যজমানি প্রথা

যজমানি প্রথা  আধুনিক বাজার অর্থনীতিপূর্ব সময়ের স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি ব্যবস্থার একটি আর্থ-সামাজিক প্রথা। বর্ণাশ্রম এবং প্রচলিত প্রথায়ই তখন গ্রামীণ সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ন্ত্রিত হতো। গ্রামীণ জীবনধারা তখন পুঁজি ও মুক্তশ্রম ছাড়াই অব্যাহত ছিল। বস্ত্তত, যজমানি প্রথা এমন একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি যেখানে গ্রামবাসীরা তাদের পণ্য ও সেবা পরস্পর বিনিময় করত।

যজমানি প্রথার দুটি অর্থব্যঞ্জনা রয়েছে, একটি ধর্মীয় ও অন্যটি আর্থিক। ধর্মীয় দিক থেকে যজমান হলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি ভাবগম্ভীর ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের জন্য ধর্মগুরুদের নিয়োগ দেন এবং তাদের অর্থ দান করেন। সাধারণত উৎসব পালনের জন্য একই ধর্মগুরুকে বরাবর আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তাকে প্রদেয় অর্থ প্রথামাফিক এমনকি বংশপরম্পরাগতও হয়ে থাকে। ধর্মগুরু ঐ উৎসব পালন না করলেও তাকে প্রথানুগ ভাতা প্রদানে যজমান সাধারণত বাধ্য থাকেন। ধর্মীয়ভাবে এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা যা ধর্মগুরুদের জীবনধারনের জন্য তাদের যজমানদের ওপর নির্ভরশীল করে রাখে। ক্রমে প্রথাটি ধর্মীয় অবস্থান থেকে আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের রূপ পরিগ্রহ করে।

আত্মনির্ভরশীল ও মুদ্রাবিহীন গ্রামীণ অর্থনীতির যুগে যজমানি প্রথায় সমাজকাঠামোর বিভিন্ন পেশার অনুসারীদের মধ্যে উৎপন্ন দ্রব্যাদির ও সেবার বিনিময় চলত। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার ব্যবহার ছিল, তা কড়িই হোক বা যেকোন ধাতুই হোক। যজমানির ক্ষেত্রে অর্থের পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। জাত ও পেশার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে গ্রামীণ মানুষেরা নিজেরাই দৈনন্দিন প্রয়োজনের দ্রব্যসমূহ উৎপাদন করত। কৃষকরা উৎপাদন করত খাদ্যশস্য এবং অকৃষক কারিগর ও কর্মীরা অন্য দ্রব্যাদি সরবরাহ করত। কারিগর ও কর্মীদের খাদ্যের প্রয়োজন ছিল, এবং কৃষকরাও এমন জিনিস চাইত যেগুলি তারা তৈরি করতে পারত না। কৃষি যন্ত্রপাতি, কাপড়, ঔষধ, যানবাহনাদি, মাছ, লবণ, চিনি ইত্যাদি দ্রব্যের জন্য তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

সময়ের বিবর্তনে যজমানি প্রথায় পারস্পরিক নির্ভরতা দূরীভূত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রথাগত ব্যবস্থায় তারা নিজেদের মধ্যে তাদের স্ব স্ব উৎপন্ন দ্রব্য বিনিময় করতে থাকে। খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষকরা এ কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কারিগর, তাঁতি, নৌকার মাঝি, পরামানিক, ঝাড়ুদার, চিকিৎসক প্রমুখ কৃষক পরিবারকে তাদের উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবা প্রদান করত। পরিবর্তে ফসলের মরশুমে প্রত্যেকের দেনা একুনে পরিশোধিত হতো ফসলের অংশ থেকে। কৃষকরা, ধর্মনিষ্ঠ গৃহস্বামীর মতো এক স্বতন্ত্র ধরনের বিনিময় হিসেবে ব্রাহ্মণদের ভোজদিত, এবং এই আহার প্রদানকারী সম্পন্ন কৃষকরাই সকল কৃষি বহির্ভূত উপাদানের যজমানে পরিণত হলো। শিল্পপূর্ব বাংলার অর্থনীতিতে যজমানি প্রথা অত্যন্ত সফলভাবে কার্যকর ছিল। এ প্রথা বাইরের জগৎ থেকে গ্রামকে মুক্ত রেখেছিল। যজমানি বিনিময় প্রথায় গ্রামের লোকজন যেকোন পার্থিব প্রয়োজনে বাইরের জগতের ওপর নির্ভরশীল না হয়েও ভালভাবে বাঁচতে পারত। এটি শিল্পপূর্বযুগে বাংলার সমাজ ও অর্থনীতির অপরিবর্তিত বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক।

ইউরোপীয় বাণিজ্য কোম্পানিগুলি ষোড়শ শতক থেকে সমুদ্রপথে বাংলাদেশে আসতে শুরু করলে যজমানি প্রথা প্রথমবার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় কোম্পানিগুলি নিজ নিজ বাণিজ্যিক কাজ করার জন্য নগদ টাকার প্রচলন করে। প্রত্যেক কোম্পানি বাংলার উৎপন্ন দ্রব্য বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে এসেছিল। কোম্পানিগুলি বাংলার যেসব কারিগরদের তৈরি শিল্পদ্রব্য ব্যবসায়িক প্রয়োজনে সংগ্রহ করত তারাই ছিল যজমানি প্রথা থেকে বেরিয়ে আসা প্রথম দল। তারা নগদ অর্থ লাভ ও পণ্যের প্রতিযোগিতায় বিশ্ববাজারে শরীক হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, নগরায়ণের উদ্ভব এবং উনিশ শতকের প্রথম থেকে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিসহ আধুনিক শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশে যজমানি প্রথা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ গড়ে উঠা বাংলার বৈচিত্র্যময় অর্থনীতির পেক্ষাপটে যজমানি প্রথার বিলোপ ঘটে।  [সিরাজুল ইসলাম]