তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী
তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের (১৬০৫-১৬২৭) আত্মচরিত বা স্মৃতিকথা। এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন তারিখ-ই-সেলিমশাহী, তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী, ওয়াকিয়াত-ই-জাহাঙ্গীরী এবং জাহাঙ্গীরনামা ইত্যাদি। প্রথমে বারো বছরের স্মৃতিকথা লেখা হলে তিনি তা’ বাঁধাই করে আমীর উমরাহদের উপহার হিসেবে দেন। প্রথম কপি পান সম্রাটের পুত্র শাহজাহান (পরে সম্রাট)। রাজত্বের সপ্তদশ বছরে সম্রাট অসুস্থ হয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে থাকলে স্মৃতিকথা লেখার দায়িত্ব সাম্রাজ্যের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মুতামদ খানের উপর বর্তায় (শেষোক্ত ব্যক্তি নিজেই ইকবাল-নামা-ই-জাহাঙ্গীরী নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, এ গ্রন্থে শাহজাহানের সিংহাসন আরোহণকাল পর্যন্ত সকল মুগল সম্রাটদের ইতিহাস পাওয়া যায়)। মুতামদ খান গ্রন্থ রচনা অব্যাহত রাখেন এবং জাহাঙ্গীরের রাজত্বের উনিশতম বছর পর্যন্ত ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করেন।
পান্ডুলিপি পর্যায়ে তুজুক এর অনেক কপি পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে অনেক জাল কপিও আছে, আবার কিছু কিছু কপিতে প্রক্ষিপ্ত বা অতিরিক্ত অংশ সন্নিবেশ করা হয়েছে। তুজুক এর যে কপি সৈয়দ আহমদ খান গাজীপুর এবং আলীগড় থেকে প্রকাশ করেন তা সংগৃহীত মূল পান্ডুলিপিগুলির মধ্যে সর্বোত্তম বলে বিবেচনা করা হয়। এ কপিটিই প্রথম প্রকাশিত হয়। একাধিক পন্ডিত ব্যক্তি তুজুক এর ইংরেজি অনুবাদ করেন, কিন্তু পরবর্তীকালে বেভেরীজ কর্তৃক সংশোধিত, সম্পাদিত ও টীকা-টিপ্পনীযুক্ত রোজারস-এর অনুবাদ পন্ডিত সমাজে বেশি সমাদর লাভ করেছে।
যদিও জাহাঙ্গীরের পিতা আকবর বাংলা জয়ের পরিকল্পনা করেন কিন্তু মুগলদের বাংলা বিজয় সম্পূর্ণ হয় জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে এবং এ কৃতিত্বের দাবিদার হলেন সুবাহদার ইসলাম খান চিশতি। তাই বাংলায় মুগল অধিকার বিস্তারের ইতিহাসের জন্য তুজুক খুবই প্রয়োজনীয় উৎস। অবশ্য উল্লেখ্য যে, জাহাঙ্গীর বাংলার ইতিহাসের শুধু ঐ বিষয়গুলি উল্লেখ করেন, যে সকল বিষয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। যে ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে গভর্নর কুতুবউদ্দীন খানের মৃত্যু হয় এবং খাজা উসমানের নেতৃত্বাধীন আফগানেরা পরাজিত হয়, তার উপর তিনি বেশি প্রাধান্য দেন। বাংলায় নিযুক্ত সুবাহদার কুতুবউদ্দীন খান কোকা সম্রাটের খেলার সাথী অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু কুতুবউদ্দীন বর্ধমানের ফৌজদার এবং মেহেরুন্নেছার (পরে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান) স্বামী আলী কুলী ইসতাজলু শের আফগানের হাতে নিহত হন। এ কারণেই হয়ত কুতুবউদ্দীন খান কোকার মৃত্যুর বিষয়ে সম্রাট বিস্তারিত আলোচনা করেন। আফগানেরা মুগলদের প্রধান শত্রু ছিল, তারা বীর যোদ্ধাও বটে। বিশেষ করে খাজা উসমান, তাঁর পিতা ও ভাইগণ মিলে ঊড়িষ্যার কুতলু খানের সৈন্য বিভাগে যোগ দেন এবং সেখানে তাঁরা মুগল আক্রমণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কুতলুর মৃত্যুর পর মুগল সেনাপতি রাজা মানসিংহ খাজা উসমান ও তাঁর ভাইদেরকে বাংলার দিকে তাড়িয়ে দেন। বাংলায়ও তাঁরা শক্তি সঞ্চয় করেন এবং বুকাই নগরে (ময়মনসিংহ এলাকায়) তাঁদের এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন, এ কারণে বাংলায় আফগানদের দমন করার জন্য জাহাঙ্গীর খুবই উৎকণ্ঠিত ছিলেন। তাই দেখা যায়, সম্রাটের স্মৃতিকথায় আফগানদের পরাজয়ের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে অর্ধ ডজনেরও বেশি সুবাহদারকে বাংলা শাসনের জন্য পাঠানো হয় এবং তাঁরা বাংলা, কামরূপ ও আসামে অনেক যুদ্ধ করেন, কিন্তু এগুলি সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নি। আকবরের সময়কাল থেকে ভূঁইয়াগণ বাংলায় মুগল আধিপত্য বিস্তার প্রতিহত করে আসছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে বারো ভূঁইয়াগণ খুব বিখ্যাত ছিলেন। সুবাহদার ইসলাম খান চিশতি এদেরকেও পরাজিত করে ভাটি অঞ্চল দখল করেন। তুজুকে ভাটি অঞ্চল বা বারো ভূঁইয়া এবং তাঁদের নেতাদের বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য, বাকলার রামচন্দ্র, ভুলুয়ার অনন্তমাণিক্য, ভুষণার রাজা সত্রজিৎ, ফতেহাবাদের মজলিস কুতুব, সিলেটের বায়েজীদ কররানী এবং আরও অনেক জমিদার ও ভূঁইয়া যাঁরা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে মুগল অধীনতা মেনে নেন, তাঁদের কথাও তুজুকে পাওয়া যায় না। তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরীতে সম্রাট সমগ্র মুগল সাম্রাজ্য অন্তর্ভুক্ত করেন এবং বাংলা ছিল তাঁর ক্ষুদ্র অংশ মাত্র (১৫টি সুবাহ্ বা প্রদেশের একটি) কিন্তু তুজুক কালক্রম নির্দেশনা, বিশেষ করে সুবাহদার এবং অন্যান্য রাজকীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি, ডেকে পাঠানো বা বরখাস্তকরণের সঠিক তারিখ জানার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। [আবদুল করিম]
গ্রন্থপঞ্জি Syed Ahmed Khan (ed), Tuzuk-i-Jahangiri, Aligarh, 1864; Beni Prasad, History of Jahangir, 5th edition, Allahabad, 1962; A Rogers & H Beveridge (tr), The Tuzuk-i-Jahangiri, 2nd edition, 1968; A Karim, History of Bengal, Mughal Period, I, Rajshahi, 1992.