নাপিত
নাপিত (নরসুন্দর) চুল ছাঁটা বা কাটার কাজে নিয়োজিত বিশেষ পেশার লোক। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজে নাপিত ছিল একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান স্বরূপ। আগেকার দিনে হিন্দু সস্প্রদায়ের বিয়ে ও জন্ম উৎসবে নাপিতরা কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। মুসলিম পরিবারবর্গও নবাগত শিশুর মাথা ন্যাড়া করার জন্যে নরসুন্দরের দ্বারস্থ হতো। হিন্দু পরিবারে কারও মা অথবা বাবা মারা গেলেও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর নাপিত তার ছেলেদের মাথা ন্যাড়া করে দেয়। গ্রামের বাজারে নাপিতদের নির্দিষ্ট দোকান আছে।
সেখানে গ্রামের লোকেরা তাদের চুল কাটা, ছাঁটা, নখ কাটা এবং ছোটখাট কাটাছেঁড়ার কাজ করায়। এসব সেবা প্রদানের মাধ্যমে নাপিত উপার্জন করে। এই উপার্জন অর্থ হতে পারে, আবার কোন দ্রব্যসামগ্রীও হতে পারে। আগেকার দিনে নাপিতদেরকে কাজের বিনিময়ে সাধারণত দ্রব্যসামগ্রী দেওয়া হতো। এই বিনিময় প্রথার নাম ছিল যজমানি ব্যবস্থা। গ্রামের লোকজন সারা বৎসরের সেবার বিনিময়ে নাপিতদের ফসলের মৌসুমে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য দিত। চালাকিপনা, রসিকতা, আড্ডাবাজি ও গল্প বলায় নাপিতদের বিশেষ দক্ষতা ছিল। এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে এবং এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে তথ্য আদানপ্রদান হতো নাপিতদের মাধ্যমে।
এছাড়া শিশুর জন্ম-সংবাদের বাহক হিসেবে তারা কাজ করত। আর নবজাতক ছেলে শিশু হলে সে খবর সরবরাহ করে উভয় পক্ষ থেকে তারা উপহার পেত।
কেউ কেউ মনে করেন, নাপিত এসেছে ক্ষত্রিয় পিতা এবং শূদ্র মাতার পরিবার থেকে। অনেকের ধারণা নাপিতের উৎপত্তি দেবতা শিব থেকে, যিনি তাঁর স্ত্রীর নখ কেটেছিলেন। নাপিতরা কতিপয় অনুসস্প্রদায়ে বিভক্ত, যথা আনারপুরিয়া, বামানবেন, বরেন্দ্র, রাঢ়ী, মাহমুদাবাজ, সপ্তগ্রাম, সাতঘরিয়া, খোট্টা ইত্যাদি। নাপিত নিম্ন সস্প্রদায়ের হলেও অস্পৃশ্য নয়। এমনকি ব্রাহ্মণরাও নাপিতের হাতে পানি পান করে। অধিকাংশ নাপিতই বৈষ্ণব। ধর্মীয় কাজে তারা ব্রাহ্মণদের ও পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত করে থাকে। তাদের মৃতদেহ আগুনে পোড়ানো হয়। মৃত্যুর একত্রিশ দিন পর শাস্ত্রমতে তাদের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। খাবারদাবার পরিবেশনে তারা হিন্দুশাস্ত্র মেনে চলে। বৈষ্ণব নাপিত মাংস খায় না, কিন্তু মাছ খায়।
শহুরে নাপিতদের অবস্থান ও চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখানে নারীপুরুষ বা ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য সেলুন আছে। সবধর্মের লোকই নাপিত হিসেবে কাজ করে। তারা চুল কাটার আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দক্ষতার সাথে সেলুনে কাজ করে। গ্রামের নাপিতদের চেয়ে তাদের উপার্জন অনেক বেশি। শহুরে নাপিত চুলকাটা ও কেশসজ্জা এবং কখনও বা মাথা মালিশ করা ছাড়া অন্য কিছু করে না। গ্রামের নাপিতরা কেশবিন্যাস বা মালিশের কাজ প্রায় করে না বললেই চলে। [গোফরান ফারুকী]