ঢাকা নওয়াব পরিবার
ঢাকা নওয়াব পরিবার ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে নওয়াব উপাধি পেয়ে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাজা পরিবার ‘ঢাকার নওয়াব পরিবার’ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পরবর্তী প্রায় এক শত বছর ধরে তাঁরা ছিলেন পূর্ব বাংলার সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার। ঢাকার নওয়াব পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কাশ্মীর থেকে বাংলায় আসেন। উল্লেখ্য, তখন স্থল পথে বাংলাদেশের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। কাশ্মীরে থাকাকালে খাজা পরিবারের প্রধান ছিলেন খাজা আবদুল হাকিম। মুগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের (১৭১৯-১৭৩৯ খ্রি.) আমলে তিনি দেশ ত্যাগ করে দিল্লী চলে যান। ১৭৪০ খ্রি. নাদির শাহের দিল্লী লুণ্ঠনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে খাজা আবদুল হাকিম সিলেটে অভিবাসন করেন এবং সেখানে ব্যবসা বাণিজ্য করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সিলেটে কালেক্টরেট ভবন এলাকায় তাঁর কবরের অস্তিত্ব আছে।
অন্যদিকে কাশ্মীরে খাজা পরিবারের আরেকটি শাখার খাজা আবদুল ওহাব এবং খাজা আবদুল্লাহ নামে দুজন খ্যাতনামা ব্যক্তি পরবর্তীতে পরিবার পরিজন নিয়ে ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। ঢাকা এবং সিলেটে পৃথকভাবে বসবাস করলেও খাজা পরিবারের উভয় শাখার মধ্যে যোগাযোগ ছিল। খাজা আবদুল ওহাব ঢাকায় স্বর্ণ সহ নানা ধাতু ও চামড়ার ব্যবসা ব্যবসা শুরু করলেও তাঁর ছোট ভাই মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ছিলেন সুফি ভাবাপন্ন। তিনি ঢাকায় একটি খানকা স্থাপন করেন।
মৌলবী খাজা আবদুল্লাহর জ্যেষ্ঠপুত্র খাজা আহসানুল্লাহ এবং দ্বিতীয় পুত্র খাজা হাফিজুল্লাহ। ব্রিটিশ ও আমের্নীয়দের সাথে চামড়া, লবণ ও স্বর্ণপাতের ব্যবসা এবং মহাজনী কারবার করে খাজাগণ বিশেষ করে খাজা আলীমুল্লাহ অসাধারণ ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করেন। খাজা হাফিজুল্লাহর এই আর্থিক স্বচ্ছলতাকে সামাজিক ক্ষমতা ও সম্মানে রূপান্তরিত করা হয় উনিশ শতকের প্রথম তিন দশকে যখন সূর্যাস্ত আইন এর অধীনে ব্যাপকহারে এবং খুব সস্তায় জমিদারি সম্পত্তি নিলামে বিক্রয় হচ্ছিল।
খাজা হাফিজউল্লাহ এবং তাঁর ভাতিজা খাজা আলীমউল্লাহ অনেক জমিদারী এষ্টেট ক্রয় করেন। মহাজন, বানিয়া ও পুঁজিপতি আমলাগণ ঐসব জমিদারি খরিদ করে নতুন নতুন ভূ-স্বামী পরিবার গঠন করতে থাকেন। খাজা হাফিজুল্লাহ ওই সময় যেসব জমিদারি পরগনা ক্রয় করেন সেগুলো হলো: বরিশালের আয়লা-টিয়ারখালী ও ফুলঝুরি, ময়মনসিংহের ইটনা, ত্রিপুরা-কুমিল্লার বলদাখাল ও এলাহিখাল প্রভৃতি।
খাজা হাফিজুল্লাহ বুড়িগঙ্গার তীরে সোয়ারীঘাটে নতুন ভবন তৈরী করেন এবং বেগমবাজারের পৈত্রিক নিবাস ত্যাগ করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। ১৮৪০ খ্রি. লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘প্যানোরামা অব ঢাকা’ এর দৃশ্যে তাঁর বাড়িটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উক্ত বাড়ির কাছে তিনি একটি মাদ্রাসা এবং একটি মসজিদও নির্মাণ করেন। তিনি ১৮১৫ খ্রি. ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। খাজা হাফিজুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্র খাজা আবদুল গফুর তাঁর এস্টেটের মালিক হন। বিচক্ষণ আবদুল গফুর ময়নসিংহের আটিয়া পরগনার কিছু অংশ ক্রয় করেন। তিনি ১৮২২ খ্রি. মাত্র ৪০ বছর বয়সে মারা যান।
খাজা আলীমুল্লাহ ছিলেন ঢাকা নওয়াব এস্টেটের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তাঁর চাচা খাজা হাফিজুল্লাহর তত্ত্বাবধানে থেকে ব্যবসা বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদ অর্জন করেন। তৎকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থা উপলব্ধি করে তিনিও তাঁর চাচার ন্যায় নিলামে ওঠা জমিদারি ক্রয় শুরু করেন। খাজা আলীমল্লাহ বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরা জেলায় বিস্তর জমিদারি ও বহুসংখ্যক নীলকুঠি ক্রয় করেন। তিনি মহাজনি কারবার করতেন এবং ঢাকা ব্যাংকের একজন প্রধান অংশীদার ও পরিচালক ছিলেন। খাজা আলীমুল্লাহর প্রভাব প্রতিপত্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার তাঁদের ভূ-সম্পত্তি পরিচালনার জন্য তাঁকে মোতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। তাঁর সময় খাজা পরিবারের ধন-সম্পত্তি পুরোপুরি একটি একক এস্টেটে পরিণত হয় এবং তাঁদের খ্যাতি সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। খাজা আলীমুল্লাহ তাঁর নিজের সহায় সম্পত্তি মৃত্যুর পরেও অটুট রাখার নিমিত্তে তা একটি ট্রাস্ট ফান্ডের অধীন এনে একজন উপযুক্ত উত্তরাধীকারীর কর্তৃত্বাধীনে রেখে যেতে মনস্থ করেন। সার্বিক দিক বিচার করে তিনি পুত্র আবদুল গনিকে উপযুক্ত বিবেচনা করেন এবং ১৮৪৬ খ্রি. একটি ওয়াকফনামা ও কয়েকটি দানপত্র দলিল (হেবা বেল এওয়াজ) সম্পাদন করে যাবতীয় সম্পত্তি ও ব্যবসায়িক কারবার তাঁর কর্তৃত্বে ছেড়ে দেন এবং অন্যান্য পুত্র-কন্যা ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য ভাতা ধার্য করে দেন। উক্ত ওয়াকফ দলিলকে ঢাকা নওয়াব পরিবারের প্রভাবের মূল চাবি কাঠি বলা হয়। এর ফলে তাঁদের এস্টেট একতাবদ্ধ হয় ও এর ক্রমোন্নতির পথ প্রশস্ত হয়।
খাজা আলীমুল্লাহ ইংরেজদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি নিজে ইংরেজি শেখেন এবং পরিবারের সদস্যদের ইংরেজি শেখার ব্যবস্থা করেন। আভিজাত্য অর্জনের লক্ষ্যে খাজা আলীমুল্লাহ অনেক মূল্যবান মণিমুক্তা ক্রয় করেন এবং হাতি-ঘোড়া নিয়ে চলাচল শুরু করেন। ১৮৩০ খ্রি. তিনি ফরাসি বণিকদের নিকট থেকে কুমারটুলির কুঠিবাড়ি ক্রয় করে তা সংস্কার করেন। ভবনটি তাঁর পুত্র আবদুল গনির সময় পরিবর্তিত পরিবর্ধিত হয়ে বিখ্যাত আহসান মঞ্জিলের রূপ পরিগ্রহ করে। ১৮৫৪ খ্রি. (১২৬১ সন ১৬ ভাদ্র বাংলা) খাজা আলীমুল্লাহ পরলোকগমন করেন।
খাজা আবদুল গনি ছিলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পূর্ববঙ্গের সর্বশ্রেষ্ঠ জমিদার ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও সাংগঠনিক দক্ষতা উপলব্ধি করেই পিতা তাঁকে নওয়াব এস্টেটের মোতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। তিনি পিতৃপ্রদত্ত ধন সম্পদ আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেন। জমিদারি পারচালনার পাশাপাশি খাজা আবদুল গনি নানা ধরনের ব্যবসাও পরিচালনা করেন। বিশেষ করে পাট ও পাটজাতদ্রব্য, চামড়া, লবণ এবং ঔষধের ব্যবসায় তিনি ক্রমাগত মুনাফা করেন। উল্লেখ্য, সমসাময়িক অন্যান্য জমিদারির তুলনায় ঢাকা নওয়াব এস্টেটে প্রজাদের খাজনা কিছুটা কম থাকায় ও খাজা আবদুল গনি তাঁর মহানুভবতা ও সদাচরণের জন্য ঢাকাবাসী ও বিশাল জামদারির প্রজাগণের নিকট অত্যন্ত প্রশংসিত ও জনপ্রিয় হন।
আবদুল গনির সময় ইংরেজদের সাথে ঢাকা নওয়াব পরিবারের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। ১৮৫৪ খ্রি. পিতার মৃত্যুর পর আবদুল গনি জমিদারির কার্যভার পুরোপুরি গ্রহণ করার তিন বছর পর ভারতে সিপাহি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই বিদ্রোহে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব বিপন্ন হয়ে পড়লেও আবদুল গনির সহায়তায় ইংরেজরা ঢাকায় পরিস্থিতি আয়ত্বে রাখতে সক্ষম হয়।
তাঁর এই উপকারের প্রতিদান স্বরূপ সরকারের কাজকর্মে তাঁর প্রভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে এবং সরকার তাঁকে নানাবিধ সুবিধা ও উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। ১৮৬১ খ্রি. খাজা আবদুল গনিকে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করা হয়। ১৮৬৬ খ্রি. বাংলার আইন সভা এবং ১৮৬৭ খ্রি. বড়লাট আইন সভার সদস্য করা হয়। ১৮৭১ খ্রি. সি.এস.আই., ১৮৭৫ খ্রি. নওয়াব উপাধি দেয়া হয়। ১৮৭৭ খ্রি. নওয়াব উপাধিটি বংশগত করা হয়। ১৮৮৬ খ্রি. কে.সি.এস.আই. এবং ১৮৯২ খ্রি. নওয়াব বাহাদুর উপাধি দেয়া হয়। ১৮৯৬ খ্রি. ৮৩ বছর বয়সে নওয়াব আবদুল গনি ইন্তেকাল করেন।
নওয়াব আবদুল গনির জ্যেষ্ঠপুত্র খাজা আহসানুল্লাহ ছিলেন একজন সমাজসেবী, দানশীল, উদার জমিদার এবং খ্যাতনামা গীতিকার ও কবি। পিতার নিকট থেকে ১৮৬৮ খ্রি. এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর যোগ্যতার সাথে তা পরিচালনা করেন। ঢাকার গোবিন্দপুর পরগনা ক্রয় করে তিনি জমিদারির আরো বিস্তৃতি ঘটান। সোনারগাঁওয়ের জনৈকা মজলিসুন্নেসার ওছিয়ত অনুযায়ী তিনি তাঁর ধন সম্পত্তির মোতাওয়াল্লী নিযুক্ত হন।
নওয়াব আহসানুল্লাহ পিতা নওয়াব আবদুল গনির পরামর্শমত এস্টেট পরিচালনা করতেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যৌথ এস্টেটের অংশীদারদের ভাতা না বাড়ানো অভিযোগ উঠে। এজন্য পরিবারের বিক্ষুব্ধ সদস্যরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে। অবশ্য অবশেষে সুহূদগণের সহায়তায় ১৮৮১ খ্রি. ২৬ আগস্ট একটি সমঝোতা চুক্তি (মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমন্টে) স্বাক্ষর হয়। এ চুক্তির অধীনে ভাতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হলেও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব ফিরে আসেনি। ব্রিটিশ সরকার নওয়াব আহসানুল্লাহকে ১৮৭১ খ্রি. খান বাহাদুর, ১৮৭৭ খ্রি. নওয়াব, ১৮৯১ খ্রি. সি.আই.ই, ১৮৯২ খ্রি. নওয়াব বাহাদুর এবং ১৮৯৭ খ্রি. কে.সি.আই.ই. খেতাব প্রদান করেন। তিনি ১৮৯০ এবং ১৮৯৯ খ্রি. বড়লাট আইন সভায় সদস্য হন। ১৯০১ খ্রি. ১৬ ডিসেম্বর তিনি পরলোক গমন করেন।
নওয়াব আহসানুল্লাহর পুত্র খাজা সলিমুল্লাহ ১৮৭১ খ্রি. ৭ জুন জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৩ খ্রি. নিজ বিবাহ নিয়ে পিতার সাথে মতবিরোধের কারণে খাজা সলিমুল্লাহ গৃহত্যাগ করে ময়মনসিংহে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নেন। ১৯০১ খ্রি. ১৬ ডিসেম্বর পিতার অকম্মাৎ মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসেন এবং ১৭ ডিসেম্বর জীবিত জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে নওয়াব উপাধিতে ভূষিত হন। নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ পিতার আমল থেকে শরিকদের সাথে সম্পত্তি নিয়ে যেসব মামলা মোকদ্দমা ছিল তা মিটিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সমাজকল্যাণমূলক কাজ ও রাজনীতিতে বেশী ব্যস্ত থাকায় তিনি এস্টেট পরিচালনায় যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারেননি। এসব কাজে অকাতরে অর্থব্যয় করতে গিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি জমিদারির ধন সম্পদের মধ্যে ভাটার সৃষ্টি করেন। ফলে ১৯০৭ খ্রি. তিনি মারোয়াড়ি ও হিন্দু মহাজনদের নিকট থেকে প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা ঋণ নিতে বাধ্য হন। এজন্য এস্টেটের শরিকগণ নওয়াবের বিরোধিতা শুরু করেন এবং নওয়াবের ছোট ভাই খাজা আতিকুল্লাহর নেতৃত্বে তাঁরা এস্টেটের সহায়-সম্পত্তি ভাগাভাগি করার দাবি তোলেন। এ সময় আয়ের তুলনায় খরচ কমাতে গিয়ে হাতিঘোড়া সব বিক্রি করে দেয়া হয়। এমতাবস্থায় নওয়াব সলিমুল্লাহ ১৯০৭ খ্রি. সেপ্টেম্বর মাসে নওয়াব এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব ওয়ারেসদারদের সম্মতিক্রমে সরকারের কোর্ট অব ওয়ার্ডসের পরিচালনায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এছাড়াও তিনি ১৯০৮ খ্রি. ৬ আগস্ট সহায়-সম্পত্তি বন্ধক রেখে ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে ১৬ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করেন।
কোর্ট অব ওয়ার্ডসের পরিচালনাধীনে গেলেও নওয়াব এস্টেটের আয় বাড়েনি। ফলে সরকারের ওই ঋণ পুরোপুরি শোধ করা সম্ভব হয়নি। পরিবারের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সমকালীন রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নানামুখী চাপের মুখে অসুস্থ্য হয়ে নওয়াব সলিমুল্লাহ ১৯১৫ খ্রি. ১৬ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন।
মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে নওয়াব সলিমুল্লাহ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র খাজা হাবিবুল্লাহকে ঢাকা নওয়াব এস্টেটের মোতাওয়াল্লী নিযুক্ত করে যান। কিন্তু নওয়াবের ছোট ভাই খাজা আতিকুল্লাহর নেতৃত্বে পরিবারের একটি অংশ তা অস্বীকার করে আদালতে মামলা করেন। তবে মামলায় তারা হেরে যান।
নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ তাঁর পূর্বপুরুষদের ন্যায় বিচক্ষণ ও অধ্যবসায়ী ছিলেন না। এজন্য পূর্ব পুরুষদের ধন সম্পদ যা অবশিষ্ট ছিল সেটা তাঁর আমলে ভাগ বাটোয়ারা ও বিক্রি হয়ে যায় ও আর্থিক টানাপোড়েনের শুরু হয়। অবশেষে জমিদারি উচ্ছেদ আইনের আওতায় ১৯৫২ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তান সরকার ঢাকা নওয়াব এস্টেট অধিগ্রহণ করে। জমিদারি উচ্ছেদের পর আহসান মঞ্জিলের ন্যায় বিশাল প্রাসাদ ভবন রক্ষণাবেক্ষণ করা উত্তরাধিকারীদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। শেষ জীবনে নওয়াব হাবিবুল্লাহ আহসান মঞ্জিল ছেড়ে পরীবাগে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন এবং সেখানে ১৯৫৮ খ্রি. ২১ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে ব্রিটিশ সরকারের দেয়া উপাধিপ্রাপ্ত ঢাকার নওয়াব পদটিরও অবসান ঘটে।
রাজনীতিতে নওয়াব পরিবার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ গঠনে নেতৃত্ব দেন। তাঁর এই রাজনৈতিক দল গঠনের পিছনে পূর্বপুরুষদের অনুরূপ ধ্যান ধারণার বিষয়টি বিবেচনায় আনা যেতে পারে। ১৮৬৩ খ্রি. নওয়াব আবদুল লতিফ-এর মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সাথে নওয়াব খাজা আবদুল গনি ও খাজা আহসানুল্লাহ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
এমনকি নওয়াব আহসানুল্লাহ ঢাকায় উক্ত সোসাইটির একটি শাখাও প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮২ খ্রি. নওয়াব আবদুল লতিফ ওই সংগঠনের কাজে ঢাকায় এলে নওয়াব আহসানুল্লাহ তাঁকে সংবর্ধনা দেন। ১৮৭৮ খ্রি. সৈয়দ আমীর আলী ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করলে ঢাকার নওয়াব তাতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের সংখ্যানুপাতে সুযোগ আদায়ের লক্ষ্যে উক্ত এ্যাসোসিয়েশন সরকারকে স্মারকলিপি দেয়ার জন্য ১৮৮৫ খ্রি. এক স্বাক্ষর অভিযান চালায়। নওয়াব আবদুল গনি এতদাঞ্চলের ৫ হাজার লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ১৮৮৫ খ্রি. নভেম্বর মাসে বঙ্গীয় সরকারের নিকট এক স্মারকলিপি পেশ করেন।
শিক্ষা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ঢাকার নওয়াব আহসানুল্লাহ ছিলেন আলীগড়ের স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ন্যায় মুসলিম স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। এজন্য তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের অনুসৃত হিন্দু-মুসলিম যুক্ত জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করেননি। তাঁর আমলে এতদাঞ্চলে কংগ্রেস বিরোধী যেসব সভা হতো তাতে নওয়াবের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। নওয়াব আহসানুল্লাহর পৃষ্ঠপোষতায় ১৮৮৮ খ্রি. ১১ নভেম্বর আহসান মঞ্জিল প্রাঙ্গনে মুসলমানদের এক সভা হয়। সভায় খাজা মো. ইউসুফজান কংগ্রেসের বিরোধিতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন এবং তাতে মুসলমানদের যোগ দিতে নিষেধ করেন। উল্লেখ্য, সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে ঢাকা নওয়াব পরিবারের একটি বিক্ষুদ্ধ অংশ আগে থেকেই নওয়াবের বিরোধিতা করে আসছিল এবং তারা ১৮৮৫ খ্রি. ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হলে তাতে যোগ দেয়। পরবর্তীকালে একই কারণে নওয়াব সলিমুল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁর ছোট ভাই খাজা আতিকুল্লাহও কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন।
ঢাকা নওয়াব এস্টেটের দায়িত্ব পাওয়ার পর খাজা সলিমুল্লাহ প্রথমে ঢাকার সমাজ জীবন উন্নয়নে সচেষ্ট হন। ১৯০৩-০৪ খ্রি. ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনার প্রেক্ষাপটে মতামত দিতে গিয়ে নওয়াব সলিমুল্লাহ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯০৪ খ্রি. ১১ জানুয়ারি আহসান মঞ্জিলে পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দ সহযোগে এক সভায় বঙ্গবিভাগের বিরোধিতা করেন। তবে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের সুবিধার্থে একজন লে. গভর্নরের অধীনে ব্যবস্থাপক পরিষদসহ ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করে একটি বৃহত্তর প্রদেশ গঠনের জন্য তিনি বিকল্প প্রস্তাব দেন।
বঙ্গবিভাগের প্রতি জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯০৪ খ্রি. পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নওয়াব সলিমুল্লাহর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার নওয়াব বাড়ির প্রাঙ্গনে ভাইসরয়কে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ওই সময় নওয়াব সলিমুল্লাহর সাথে আলোচনার ফলেই লর্ড কার্জনের বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ১৯০৫ খ্রি. ১৬ অক্টোবর বঙ্গবিভাগ কার্যকর হয়ে ‘পূর্ববঙ্গ এবং আসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশের জন্ম হয় এবং স্যার ব্যামফিল্ড ফুলারকে নতুন প্রদেশের লে. গভর্নর নিয়োগ করা হয়। কংগ্রেস দলের বিরোধিতার মুখে বঙ্গবিভাগ টিকিয়ে রাখার পক্ষে মুসলিমদের সংগঠিত করার ব্যাপারে নওয়াব সলিমুল্লাহ বড় ভূমিকা পালন করেন। নতুন প্রদেশের জন্ম দিনেই (১৯০৫ খ্রি. ১৬ অক্টোবর) তিনি নিজের সভাপতিত্বে ঢাকার নর্থব্রুক হলে পূর্ববঙ্গের নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের নিয়ে একটি সভা করে ‘মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন’ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এটাই ছিল বাঙালি মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম। নওয়াব সলিমুল্লাহ তাঁর সহযোগীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে সভা করে নতুন প্রদেশের অনুকূলে জনমত গড়তে চেষ্টা করেন। অন্যদিকে কংগ্রেসপন্থিরা এর বিরোধিতায় আন্দোলন গড়ে তোলেন। মুসলমানদের সংঘবদ্ধ করার লক্ষ্যে নওয়াব সলিমুল্লাহ ১৯০৬ খ্রি: ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক মুসলিম শিক্ষা সমিতি’ গঠন করেন। ওই সালের ১৪ এবং ১৫ এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে তাঁর সভাপতিত্বে উক্ত সমিতির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনি এর কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯০৬ খ্রি. মর্লে-মিন্টো প্রস্তাবিত শাসন সংস্কার নীতিতে মুসলমানদের স্বার্থ বিপন্ন হবার আশংকা দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগা খাঁর নেতৃত্বে উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃবর্গ ১৯০৬ খ্রি. ১ অক্টোবর সিমলায় ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে দেখা করেন। কিন্তু ওই স্মারকলিপিতে বঙ্গবিভাগ স্থায়িত্বের কথা না থাকায় এবং চোখে অস্ত্রপচারের কারণে নওয়াব সলিমুল্লাহ সিমলা ডেপুটেশনে যোগ দেননি। পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী তাতে যোগ দেন। এদিকে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকেই নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ ‘মুসলিম অল ইন্ডিয়া কনফেডারেসি’ নামে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করেন। তিনি পরিকল্পনাটি বিবেচনার জন্য নোটাকারে সিমলা ডেপুটেশনে যোগদানকারী নেতৃবৃন্দের কাছেও প্রেরণ করেন। উক্ত নেতৃবৃন্দ আলোচনা করে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য কনফারেন্সে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে স্থির করেন।
নওয়াব সলিমুল্লাহ ওই নোটগুলো বর্ধিতাকারে মতামতের জন্য ১৯০৬ খ্রি. নভেম্বরে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেন এবং সারা ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও মুসলিম সমিতিগুলোর নিকট পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। এদিকে আলীগড় নেতা নওয়াব মুহসিন-উল-মুলক কে অনুরোধ করে নওয়াব সলিমুল্লাহ সেবার ‘অল ইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স’ এর বিশতম সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। তদনুযায়ী ১৯০৬ খ্রি. ২৭, ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে উক্ত অধিবেশন বিচারপতি শরফুদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সর্বভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দসহ প্রায় দুই সহস্রাধিক ডেলিগেট যোগ দেন। এ সম্মেলনের যাবতীয় ব্যয় (ছয় লক্ষাধিক টাকা) বহন করেন নওয়াব সলিমুল্লাহ নিজে। ওই সম্মেলনের শেষ পর্বে ৩০ ডিসেম্বর নওয়াব সলিমুল্লাহ প্রণীত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের খসড়া প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য নওয়াব ওয়াকারুল মূলকের সভাপতিত্বে ডেলিগেটদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় নওয়াব সলিমুল্লাহ তাঁর দীর্ঘ ভাষণে কারণ এবং উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা পূর্বক একটি সর্বভারতীয় মুসলিম রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবটি হাকিম আজমল খাঁ সমর্থন করেন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’। স্যার সলিমুল্লাহ এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন।
১৯০৭ খ্রি. নওয়াব সলিমুল্লাহ ঢাকা, রাজশাহী, চট্রগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, পাবনা, কুমিল্লা প্রভৃতি স্থানে জনসভা করে লীগের শাখা স্থাপন করেন। ১৯০৭ খ্রি. নওয়াব সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে কলকাতায় উভয় বঙ্গের মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সভায় ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগ’ গঠিত হয় এবং তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯০৮ খ্রি. জুন মাসে তিনি পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ গঠন করেন এবং এর সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯০৮ খ্রি. ২৭ ডিসেম্বর অমৃতসরে তাঁর সভাপতিত্বে নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সমিতির ২২তম বার্ষিক সম্মেলন হয়। সেখানে ৩০-৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভায় তিনি মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবী জানান। নতুন প্রদেশের হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য তিনি উভয় সম্প্রদায়ের সম্পদশালী ও গণ্যমান্যদের নিয়ে ১৯০৯ খ্রি. ২১ মার্চ ‘Imperial league of Eastern Bengal and Asam’ গঠন করেন। ১৯০৯ খ্রি. প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পুনর্গঠন এবং এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯১১ খ্রি. ১৫ ও ১৭ মার্চ তাঁর সভাপতিত্বে আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত নেতৃবৃন্দের এক সভায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ও প্রাদেশিক শিক্ষা সমিতি উভয় সংগঠনই চলমান রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই সভায় প্রথমোক্ত সংগঠনের মাধ্যমে রাজনীতি এবং দ্বিতীয়টির মাধ্যমে শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯১১ খ্রি. ১৯ আগস্ট কার্জন হলের এক অনু্ষ্ঠানে নওয়াব সলিমুল্লাহ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। এসব প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসকে কোণঠাঁসা করা। ১৯০৫ খ্রি. সরকারের বঙ্গবিভাগ সমর্থন করায় কালক্রমে তিনি কার্যত সরকারের একজন বেসরকারী উপদেষ্টার মর্যাদা লাভ করেন।
কংগ্রেসপন্থীদের আন্দোলনের চাপে ১৯১১ খ্রি. ১২ ডিসেম্বর দিল্লীর দরবারে সম্রাট পঞ্চম জর্জ বঙ্গবিভাগ রদের কথা ঘোষণা করলে নওয়াব সলিমুল্লাহ অনিচ্ছা সত্তেও বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ এর ব্যক্তিগত পত্র পেয়ে দরবারে যোগ দিতে বাধ্য হন। ওই দরবারে তাঁকে জি.সি.আই.ই. খেতাব দেয়া হয়। তিনি ওই খেতাব গ্রহণ করলেও পরক্ষণেই তিনি সেটিকে তাঁর গলায় ফাঁসির রজ্জু সমতুল্য হিসেবে বিবৃতি দেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে দিল্লীর দরবার উপলক্ষে উপস্থিত মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেন এবং মুসলিমদের সার্বিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ৮ টি দাবী সম্বলিত একটি স্মারকলিপি ২০ ডিসেম্বর ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নিকট পেশ করেন। দাবিগুলোর মধ্যে পূর্ব বাংলার সব অভাব অভিযোগ পেশ করার জন্য এখানকার নেতৃবৃন্দকে বড়লাটের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়ার দাবিটিও ছিল অন্যতম। এ আবেদনের সুযোগ নিয়ে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি তিনদিনের জন্য ঢাকা সফরে আসেন। তাঁর সংবর্ধনার্থে নওয়াব সলিমুল্লাহ শাহবাগে এক বড় অনুষ্ঠান করেন।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ, কলকাতার ডালহৌসি ইনস্টিটিউট হলে নওয়াব সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে যুক্ত বঙ্গের নেতৃবৃন্দের এক সভা হয়। উক্ত সভায় তাঁর প্রস্তাবনায় উভয় বাংলার স্বতন্ত্র দুটো লীগকে একত্র করে ‘প্রেসিডেন্সী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয় এবং তিনি এর সভাপতি নিবার্চিত হন। ও সভায় অনুরূপ উভয় বঙ্গের মুসলিম শিক্ষা সমিতি দুটোকে একত্র করে গঠিত ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী মুসলিম এ্যাসোসিয়েশন’ এরও তিনি সভাপতি হন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ৩-৪ মার্চ, কলকাতায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভায় সভাপতির ভাষণে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতাকারীদের যুক্তিখন্ডনে স্মরণীয় বক্তৃতা দেন। ওই সভায় তিনি মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন এবং সরকারি চাকুরিতে তাঁদের সংখ্যানুপাতে কোটা ধার্যের দাবি জানান। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল, তিনি ঢাকায় ‘যুক্ত বঙ্গের মুসলিম শিক্ষা সমিতি’র সম্মেলন এবং ১৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্সী মুসলিম লীগের সম্মেলন আয়োজন করেন। এরপর থেকে কার্যত তিনি কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেন।
১৯১৫ খ্রি. ১৬ জানুয়ারি স্যার সলিমুল্লাহর মৃত্যুর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র খাজা হাবিবুল্লাহ ঢাকার খাজা পরিবারের কর্তৃত্ব ও পারিবারিক নওয়াব উপাধি ধারণ করেন। কিন্তু তিনি পূর্বপুরুষদের মত বিচক্ষণ ও বহুদর্শী ছিলেন না বিধায় এস্টেটের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেননি। ১৯১৮ সালে নওয়াব হাবিবুল্লাহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে বাঙালি পল্টন-এ যোগ দেন এবং অবৈতনিক লেফটেন্যান্ট হিসেবে মেসোপটেমিয়ার রণক্ষেত্রে যান। যুদ্ধে মুসলমানদের সমর্থন রয়েছে তা প্রমান করার জন্য এটা ছিল বৃটিশদের রাজনৈতিক চাল।
তবে আনুগত্যের রাজনীতি পরিহার করে নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ খিলাফত আন্দোলনএ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর নওয়াব বাড়ির পরিচালনায় ঢাকার করোনেশন পার্কে খিলাফত বিষয়ে এক সভা হয়। এর ক’দিন পর নওয়াব হাবিবুল্লাহর উদ্যোগে ২০ ডিসেম্বর আহসান মঞ্জিলে খিলাফত সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের এক সভা হয় এবং তাঁকে সভাপতি করে প্রথম ‘ঢাকা খিলাফত কমিটি’ গঠিত হয়। ১৯২০ সালের ২ মার্চ আহসান মঞ্জিলের এক সভার তিনি মওলানা শওকত আলী এবং আবুল কালাম আজাদকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। ওই মাসেই তিনি মীরাটে অনুষ্ঠিত খিলাফত কমিটির এক সভায় সভাপতিত্ব করেন। খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করলেও নওয়াব হাবিবুল্লাহ খোলাখুলি ব্রিটিশদের বিরোধিতা করতে চাননি। এছাড়াও শিক্ষায় মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার কথা ভেবে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বয়কট করার পক্ষপাতী ছিলেন না। ১৯২০ সালের ১২ ডিসেম্বর নর্থব্রুক হলে নওয়াব হাবিবুল্লাহর আহবানে বঙ্গীয় মুসলমান সম্মিলনীর এক বিশেষ সভা হয়। সভায় অসহযোগ আন্দোলনে স্কুল কলেজ ত্যাগের কারণে মুসলমান ছাত্রদের ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
নওয়াব হাবিবুল্লাহ ১৯১৮-১৯ সালে প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহর থেকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সভাপতি এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হন। ১৯৩৬ সালের ২৫ মে নওয়াব হাবিবুল্লাহর নেতৃত্বে কলকাতায় ‘ইউনাইটেড মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চেষ্টায় সেটা অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অঙ্গীভূত হয়। ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে মি. জিন্নাহ কর্তৃক অল ইন্ডয়া মুসলিম লীগকে পুনর্গঠিত করার লক্ষ্যে আয়োজিত কনফারেন্সে নওয়াব হাবিবুল্লাহ বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি থেকে মুসলিম লীগের ব্যবস্থাপক সভায় সদস্য ছিলেন। ১৯৩৬ সালে তিনি মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভাপতি হন।
১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির নেতা এ.কে ফজলুল হক মুসলিম লীগের সহযোগিতায় মন্ত্রিসভা গঠন করলে নওয়াব হাবিবুল্লাহ তাতে কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি মুসলমানদের সংখ্যানুপাতে চাকুরিতে নিয়োগের চেষ্টা চালান। ১৯৩৮ সালে তিনি উক্ত কেবিনেটে স্বায়ত্তশাসন ও শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী এবং ১৯৪০-৪১ সালে জনস্বাস্থ্য ও শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নির্দেশে মুসলিম লীগের সদস্যরা ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা ত্যাগ করলে তিনি অন্যান্যদের সহায়তায় দ্বিতীয় মন্ত্রী সভা গঠন করেন। নওয়াব হাবিবুল্লাহ ওই মন্ত্রীসভার কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীরূপে যোগ দেন। ফলে তিনি পাঁচ বছরের জন্য লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৪৫ খ্রি. তাঁর বিরোধিতার কারণে খাজা নাজিমউদ্দীন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ১৯৪৬ সালে পুনরায় মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় থাকাকালেও তিনি ব্যবস্থাপক সভায় সদস্য নির্বাচিত হন।
ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মানসে ১৯৩২ সালে কম্যুনাল এওয়ার্ড প্রস্তাব পাস করলে হিন্দু মহাসভা এর বিরোধিতা করে। কিন্তু নওয়াব হাবিবুল্লাহ ও মুসলিম নেতৃবৃন্দ এটাকে স্বাগত জানান। ১৯৩৫ সালের ২৪ মার্চ এতদুদ্দেশ্যে দিল্লীতে মুসলমানদের আয়োজিত কম্যুনাল এওয়ার্ডের একটি সভায় নওয়াব হাবিবুল্লাহ সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৬ খ্রি. সাধারণ নির্বাচনে তিনি ঢাকায় মুসলিম এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লীগ প্রার্থী খাজা খায়েরউদ্দিনের নিকট পরাজিত হন। তবে পাকিস্তান অর্জনের পর তিনি এর গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেষ জীবনে ভগ্নস্বাস্থ্যের দরুন নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দেন এবং পরীবাগে গ্রীণ হাউসে বসবাস করতে থাকেন।
সমাজ কল্যাণে অবদান ১৮২৬ সালে ধোলাই খালের উপর লোহারপুল নির্মাণে ঢাকার ম্যাজিজট্রেট ওয়াল্টার সাহেবের তহবিলে খাজা আলীমুল্লাহ অর্থ দান করেন। ১৮৪০ সালে শহর উন্নয়নে ম্যাজিস্ট্রেট মি. মোরল্যান্ড স্কিনার কর্তৃক ঢাকায় গঠিত প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে খাজা আলীমুল্লাহকে এর সদস্য করা হয়। এই কমিটি ঢাকা শহর পরিষ্কারের জন্য সুইপার ও গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পাকা করে এবং আরমানিটোলার ঝিলে বাঁধ দিয়ে রাস্তা তৈরী করে। নওয়াব আবদুল গনি প্রজাগণের প্রভুত অর্থ দান করেন। ১৮৫৫ সালে আবদুল গনি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির সদস্য হন এবং দীর্ঘদিন এর সাথে যুক্ত থেকে ঢাকার উন্নয়নে সহযোগিতা করেন। মামলা মোকদ্দমায় যেন প্রজারা ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেজন্য তিনি শালিসের মাধ্যমে সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করতেন। ১৮৬১ সালে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হলে তাঁর সালিশীর রায় সরকারী রায়ের হিসেবে গণ্য হতে থাকে। অনেকই সরকারি আদালতে যাওয়ার চেয়ে তাঁর সালিশীকে বেশী গুরুত্ব দিত। ১৮৬৯ সালে ঢাকা শহরে শিয়া-সুন্নী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিলে সরকার নওয়াব আবদুল গনির হস্তক্ষেপ কামনা করে। সমস্যাটি আবদুল গনি সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করেন। ১৮৮৬ সালে মিউনিসিপ্যালিটি কর বৃদ্ধির প্রস্তাব তিনি সমর্থন না করায় তাঁরই সুপারিশে সরকার সে প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়।
১৮৬৬ সালে আবদুল গনি ঢাকার বেগম বাজারে একটি লঙ্গরখানা স্থাপন করেন। সেখানে বৃদ্ধ, দুঃস্থ ও প্রতিবন্ধী নারী পুরুষকে বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া, পোষাক ও স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হতো। ১৮৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় জনগণের মধ্যে তিনি স্বল্পমূল্যে চাউল বিতরণের ব্যবস্থা করেন ও নর্থব্রুক হল, বাকল্যান্ড বাঁধ নির্মাণে তিনি বিপুল অর্থ প্রদান করেন।
ঢাকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পূর্ব থেকেই চালু থাকলেও নওয়াব গনির প্রচেষ্টায় তা পূর্ণাঙ্গতা পায়। পঞ্চায়েত প্রধান ঢাকার নওয়াবের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে প্রতিটি মহল্লায় একজন করে সরদার এবং একজন করে নায়েবে সরদার নিযুক্ত হতেন। আহসান মঞ্জিলে কিংবা সংশ্লিষ্ট মহল্লায় আয়োজিত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে নওয়াব পঞ্চায়েত সর্দারদের মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দিতেন। এটা ছিল মহল্লাবাসীদের ওপর সংশ্লিষ্ট সর্দারের সামাজিক কর্তৃত্বকে ঢাকার নওয়াব কর্তৃক স্বীকৃতি দানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। মহল্লাসমূহের কলহ বিবাদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিচারালয় ছিল নওয়াব বাড়ি বা আহসান মঞ্জিল। ইংরেজ শাসকদের অধীনে থাকলেও ঢাকা নগরীর স্থানীয় প্রশাসন বহুলাংশে ঢাকার নওয়াব কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো। ব্রিটিশ রাজত্বের পূর্বে এদেশে বিবাদ-বিসংবাদ মীমাংসার ভার স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানদের হাতে ন্যাস্ত ছিল। ব্রিটিশ প্রশাসনে পঞ্চায়েতর এই ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। নওয়াব আবদুল গনির প্রচেষ্টায় ১৮৮৮ সালে এই ক্ষমতা আবার পঞ্চায়েত প্রধানদের কাছে অনেকটা ফিরে আসে।
নওয়াব আবদুল গনি নিজোদ্যোগে শহরের উত্তরাংশে শাহবাগ বাগানবাড়ী এবং উত্তর-পূর্বাংশে কোম্পানি বাগান ও দিলখুশা বাগান বাড়ি নির্মাণ করেন। নওয়াব খেতাব পাওয়ার পর খাজা আবদুল গনি ১৮৭৬ সাল থেকে প্রতি বছর খ্রিস্টীয় নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ১ জানুয়ারি শাহবাগ বাগান বাড়িতে ঘটা করে মেলার আয়োজন করতেন। সারা দেশ থেকে লোকেরা কৃষি ও কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি এবং গবাদি পশু-পাখি এতে প্রদর্শনের জন্য নিয়ে আসতো। শ্রেষ্ঠ প্রদর্শনগুলোর জন্য নওয়াবের পক্ষ থেকে পুরস্কার দেয়া হতো। নাচ, গান, পুতুল নাচ, ম্যাজিক ও ক্রীড়া কৌতুক মেলাকে আকর্ষণীয় করে তুলতো।
ঢাকা শহর উন্নয়নে নওয়াব আবদুল গনির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ পানীয় জলের কল স্থাপন করা। ১৮৭১ সালে ওয়েলসের যুবরাজের রোগ মুক্তির খবরে আবদুল গনি ঢাকার জনসাধারণের উপকারার্থে ৫০ হাজার টাকা দানের কথা ঘোষণা করেন ও পরবর্তী সময়ে উক্ত টাকা দিয়ে ঢাকা শহরে পানীয় জলের কল স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জলের কল স্থাপনের জন্য ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক বাংলার লে. গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পলকে নিয়ে ১৮৭৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকায় আসেন। ৬ আগস্টে চাঁদনীঘাটে কলের ভিত্তিস্থাপন করেন। ১৮৭৮ সালের ২৪ মে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মি. এফ.বি পিকক কর্তৃক উক্ত জলের কল উদ্বোধন করা হয়। এর ফলে নওয়াবের ইচ্ছানুযায়ী তখন বিনামূল্যে কলের জল সরবরাহ করা হতো। দানের জন্য খাজা পরিবারের পূর্ব থেকেই একটি পৃথক তহবিল ছিল। জনকল্যাণে ৫০০ টাকার উর্ধে নওয়াব আবদুল গনি যেসব দান করেছিলেন সেগুলোর একটি তালিকা ঢাকা প্রকাশ পত্রিকা তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধীয় খবরের সাথে প্রকাশ করেছিল।
সমাজসেবী ও দানবীর হিসেবে নওয়াব আহসানুল্লাহর খ্যাতি ছিল। পুরানো পল্টন থেকে সেনানিবাস সরিয়ে নেয়ার পর নওয়াব আহসানুল্লাহ ১৮৮৮ সালে সেখানে কোম্পানির বাগিচা নামে উদ্যান তৈরী করেন এবং উদ্যানের দক্ষিণাংশের ময়দানটি খেলার করেন। জনকল্যাণে তিনি ৫০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে এতদাঞ্চলে মসজিদ, মাদ্রাসাসহ সহ অন্যান্য জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ঢাকায় শাহ নেয়ামতুল্লাহ ভুতশিকিন এবং হাইকোর্টে মাজার পুণর্নির্মাণ, সাতগম্বুজ মসজিদ, খাজা আম্বর মসজিদ সংস্কার করেন এবং সাভারের বাইগুনবাড়ী মসজিদ ও মীরপুরে শাহ আলীর দরগায় মুসফিরখানা নির্মাণ করেন। মক্কায় নহরে জুবাইদা পুনর্খননে তিনি অর্থ পাঠান। প্রতিবছর ৪০ জন লোক তাঁর দানে হজ্বে যেতেন। ১৮৭৫ খ্রি. মিটফোর্ডে হাসপাতালে মহিলা ওয়ার্ড নির্মাণে তিনি আর্থিক সহায়তা দেন। ১৮৮৮ খ্রি. বড়লাট ডাফরিন ও লেডী ডাফরিন এর ঢাকায় আসার স্মরণে তিনি মহিলাদের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতাল সংশ্রবে লনগোলায় ‘লেডী ডাফরিন মহিলা হাসপাতাল’ নির্মাণার্থে অর্থ প্রদান করেন এবং সেটা পরিচালনার্থে বার্ষিক ৫ শত টাকা ধার্য করেন।
১৮৮৪ খ্রি. নওয়াব আহসানুল্লাহ মৃত পুত্র খাজা হাফিজুল্লাহর নামে মাদারীপুরে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। ১৮৯৬ খ্রি. তিনি বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর মোহনা খনন, ১৮৯৬ খ্রি. দুর্ভিক্ষে তিনি জনসাধারণের দুর্দশা নিরসনে আর্থিক সাহায্য প্রদান এবং তাদের মধ্যে কম মূল্যে চাল বিক্রির ব্যবস্থা করেন। ১৮৯৬ খ্রি. তিনি মৃত পিতার স্মরণে বার্ষিক ৫ হাজার টাকা আয়ের জমিদারি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য দান করেন।
১৯০০ সালে তিনি মৃত স্ত্রীর স্মরণে পটুয়াখালীতে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করেন এবং সেটা পরিচালনার জন্য বার্ষিক অর্থ বরাদ্দ করেন। ১৮৯৭ খ্রি. ভুমিকম্পে ঢাকার বিধ্বস্ত হোসেনী দালান পুনঃনির্মাণ করেন। কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণে তিনি অর্থ সহায়তা দেন। নওয়াব আহসানুল্লাহ ১৮৯৮ খ্রি. ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক উন্নয়ন করেন এবং তা পরিচালনার জন্য বার্ষিক অর্থ বরাদ্দের করেন। ওই বছরই তিনি কুমিল্লায় টাউন হল, পুকুর ও রাস্তা নির্মাণে অর্থ দান করেন। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জন্মাষ্টমী মিছিলে ১৮৯৯ খ্রি. সরকার হাতি দিতে অস্বীকার করলে নওয়াব আহসানুল্লাহ প্রয়োজনীয় হাতি দিয়ে সহায়তা করেন।
ঢাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নে নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ঢাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা প্রবর্তন। নওয়াব বাহাদুর ১৯০০ সালে লক্ষাধিক অর্থ ব্যয়ে ঢাকা শহরে বিদ্যুতালোক দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তৎকালীন রেভেনিউ বোর্ডের সদস্য মি. সি বোল্টন ১৯০১ খ্রি. ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আহসান মঞ্জিলে আয়োজিত অনুষ্ঠিত এর উদ্বোধন করা হয়। ১৮৯১ খ্রি. সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নওয়াব বাড়ির খাজা মো. আজগর মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ঢাকা মিউনিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
বাল্য বিবাহ নিরোধকল্পে ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ সরকার ১২ বছর বয়সের পূর্বে সহবাস নিষিদ্ধ বিল আইন সভায় উপস্থাপন করলে এদেশে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেকে এর তীব্র বিরোধিতা করে। নওয়াব আহসানুল্লাহ তখন আলেম সমাজের নিকট থেকে ফতোয়া নিয়ে এ বিল সমর্থন করেন। ১৮৮০’র দশকে নওয়াব আহসানুল্লাহ এদেশে দেশী মদ তৈরীর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য দেশীয় জমিদারদের একতাবদ্ধ করে সরকারকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেন। সরকার একটি কমিশন গঠন করে পর্যালোচনা পূর্বক দেশি মদ নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করে। ১৮৯৮ সালে বোম্বে ও কলকাতায় প্লেগ দেখা দিলে ঢাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগ নিবারণে ঢাকার কমিশনারকে দেয়া নওয়াব আহসানুল্লাহর অর্থ দ্বারা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিয়োগসহ বিশেষ ব্যবস্থাদি নেয়া হয়। ফলে ঢাকার আশেপাশে কিছু লোক মারা গেলেও এ শহরে মহামারী দেখা দেয়নি।
ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির দ্বিতীয় মুসলিম চেয়ারম্যান (১৮৯৭) ছিলেন নওয়াববাড়ির খাজা মো. ইউসুফজান তিনি শহরের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যোন্নয়ের জন্য প্রতিদিন ময়লা পরিষ্কার করে ট্রাম গাড়ির সাহায্যে ৩/৪ মাইল দূরে ফেলা এবং মজা জলাশয় পরিষ্কারের ব্যবস্থা করেন। ১৯০৬ সালে তিনি বুড়িগঙ্গার তীরে করোনেশন পার্ক তৈরী করেন। ১৯০৫ সালে তিনি ঢাকায় একটি আধুনিক ধরনের মার্কেট তৈরীর উদ্যোগ নেন এবং ১৯১৩ সালে নওয়াব ইউসুফের নামে নয়াবাজার এলাকায় মার্কেটটি চালু করা হয়। নওয়াব আবদুল গনির দানে স্থাপিত পানীয় জলের কল উন্নয়নে ১৯০৮ সালে তিনি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং ১৯১০ সালে এর কার্যক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশী উন্নয়ন করেন। ঢাকায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণে নওয়াব ইউসুফজান একক কৃতিত্বের দাবিদার। ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত কাজটি ১৯২৩ সালে বঙ্গের গভর্নর লর্ড লিটন উদ্বোধন করেন। নওয়াবগণ ছাড়াও এ পরিবার থেকে যাঁরা ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে নেতৃত্ব দেন তাঁদের মধ্যে খাজা আমীরুল্লাহ, খাজা মো. আজগর, খাজা আবদুল করিম, খাজা নাজিমুদ্দিন, নওয়াবজাদা খাজা নসরুল্লাহ ও আহসানুল্লাহ, সৈয়দ খাজা খায়েরুদ্দিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
কর্মজীবনের শুরুতে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ ঢাকার সমাজ জীবন উন্নয়নে সচেষ্ট হন। ঢাকার পঞ্চায়েত প্রথার উন্নয়নে নওয়াব সলিমুল্লাহ ১৯০৭ সালে খাজা মোহাম্মদ আজমকে এর সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত করেন। তিনি বাইশ ও বারো পঞ্চায়েতকে একত্রিত করে ঢাকার নাগরিক জীবনে অনেকটা সংহতি আনেন। খাজা আজম ঢাকা পঞ্চায়েত প্রথার ওপর যে পুস্তক রচনা করেন সেটা ওই প্রথার একটি প্রামাণ্য দলিল। ওই সময় ঢাকার মুসলমানদের বেশীর ভাগ মামলাই পঞ্চায়েত দরবারে মীমাংসা হতো। অপক্ষোকৃত বড় বড় সমস্যা সমাধানে নওয়াব বাহাদুর কিংবা তাঁর প্রতিনিধি সংশ্লিষ্টদেরকে আহসান মঞ্জিলে একত্রিত করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পূর্বক মীমাংসা করতেন। বিচার ক্ষেত্রে নওয়াব বাড়ি থেকে প্রকাশিত রায়কে সরকারি আদালতের সমান মর্যাদা দেয়া হত।
নওয়াব সলিমুল্লাহর উৎসাহ ও উদ্দীপনায় মিলাদুন্নবী ও ফাতেহা-ই-দোয়াজ দাহমের সময় সারা ঢাকা শহর সরগম হয়ে উঠতো। নওয়াবের আর্থিক সহায়তায় এ উপলক্ষে প্রতিবছর পঞ্চায়েত সমিতিগুলো পাড়ায় পাড়ায় আলোকসজ্জা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করতো। নওয়াব সলিমুল্লাহ সমাজের ভাগ্যাহত মুসলিম সন্তানদের জন্য ১৯০৯ সালে ঢাকায় ইসলামিয়া এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা’ নামে আজও স্বগৌরবে তাঁর মহিমা প্রকাশ করছে। অর্থ দান ছাড়াও নওয়াব সলিমুল্লাহ বহু দরিদ্র ছাত্রকে স্কুল কলেজে ভর্তি ও বৃত্তির ব্যবস্থা করতেন। আশ্রয়হীনদের আশ্রয়দান তাঁর জীবনের ব্রত ছিল। নওয়াব সলিমুল্লাহ ১৯০৬ সালে ১৮ ডিসেম্বর ব্যবস্থাপক সভায় একটি বিল উত্থাপন করে বারবনিতা নিযন্ত্রণ আইন পাশ করার ব্যবস্থা করেন। ফলে ভদ্রপল্লী থেকে নিরাপদ দূরত্বে পতিতালয় সড়িয়ে নিতে মালিকদের বাধ্য করা হয়। শেখ গোলাম নবী কর্তৃক ১৮১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের কদম রসুল সংস্কার বিষয়ক শিলালিপিটি জনৈক খাদেম লুট করে নিয়ে দোয়া তাবিজের কাজে ব্যবহার করতো। নওয়াব সলিমুল্লাহ সেটা উদ্ধার করে ঢাকা জাদুঘরে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ঢাকার জিরোপয়েন্টের পাশে অবস্থিত পীর ইয়ামেনীর কবরের উপর গম্বুজযুক্ত অষ্টকোণ সমাধিসৌধ নির্মাণ করে দেন। ১৯১০ সালে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে নওয়াব সলিমুল্লাহ একটি চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরী করে দেন।
এক সময় ঢাকার শিল্পকর্মের ভারত জোড়া খ্যাতি ছিল। কিন্তু ঢাকার অবনতির সাথে ঐসব শিল্পের দুর্দিন শুরু হয়। নওয়াব আহসানুল্লাহ ঢাকার কারুশিল্পীদের দ্বারা তারজালি কাজের যেসব অমূল্য দ্রব্যাদি তৈরী করিয়েছিলেন তন্মধ্যে হোসেনী দালান ও আহসান মঞ্জিলের মডেল উল্লেখযোগ্য। তিনি সিলেটের শিল্পীদের দ্বারা হাতির দাঁতের যে পাটি তৈরী করান তা উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ নমুনা। নওয়াব সলিমুল্লাহ কারুশিল্প উন্নয়নের জন্য শিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করেন এবং বহুবার প্রদর্শনী আয়োজন করে ব্রিটিশ রাজপুরুষদের এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর চেষ্টায় ১৯০৯ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকার কারুশিল্পের উন্নয়নে একটি কমিটি গঠন করেন এবং তিনি ওই কমিটির সদস্য হন। তাঁর উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম রঙিন ও জরির কাজযুক্ত জামদানি তৈরী হয়। তাঁর প্রচেষ্টায় ভিন্ন ভিন্ন রঙের জমিনের উপর বিভিন্ন রঙের বুটি, ফুল ও অন্যান্য নক্শায় সজ্জিত হয়ে মৃতপ্রায় জামদানি পুনরায় জনপ্রিয়তা লাভ করে।
নওয়াব হাবিবুল্লাহ এস্টেটের ওয়াফকৃত সম্পত্তি থেকে প্রতি বছর ৬৫ হাজার টাকা ধর্মীয় ও সেবামূলক কাজে দান করতেন। তাঁর দানে ১৯২০ সালে ‘ঢাকা মুসলিম শিক্ষা সমিতি’ গঠিত হয়। উদারমনা হলেও অর্থকষ্টের দরুন নওয়াব হাবিবুল্লাহ দান কাজে পরাকাষ্ঠা দেখতে পারেননি। তবে তাঁর আমলে নওয়াব পরিবারের অন্যরা প্রচুর দান করতেন। খান বাহাদুর খাজা মোহা. আজম ১৯১১ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক সহায়তা দেন। ১৯১৬ খ্রি. তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় এবং ঢাকা জাদুঘরে বই কেনার জন্য অর্থ প্রদান করেন। নওয়াব পরিবারের মহিলারাও জনসেবামূলক কাজে পিছিয়ে ছিলেন না।
শিক্ষায় অবদান এদেশে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে ঢাকার নওয়াবদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তৎকালে মুসলিমরা ধর্মবিরোধী ও বিজাতীয় শিক্ষা ভেবে ইংরেজি ও পশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষা থেকে দূরে থাকতো। কিন্তু ঢাকার নওয়াবগণ নিজেরা ইংরেজি শিক্ষা করেছেন এবং দেশবাসীর মধ্যে ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করেছেন। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ ছিল তাঁদের শিক্ষা দর্শন। এজন্য মক্তব-মাদ্রাসার পাশাপাশি তাঁরা স্কুল-কলেজ স্থাপনেও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
১৮৬৩ সালে খাজা আবদুল গনি ঢাকার কুমারটুলিতে নিজের নামে একটি হাই স্কুল খোলেন। সেখানে সরকারি রেজিস্ট্রেশন নিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের বিনা বেতনে প্রচলিত মানের লেখাপড়া করানো হতো। ১৯০৭ সাল পর্যন্ত গনিজ হাই স্কুল থেকে ছাত্রদের প্রবেশিকা পাশের তথ্য জানা যায়। আলীগড় কলেজ স্থাপনে ও উন্নয়নে তাঁর উল্লেযোগ্য অবদান রয়েছে। ধর্মীয় ও সামাজিক মানসিকতার কারণে মুসলিম অভিভাবকেরা ইংরেজি স্কুলে ছাত্র ভর্তি করতে চাইতো না। এজন্যে ঢাকায় একটি এ্যাংলো-এ্যারাবিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকল্পে ১৮৭১ সালে খাজা আবদুল গনি সরকারের নিকট আবেদন জানাতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে তিনি উক্ত মাদ্রাসার জন্য জমি কিনে দেন। এ মাদ্রাসার প্রথম অধ্যক্ষ মওলানা উবায়দুল্লাহ সুহরাওয়ার্দীকে নওয়াব গনি নিয়মিত ভাতা দিতেন। টাঙ্গাইলের জামুর্কিতে নওয়াব আবদুল গনি নিজের নামে আরেকটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নওয়াব এস্টেট থেকে দেয়া বার্ষিক অনুদানে স্কুলটি চলতো। পরবর্তী সময়ে স্কুলটির ব্যাপক উন্নতি ঘটে।
নওয়াব আহসানুল্লাহ তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত হাই স্কুলে প্রতি সোমবার তিনি নিজে গিয়ে ছাত্রদের পড়াশুনা পরীক্ষা করতেন। তিনি গনি স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস ছাত্রদের ২০০ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন। ১৮৮০ সালে ওই স্কুল থেকে পাসকৃত আফসার উদ্দিনকে তিনি ৫০০ টাকা পুরস্কার দেন। ঢাকা মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির তিনি সদস্য ছিলেন এবং এর জন্য নতুন ভবন নির্মাণার্থে ১৮৮০ সালে টাকা দান করেন। এ মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য দেয়া বৃত্তিগুলোর মধ্যে অন্তত ৪ টি ঢাকা নওয়াব এস্টেট থেকে দেয়া হতো এবং তিনি তাদের জন্য ‘হাফেজ আবদুর রহমান প্রাইজ ফান্ড’ নামে বার্ষিক ১০০ টাকার একটি তহবিল চালাতেন। ঢাকা মাদ্রাসার সুপার মওলানা উবায়দী জনকল্যাণে ’সমাজ সম্মিলনী’ নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করলে নওয়াব আহসানুল্লাহ তাতে তিন শত টাকা দেন এবং পৃষ্ঠপোষক হন। ১৮৭০ সালে নবকান্ত চট্টোপ্যাধায় প্রতিষ্ঠিত অন্তঃপুর স্ত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি টাকা দান করেন। ১৮৮২ সালে সৈয়দ আমীর আলীর প্রতিষ্ঠিত রিপন বৃত্তি ফান্ডে তিনি টাকা দেন। এছাড়া ভিক্টোরিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে ও ইডেন বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য টাকা দেন। কলকাতার বেথুন কলেজ-এ মুসলিম বালিকাদের ভর্তি নিত না বিধায় তাদের জন্য পৃথক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য গঠিত ফান্ডে ১৮৯৬ সালে তিনি টাকা দেন। ঢাকায় ফুলার ছাত্রাবাসের জন্য তিনি ভূমি দান করেন। মৃত পুত্র খাজা হাফিজুল্লাহর নামে মাদারীপুরে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণে তিনি যাবতীয় ব্যয় বহন করেন। এদেশের ছাত্রদের যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষা দেয়ার মানসে ঢাকায় একটি ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯০১ সালে নওয়াব আহসানুল্লাহ প্রয়োজনীয় অর্থ দানের প্রতিশ্রুতি দেন যা পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়িত হয়।
কর্মজীবনের শুরুতেই নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ গণশিক্ষা বিস্তারের জন্য ঢাকার মহল্লাসমূহে এস্টেটের খরচে নৈশ স্কুল চালু করেন। পিতার প্রতিশ্রুত ঢাকা আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯০২ সালে তিনি সরকারের নিকট ১ লক্ষ ১২ হাজার টাকা দান করেন। প্রতিষ্ঠানটি কালক্রমে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। আবদুল গনি হাই স্কুল ও ঢাকা মাদ্রাসা থেকে পাস করে উক্ত ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে ভর্তি হতে পারা ছাত্রদের মধ্যে অন্তত ৪ জনকে তিনি বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করেন। ১৯০৯ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মুসলিম এতিমখানার ছাত্রদের তিনি হাম্মাদিয়া মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। মুসলিমদের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য নওয়াব সলিমুল্লাহ ১৯০৬ সালে ১৪ ও ১৫ এপ্রিল শাহবাগ বাগানবাড়িতে সম্মেলন করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম মুসলিম শিক্ষা সমিতি’ গঠন করেন। এর মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত পাঠ্য পুস্তক মুসলমান ছাত্রদের পাঠোপযোগী সংস্কার করা এবং মুসলিম শিক্ষক ও পরিদর্শক বেশী করে নিয়োগের সফল চেষ্টা করেন। এ সমিতির গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের জন্য ১৯০৯ সালে জনশিক্ষা পরিচালক হেনরি শার্প-এর নেতৃত্বে নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী, মওলানা ওয়াহিদকে প্রধান সদস্য করে সরকার একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির সুপারিশের আলোকে সরকার আধুনিক সিলেবাস দিয়ে রিফরমড ও নিউস্কিম মাদ্রাসা চালু করে। কালক্রমে পদ্ধতিটির উন্নয়ন হয়ে হাই মাদ্রাসা এবং পরিশেষে আলিয়া মাদ্রাসার রূপ পরিগ্রহ করে। মাদ্রাসা পাস ছাত্ররা যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে সেজন্য নওয়াব সলিমুল্লাহ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে সিলেবাস প্রণয়নে সহায়তা করেন। আলীগড় কলেজ হোস্টেলের ন্যায় ঢাকা কলেজের সংশ্রবে একটি মোহামেডান হল নির্মাণের জন্য ১৯০৬ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহ প্রাদেশিক শিক্ষা সমিতির সম্মেলনে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং এজন্য ১,৮৬,৯০০ টাকা দানের কথা ঘোষণা করেন। ১৯১২ সালের ২১ মার্চ ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে লে. গভর্নর লর্ড বেইলী মোহামেডান হলের ভিত্তি স্থাপন করেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর হলটি এর অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ১৯২৭ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল নির্মাণের মাধ্যমে নওয়াবের স্বপ্ন বাস্তবতা পায়। বরিশালে বেল ইসলামিয়া বোর্ডিং নির্মাণে নওয়াব সলিমুল্লাহ হেমায়েত উদ্দিন আহমদকে অর্থ সাহায্য করেন। ১৯০৮ সালে পূর্ববঙ্গ আইন সভায় নওয়াব সলিমুল্লাহ এদেশে সর্বপ্রথম বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানান। উল্লেখ্য, খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯২২-২৯ সালে ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালে ঢাকায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন এবং ১৯২৯ সালে অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী হয়ে এদেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বিল পাস করেন।
১৯০৩ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহ কুমিল্লার নবীনগর উচ্চ বিদ্যালয়, মুরাদনগর হাইস্কুল এবং ১৯০৪ সালে ময়মনসিংহে মুসলমান ছাত্রাবাসের জন্য অর্থ প্রদান করেন। ১৯০৮ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকার কর্তৃক নারী শিক্ষা উন্নয়নে রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে গঠিন কমিটিতে নওয়াব সলিমুল্লাহ সদস্য ছিলেন। এছাড়া ওই বছরই গঠিত মুসলিম নারী শিক্ষা বিষয়ক সাব কমিটির তিনি সভাপতি নিযুক্ত হন। মুসলমান সমাজে নারী শিক্ষা বিস্তারের সম্ভাবনা এবং এর সম্ভাব্য পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে এই সাব কমিটি বিবেচনা করে। এছাড়া স্কুলে শিক্ষিকার সংখ্যা বৃদ্ধি, ছাত্রী বৃত্তি ও সরকারী ব্যয়ে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনসহ ছাত্রীদের জন্য হোস্টেল নির্মাণের সুপারিশ করে যা সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নওয়াব সলিমুল্লাহর বিশেষ অবদান রয়েছে। বঙ্গ বিভাগ রদের পর পূর্ববঙ্গের অবস্থা পরিদর্শনে ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারী বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে এলে ৩১ জানুয়ারি নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯ জন শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতা নওয়াবের শাহবাগ বাগানবাড়ীতে বড়লাটের সাথে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করে বিভিন্ন দাবী পেশ করার পরিপ্রেক্ষিতে বড়লাট ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিমদের জন্য বিশেষ শিক্ষা অফিসার নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন এবং নওয়াব সলিমুল্লাহ ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় তা বাস্তবায়িত হয়। নওয়াব আবদুল গনির দানে প্রতিষ্ঠিত হাই স্কুলকে নওয়াব সলিমুল্লাহ কলেজ উন্নয়নের চেষ্টা করেন। ঢাকা মাদ্রাসায় ডাফরিন ছাত্রাবাস নির্মাণে তিনি আর্থিক সহায়তা দেন। ১৯০৬ সালে ঢাকা মাদ্রাসায় ছাত্র শিক্ষকগণ তাঁর পরামর্শে মুসলিম ইনস্টিটিউট নামে একটি সমিতি গঠন করেন যাতে তিনি বার্ষিক ৪০০ টাকা দিতেন। ১৯১১ সালে তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম মাদ্রাসার জন্য অধিক হারে অর্থ বরাদ্দের জন্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভায় দাবি তোলেন।
১৯০৮ সালে তাঁকে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের একজন পরিদর্শক নিযুক্ত করা হয়। ১৯০৪ সালে তিনি মাদারীপুরে তাঁর বড় ভাইয়ের নামে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার মাসিক অর্থ দান বাড়িয়ে ২৫ টাকার স্থলে ৩০ টাকা করে দেন। নেত্রকোণা মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণার্থে ও ১৯০৩ সালে টাঙ্গাইলের জামুর্কি কাচারী পরিদর্শনকালে সেখানের হাসপাতাল ও স্কুল উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থ দেন। ১৯০২ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহর আর্থিক সহায়তায় জনৈক মো. হালিম বিক্রমপুর দিঘির পাড়ে ‘ছলিমিয়া মাদ্রাসা’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০২ সালে ৭ আগস্ট বরিশাল জমিদারি পরিদর্শনকালে তিনি সেখানে মুসলিম ছাত্রাবাসের জন্য ও ১৯০৩ সালে কুমিল্লার মুরাদনগর স্কুল পাঠাগারের জন্য অর্থ প্রদান করেন।
১৯০৯ সালে কলকাতা মাদ্রাসাকে কলেজে উন্নীত করাসহ তথায় একটি ছাত্রাবাস নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হলে নওয়াব সলিমুল্লাহ তাতে টাকা দান করেন ও ১৯১১ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকল্পে ঢাকা থেকে চাঁদা আদায়ের ব্যবস্থা করেন এবং নিজে তাতে অর্থ প্রদান করেন। ১৯১২ খ্রি. লালবাগ মাদ্রাসা পরিদর্শনকালে ও ১৯১৪ সালে ঢাকা চৌবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় নির্মাণে অর্থ সাহায্য দেন। এছাড়াও তিনি অনেক দরিদ্র ছাত্রকে স্কুল কলেজে ভর্তি ও বৃত্তির ব্যবস্থা করেন।
অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মধ্যে থেকেও নওয়াব হাবিবুল্লাহ শিক্ষা বিস্তারে প্রচুর দান করেন। দরিদ্র মুসলিম ছাত্রদের সাহায্যার্থে তাঁর দানে ১৯২০ সালে ‘ঢাকা মুসলমান শিক্ষা সমিতি’ গঠিত হয় এবং তিনি তাতে নিয়মিত চাঁদা দিতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে জনৈক আবদুল হাকিম সিনিয়র র্যাংলার হওয়ার জন্য কেমব্রিজে ভর্তি হতে গেলে তিনি বার্ষিক ২শত টাকা বৃত্তি দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম হলের ছাত্রদের জন্য নওয়াব হাবিবুল্লাহ বার্ষিক ৩ হাজার টাকা বৃত্তি দিতেন। ১৯২৯ খ্রি. সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের দিনে উক্ত হলের মেধাবী ছাত্রদের জন্য সলিমুল্লাহ মেমোরিয়াল ফান্ড গঠনে তিনি ১০ হাজার টাকা দান করেন। ঢাকা নওয়াববাড়ি এলাকায় স্থাপিত নওয়াব হাবিবুল্লাহ স্কুল, উত্তরার আজমপুরে স্থাপিত নওয়াব হাবিবুল্লাহ স্কুল-কলেজ এবং সাভারের সাদুল্লাপুরে স্থাপিত নওয়াব হাবিবুল্লাহ হাই স্কুল নির্মাণ ও উন্নয়নে তিনি অর্থ দেন। ঢাকার টিপু সুলতান রোডে স্থাপিত নওয়াব সলিমুল্লাহ কলেজ উন্নয়নে তিনি ১৯৩৬ সালে টাকা দেন। নওয়াবজাদী আখতার বানু ১৯২৪ খ্রি. টিকাটুলিতে তাঁর মা কামরুন্নেসার নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের জন্য ভূমিদান করেন এবং ১৯৪০ এর দশকে স্কুলটির উন্নয়নে লক্ষাধিক টাকা দেন। ১৯৪৭ সালে খাজা নাজিমউদ্দিন স্কুলটির সরকারিকরণ করেন যা ছিল এতদাঞ্চলের প্রথম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
সংস্কৃতি চর্চায় অবদান খাজা আলীমুল্লাহর আমলে ঢাকার খাজা পরিবারে নাচ-গান অনুপ্রবেশ করে। তাঁর সময় বিয়ে-শাদী ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে গায়ক-গায়িকা এবং বাইজীদের আনা হতো। আবদুল গনির আমলে খাজা পরিবারের সাথে গান-বাজনার সস্পৃক্ততা বেড়ে যায়। তিনি বেনারস, ফররোখাবাদ, রামপুর, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি থেকে উস্তাদ, বাইজীদের এনে নাচ-গান উপভোগ করতেন। ১৮৭৬ সাল থেকে খ্রিস্টীয় নববর্ষ উপলক্ষে তিনি শাহবাগে যে মেলার আয়োজন করতেন তাতে নিজ ব্যয়ে নৃত্য-গীত, ম্যাজিক ও ক্রীড়া কৌতুকের ব্যবস্থা করতেন।
নওয়াব আহসানুল্লাহ নিজেই একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। রাগ-রাগিনীতে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল এবং তিনি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। তিনি অসংখ্য ঠমুরি রচনা করে গেছেন। তাঁর রচিত নাত ঢাকায় মিলাদ মাহফিলে গাওয়া হতো। কুল্লিয়াতে শাহীন নামে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থে ফারসি, উর্দু গজল এবং হিন্দি গীত ছিল। এদেশের ঐতিহ্যবাহী বসন্তোৎসব উপলক্ষে গাওয়া হোলি গানের তিনি বড় সমঝদার ছিলেন এবং নিজেও অনেক হোলি গান রচনা করেছেন।
দেশবাসীর মধ্যে সঙ্গীত প্রসারের জন্য নওয়াব আহসানুল্লাহ ঢাকা সঙ্গীত বিদ্যালয় পরিচালনার্থে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন। পুত্র খাজা আতিকুল্লাহকে গান-বাজনা শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং খাজা আতিকুল্লাহ নিজে বেহালা বাজাতেন। নওয়াব পরিবারের খাজা আতিকুল্লাহ শাহজাদা শায়দা একজন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ ছিলেন। তিনি অনেকগুলো রাগরাগিনী সৃষ্টি করেন।
এদেশে নাট্য চর্চায় ঢাকার নওয়াবদের বিশেষ অবদান রয়েছে। নওয়াব আবদুল গনি কলকাতা ও মুম্বাই থেকে নাট্যদল এনে ঢাকায় নাটক দেখানোর ব্যবস্থা করতেন এবং অনেক সময় তাঁর ব্যান্ডপার্টি দিয়ে সাহায্য করতেন। তৎকালে ঢাকার নাটকগুলোতে পুরুষেরা মহিলা সেজে অভিনয় করতো। ১৮৭৯ সালে কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটার প্রথম মহিলা এনে অভিনয় করাতে গেলে প্রাচীনপন্থীরা রুষ্ট হয়। কিন্তু নওয়াব আবদুল গনি মহিলাদের অভিনয়কে সমর্থন করেন। ঢাকার নাটকঘরটি জগন্নাথ কলেজ ও ব্রাহ্মসমাজ গৃহের পাশে থাকায় তারা এক সময় আপত্তি তোলে। এমতাবস্থায় সংস্কৃতিমনা নওয়াব আহসানুল্লাহ কুমারটুলিতে তাঁর বরফের কলের পাশে একটি ঘরকে একাজে ব্যবহার করতে দেন। নওয়াবের নিকটাত্মীয় ঢাকা মাদ্রাসার ইংরেজি শিক্ষক আহমদ হুসাইন ওয়ফির ১৮৮০ সালে বিখ্যাত উর্দু নাটক ‘বিমার বুলবুল’ রচনা করেন। নওয়াব আহসানুল্লাহ নিজেও কয়েকটি উর্দু নাটক রচনা করেন। নাটকগুলো নওয়াববাড়ি এলাকায় নির্মিত মঞ্চে অভিনয় করিয়ে তিনি পরিবার ও ঢাকাবাসীকে দেখানোর ব্যবস্থা করতেন। ১৮৯৫ সালে কলকাতা থেকে বিখ্যাত স্টার থিয়েটার এনে তিনি নওয়াববাড়ির ওই মঞ্চে অভিনয় করিয়ে মহিলাসহ সারা ঢাকা শহরের গণ্যমান্যদের দেখানোর ব্যবস্থা করেন। ১৮৯৮ সালে ব্রেডফোর্ড সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি ঢাকায় বায়োস্কোপ দেখতে এলে নওয়াব আহসানুল্লাহ তাদের নওয়াববাড়িতে এনে পরিবার এবং শহরবাসীর বায়োস্কোপ দেখানোর বিশেষ ব্যবস্থা করেন। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় নওয়াবগণ এবং এ পরিবারের অন্যান্য প্রভাবশালীরা ঢাকায় বায়োস্কোপ দেখানোর ব্যবস্থা করতেন বলে জানা যায়। ১৯০৩ ও ১৯০৪ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহ অন্তঃপুরবাসিনীদের দেখানোর জন্য পার্সী থিয়েটার কোম্পানিকে দিয়ে শাহবাগে অভিনয় করানোর ব্যবস্থা করেন। ১৯০৯ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা সরস্বতী পুজা উপলক্ষে পদ্মিনী নাটকের আয়োজন করে। কিন্তু তাতে মুসলিমদের জন্য কিছু আপত্তিকর দৃশ্য থাকায় তারা বাঁধা দেয়। এমতাবস্থায় নওয়াব সলিমুল্লাহ আপত্তিকর দৃশ্যগুলো বাদ দিয়ে অভিনয় করতে মত দেন।
নওয়াব হাবিবুল্লাহর আমলে খাজা পরিবারের কিছু সংস্কৃতিমনা সদস্য নিজেরাই নাটকে অভিনয় শুরু করে। আহসান মঞ্জিলের দরবারগৃহে মঞ্চ সাজিয়ে তারা অভিনয়ের আয়োজন করতেন। উর্দু ভাষায় রচিত নাটকে ছেলেরাই মেয়ে সেজে অভিনয় করতো। ওই সব নাটকে সাধারণত নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ নায়ক এবং খাজা শরফুদ্দিন মেয়ে সেজে নায়িকার অভিনয় করতেন। খাজা ইসমাইল বাবা কিংবা মুরুববীর চরিত্রে এবং নওয়াবজাদা আলীমুল্লাহ খল চরিত্রে অভিনয় করতেন।
এ সময়ে নওয়াব পরিবারের খাজা আজাদ, খাজা আজমল, খাজা জহির প্রমুখ তরুণেরা মুভি ক্যামেরা চালানোর কাজ শেখেন। বিভিন্ন সময় আহসান মঞ্জিলে আয়োজিত নাট্যানুষ্ঠানকে তাঁরা ক্যামেরা বন্দী করতেন। এভাবে ছবি তোলার শখ তাদেরকে চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এজন্য ১৯২০ এর দশকের শেষ দিকে তাঁরা তৈরী করে বাংলাদেশের প্রথম চলচিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটি’। প্রথমে তাঁরা পরীক্ষামূলকভাবে তৈরী করেন ‘সুকুমারী’ নামে স্বল্প দৈর্ঘ্যের একটি ছবি। এ ছবির সাফল্য তাদেরকে ‘শেষ চুম্বন’ নামে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ চলচিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ ছবিতে নায়ক ছিলেন প্রথম দিকে খাজা নসরুল্লাহ পরে কাজী জালালুদ্দিন ও খাজা আজমল।
চিত্রগ্রাহক ছিলেন খাজা আজাদ ও খাজা আজমল। নায়িকা ছিলেন লোলিটা এবং অন্যান্য অভিনেত্রীর মধ্যে চারুবালা, দেববালা ও হরিমতির নাম জানা যায় যারা সবাই ছিল বাইজী। ১৯২৯ সালে শেষ চুম্বন ছবির সুটিং শুরু হয় এবং নওয়াবদের শাহবাগ, দিলখুশা, পরিবাগ প্রভৃতি বাগান বাড়িতে শুটিং শেষে ১২ রিলের নির্বাক ছবিটি ১৯৩১ সালে মুক্তি পায়। ১৮৪৪ সালে কলকাতায় প্রথম ফটোগ্রাফি চর্চা শুরু হয়। নওয়াব পরিবারের খাজা আলীমুল্লাহর (মৃত্যু ১৮৫৪) প্রতিকৃতিকেই এতদাঞ্চলের প্রাচীনতম আলোকচিত্র বলে জানা যায়। সংস্কৃতিমনা নওয়াব আহসানুল্লাহ সেকালের সেরা জাতের ক্যামেরা কিনে নিজ হাতে আলোকচিত্র তুলতেন। উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা, পুরাকীর্তি ও প্রাকৃতিক দৃশ্যেকে তিনি ক্যামেরাবন্দী করতেন। বিভিন্ন সময় উচ্চ পদস্থ রাজকর্মচারী ঢাকায় এলে তিনি তাঁদের ছবি তুলতেন। ১৮৯৪ সালের ৬ এপ্রিল সংঘটিত পুর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের তিনি অনেকগুলো চিত্র ধারণ করেন। ১৮৮৮ সালে টর্নেডোয় ক্ষতিগ্রস্থ নওয়াববাড়িসহ ঢাকা শহরের অনেক স্থানের দৃশ্য তিনি ধারণ করেছিলেন। এছাড়া তৎকালীন বুড়িগঙ্গা তীরের দৃশ্যসহ ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় থাকা উল্লেখযোগ্য স্থান ও প্রাচীন কীর্তির যে ছবি তিনি তুলেছিলেন তা এখন মূল্যবান প্রামাণ্যচিত্র বলে বিবেচিত।
১৮৫৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ফটোগ্রাফি সোসাইটির পরিচালক মন্ডলীর মধ্যে নওয়াব আহসানুল্লাহ একমাত্র ভারতীয় সদস্য ছিলেন। নওয়াব সলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় জার্মান ফটোগ্রাফার মি. ফ্রিৎজ কাপ ঢাকায় একটি স্টুডিও তৈরী করে ফটোগ্রাফি চর্চা করতেন। ১৯০৪ সালে তাঁর তোলা আহসান মঞ্জিল ও ঢাকার নওয়াব সংশ্লিষ্ট চিত্রগুলো ইতিহাসের খুবই মূল্যবান উপাদান। নওয়াব সলিমুল্লাহও কলকাতা কেন্দ্রিক ফটোগ্রাফি সোসাইটির সদস্য ছিলেন। নওয়াব পরিবারের খাজা সুলেমান কাদর একজন ভাল ফটোগ্রাফার ছিলেন। নিজের ক্যামেরায় ছবি তুলে তিনি নিজস্ব ল্যাবরেটরিতেই তা প্রিন্ট করতেন বলে জানা যায়।
নওয়াব আহসানুল্লাহর কন্যা নওয়াবজাদী মেহেরবানু একজন অসাধারণ চিত্রশিল্পী ছিলেন। ব্যক্তিগত উদ্যম, নিরলস শ্রম ও মেধার গুণে তিনি এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। কলকাতার মোসলেম ভারত পত্রিকায় ১৯২০ সালে শ্রাবণ সংখ্যায় তাঁর আঁকা দুটো রঙিন ছবি ছাপা হয়েছিল। ছবি দুটোর একটির অন্তর্নিহিত ভাব থেকে কবি নজরুল তাঁর বিখ্যাত ‘খেয়া পারের তরণী’ কবিতাটি লিখেছিলেন।
ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদান ঢাকায় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা আয়োজনে খাজা আলীমুল্লাহ তাঁর রমনার মাঠ ব্যবহার উপযোগী করতে ইংরেজদের সহায়তা করেন। ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের তিনি মূল্যবান ট্রফি উপহার দিতেন এবং এতে অংশ নিতে আগত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মানে নৈশভোজ ও নাচ গানের আয়োজন করতেন। এ ব্যবস্থাদি নওয়াব আবদুল গনি ও আহসানুল্লাহর আমল পর্যন্ত চালু ছিল। নওয়াব আবদুল গনি ঢাকা ও কলকাতায় ঘোড়দৌড়ের জন্য উন্নতমানের ঘোড়া পালতেন এবং ঢাকার রেসে অনেক সময় নিজেরাও অংশ নিতেন। ১৮৯০ এর দশকে ঢাকার ঘোড়দৌড়ে ‘নওয়াব আহসানুল্লাহ পার্স’ নামে একটি মূল্যবান ট্রফি দান করা হয়। ১৮৯১ খ্রি. নওয়াব আহসানুল্লাহর বাষিক অনুদানে ঢাকা মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য ‘ঢাকা স্পোর্টিং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠি হয়।
১৮৯৪ সালের ১৯ জানুয়ারিতে বাংলার মুসলমানদের আধুনিক ক্রীড়া বিষয়ক সফল প্রতিষ্ঠান কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠাকালে নওয়াব আহসানুল্লাহ অর্থ সাহায্য করেন। নওয়াব পরিবারের অর্থানুকূল্যে ক্লাবটি ১৮৯৭ সালে ‘নওয়াব আহসানুল্লাহ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’ প্রবর্তন করে। কলকাতা মোহামেডানের অনুকরণে নওয়াব আহসানুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৯৯ সালে ঢাকায় ‘মোহামেডান ইউনিয়ন স্পোর্টিং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ক্লাবের সভাপতি হন খাজা মোহা. ইউসুফজান। ক্লাবটি পূর্ব বঙ্গে আধুনিক ক্রীড়া অনুশীলন, প্রদর্শন ও প্রচলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত খাজা নাজিমউদ্দিন ছিলেন এর প্রেসিডেন্ট এবং খাজা নূরুদ্দিন ছিলেন সেক্রেটারি। ১৯৩৬ সালে দলটি আই.এফ.এ শিল্ড জয় করে। নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ পরিবারের ক্রীড়ামোদী সদস্যদের নিয়ে ১৯০৭ সালে নিজে সভাপতি হয়ে ‘নওয়াব ইউনিয়ন ক্লাব’ নামে একটি হকি দল গঠন করেন। মি. ওয়াটসন নামে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জনৈক সার্জেন্টকে তিনি এ দলের কোচ নিয়োগ করেন এবং ছোট ভাই খাজা আতিকুল্লাহকে এর সাংগঠনিক কাজ দেন। এ দলের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালে নওয়াব পরিবারের ভেতরেই অন্তত ৪ টি হকি দল আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়াও ঢাকার ক্রীড়ামোদীদের দ্বারা বেশ কটি হকি দল গড়ে ওঠে, যথা-ওয়ারী ক্লাব, ভিক্টোরিয়া ক্লাব, ওয়ান্ডার্স ক্লাব, ঢাকা কলেজ ক্লাব প্রভৃতি। নওয়াববাড়ির ব্যাসেলর্স ইউনিয়ন ক্লাব বহুদিন যাবৎ পূর্ববাংলায় সর্বাপেক্ষা নামকরা হকি দল হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯১২ সালে নওয়াবজাদা অকিতুল্লাহর দানে আতিকুল্লাহ কাপ নামে একটি হকি টুর্নামেন্ট শুরু হয় এবং পাকিস্তান আমল পর্যন্ত সেটা চালু ছিল। পরবর্তীকালে হকি সংগঠকদের মধ্যে খাজা ইব্রাহিম ১৯৪৪ সালে ব্যাচেলর্স ক্লাবকে নিয়ে কলকাতায় ব্যাটন কাপে পুনরায় অংশ নিতে সক্ষম হয়। ওই খেলায় অংশগ্রহণকারী খাজা ইউসুফ রেজা ১৯৫২ সালে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের অধিনায়কত্ব করেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় হকি দলের কোচ হয়েছিলেন এবং ১৯৭৯ সালে সরকার তাঁকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রদান করে। [মো. আলমগীর]
গ্রন্থপঞ্জি মুন্সী রহমান আলী তায়েশ, তাওয়ারিখে ঢাকা, (ড. শরফুদ্দিনের বঙ্গানুবাদ) ঢাকা, ১৯৮৫; আব্দুর রহিম সাবা, তারিখে কাশ্মিরীয়ানে ঢাকা, ফারসি পা-ুলিপি (অপ্রকাশিত); ড. মুহম্মদ আবদুল্লাহ, নওয়াব সলিমুল্লাহ জীবন ও কর্ম, ঢাকা, ১৯৮৬; ড. মো: আলমগীর, 'বাংলার মুসলিমদের সমাজ জীবনে ঢাকার নওয়াব পরিবারের অবদান', পি-এইচ.ডি. থিসিস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৯ (অপ্রকাশিত); ঢাকা প্রকাশ ১৮৬৩-১৯৩০ খ্রি. এবং মাসিক জাগরণ ১৩৩৪-৩৫ বাংলা; CE Bucland, Bangal under the Lieutenant Governors, Calcutta, 1901; FB Bradeley Birt, Twelve men of Bengal in the Nineteenth Century, Calcutta, 1925; A Claude Campbell, Glimpsess of Bengal, Culcatta, 1907; AH Dani, Dacca- A Record of its changing Fortunes, Dhaka, 1962; Sharifuddin Pirzada (ed.), Foundation of Pakistan (1906-1924), Karachi, 1969; Sufia Ahmed, Muslim Community in Bengal (1884-1912), Dhaka, 1974; Sharif uddin Ahmed, Dacca A study in Urban History and Development, London, 1986.