তারিখ-ই-শেরশাহী
তারিখ-ই-শেরশাহী একখানা ঐতিহাসিক গ্রন্থ। এটি রচনা করেন আববাস খান সরওয়ানী। তিনি জাতিতে আফগান ছিলেন এবং মুগল সম্রাট আকবর-এর অধীনে ওয়াকিয়ানবিশ (সংবাদ লেখক) হিসেবে কাজ করতেন। তিনি পৃষ্ঠপোষক আকবরের নির্দেশে ইতিহাস প্রণয়নে উদ্যোগী হন। প্রকৃতপক্ষে এ ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম নামকরণ করা হয় তোহফাহ-ই-আকবরশাহী, এবং তারিখ-ই-শেরশাহী এর প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম। তোহফাহ-ই-আকবরশাহী ছিল দিল্লির লোদী ও শূর সুলতানদের বিস্তারিত ইতিহাস। কিন্তু বর্তমানে গ্রন্থটির শুধু তারিখ-ই-শেরশাহী শিরোনামের অংশটি পাওয়া যায়।
তারিখ-ই-শেরশাহী এমন এক ব্যক্তিত্ব দ্বারা রচিত যাঁর ছিল শের খানের (পরে শেরশাহ) সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে সম্পর্ক এবং তাঁর আরও অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল যাঁদের পিতা শেরশাহ ও তদীয় পুত্র ইসলাম শাহের অধীনে কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। আববাস সরওয়ানী তাঁর তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে আরও অনেকের নামে উল্লেখ করেন যাঁরা আফগান সুলতানদের শাসনকালে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তারিখ-ই-শেরশাহীতে সমসাময়িক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের জীবনীও অন্তর্ভুক্ত আছে।
অল্প সময়কালের জন্য হলেও আববাস খান সরওয়ানী আকবরের অধীনে মুগল দরবারে সভাসদ ছিলেন। এ সুযোগে তিনি সরকারি দলিল-দস্তাবেজ ও মুগল গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ পান। তিনি যদিও মুগল সম্রাটের অধীনে একজন সরকারি বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে ইতিহাস রচনা করেন, তবুও শেরশাহকে এক আদর্শ শাসক হিসেবে চিত্রিত করতে ও তাঁর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার প্রবর্তনের জন্য সাধুবাদ দিতে ভোলেন নি বা ভয় পান নি। তিনি স্বয়ং একজন আফগান হওয়ায় আফগানদের গোত্রীয় কলহ এবং আমীর উমরাহদের হিংসাপরায়ণতা সম্বন্ধে সজাগ ছিলেন। মুগলদের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আফগানদের দুর্ভাগ্যের জন্য তিনি একেই দায়ী করেন। হিজরি ৯৯৪ বা ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে তারিখ-ই-শেরশাহী লেখা শেষ হয়।
বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য তারিখ-ই-শেরশাহী এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস। শেরশাহের হাতে বাংলা কিভাবে স্বাধীনতা হারায় তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সরওয়ানীর ইতিহাসে পাওয়া যায়। বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-৩৮) তাঁর পিতা ও ভাইয়ের কাছ থেকে সুসংগঠিত প্রশাসনিক বিলিব্যবস্থাসহ এক বিরাট রাজ্য উত্তরাধিকারসূত্রে পান। তবুও শেরশাহ অতি সহজেই তাঁর নিকট থেকে বাংলা ছিনিয়ে নেন। একদিকে গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহের বোকামি ও অন্যদিকে শেরশাহের বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতা এটা সম্ভব করে বলে তিনি অভিমত দেন। সামান্য এক জায়গিরদারের সন্তান থেকে শেরশাহ বিরাট অঞ্চলের প্রভু হয়েছিলেন এবং এ ভিত্তির জোরেই তিনি দিল্লির সিংহাসন দখলের প্রতিযোগিতায় নামেন।
মুসলমানেরা যদিও তিনশত বছরের অধিক কাল ধরে বাংলা শাসন করে তবুও সমসাময়িককালে বাংলা মুলুকে লিখিত কোনো ইতিহাস গ্রন্থ আজ অবধি পাওয়া যায় নি। বাংলার স্বাধীনতা বিলোপ ও শেরশাহ কর্তৃক বাংলা দখলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি একমাত্র আববাস সরওয়ানীর তারিখ-ই-শেরশাহীতেই পাওয়া যায়। এতে বাংলায় শেরশাহের প্রশাসনিক বিলিব্যবস্থার বিষয়েও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বাংলার গভর্নর খিজির খান সুরক-এর বিদ্রোহ, শেরশাহ কর্তৃক তড়িৎ গতিতে তা দমন, এবং পরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাকে ছোট ছোট প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্তকরণ প্রভৃতির বর্ণনা এখানে পাওয়া যায়। দিল্লি সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলায় শান্তি-স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য শেরশাহের নেওয়া পদক্ষেপসমূহ, তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এবং বাংলাসহ সমগ্র সাম্রাজ্যে রাজস্ব সংস্কারের বিবরণও এখানে পাওয়া যায়। তারিখ-ই-শেরশাহী আরও তথ্য দেয় যে, শেরশাহ পাঞ্জাব থেকে সানারগাঁও পর্যন্ত এক মহাসড়ক (গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড) নির্মাণ করেন। এ দীর্ঘ রাস্তার পাশে প্রতি দুই ক্রোশ (প্রতি ক্রোশে দুই মাইল) অন্তর অন্তর সরাইখানা ছিল। এ সকল সরাইতে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের পথচারী ও ভ্রমণকারীদের জন্য পৃথক পৃথক বিশ্রামখানা ও পানাহারের ব্যবস্থা ছিল। [আবদুল করিম]
গ্রন্থপঞ্জি SM Imamuddin (ed), Tarikh-i-Sher Shahi of Abbas Sarwani, Dhaka University, 1964; KR Qanungo, Sher Shah and His Times, Calcutta, 1965.