pala and Sena Sculpture’ in RUPAM, No. 40, Calcutta, 1929; SK Saraswati, Early Sculpture of Bengal, Calcutta, 1962; Fredrick M Asher, The Art of Eastern India, Calcutta, 1984; AKM Shamsul Alam, Sculptural Art of Bangladesh, Dhaka, 1985.