ঢাকা নওয়াব এস্টেট
ঢাকা নওয়াব এস্টেট উপনিবেশিক আমলে পূর্ববাংলার সর্ববৃহৎ জমিদারি। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা হাফিজুল্লাহ এবং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র খাজা আলীমুল্লাহ। তবে জমিদারির পরিধি বৃদ্ধি, বিস্তৃতি, বিকাশ, ব্যবস্থাপনা, সম্পদ ও ক্ষমতা বৃদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধনে যাদের সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে তারা হলেন খাজা হাফিজুল্লাহর উত্তরসূরি খাজা আবদুল গণি এবং তাঁরপুত্র খাজা আহসানুল্লাহ। এ পরিবারের প্রধানকে নওয়াব বলে আখ্যায়িত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এদের সাথে প্রাক্তন মোগল শাসকবর্গ বা নওয়াবদের কোন সম্পর্ক ছিলনা। তাঁদের এ নওয়াব উপাধি ব্রিটিশ শাসকদের প্রদত্ত একটি উপাধি বা খেতাব। বিশ শতকের প্রথম ভাগেই তাঁরা তাঁদের ভূস্বামীগত অবস্থান থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী পরিবার হিসাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলত ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত তাদের পারিবারিক বাসভবন আহসান মঞ্জিল ছিল সারা পূর্ব বাংলার মুসলমানদের রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দু।
আঠারো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁদের পূর্বপুরুষ ভাগ্যান্বেষণে সুদূর কাশ্মীর থেকে বাংলাদেশে আসেন এবং স্বর্ণরেণু, চামড়া ও লবণের ব্যবসায়ী হিসেবে সিলেটে বসবাস শুরু করেন। ওই শতকের শেষভাগে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য ঢাকার বেগমবাজারে এসে বসবাস শুরু করেন। ব্যবসায় ব্যাপক সফলতা অর্জনের পাশাপাশি তাঁরা বিপুল পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করেন। খাজা হাফিজুল্লাহর ব্যবসা ব্যবসা ঢাকা, বাকেরগঞ্জ এমনকি তিববতের লাসা পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটে।
১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে জমিদারি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়ন করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে খাজনা বাকী পড়ায় মোগল আমল থেকে চলে আসা জমিদারিগুলির দুর্দিন শুরু হয় ও অনেক পুরনো বনেদী জমিদার তাঁদের জমিদারি হারায়। এ বন্দোবস্তের পরেও যারা জমিদারি ক্রয় করছিল তাদের মধ্যেও অনেকেরই জমিদারি নিলামে উঠে। নব্যপুঁজিপতি ব্যবসায়ী বা বানিয়ারা নিলামে উঠা ওই সব জমিদারি ক্রয় করে ব্যবসায়ী থেকে জমিদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ প্রেক্ষাপটেই মৌলবী খাজা হাফিজুল্লাহ ১৮০৬ সালে বাকেরগঞ্জে প্রথম জমি ক্রয় করেন। একই বছরে ময়মনসিংহ জেলার আতিয়া পরগনার (বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলা) চার আনা অংশ ৪০,০০০/- টাকায় কিনে নেন। বরিশালের বুজুর্গ উমেদপুর পরগণায় আয়লা টিয়ারখালি ও ফুুলঝুরি মৌজা দুইটি ১৮১২ সালের ৭ মে নিলামে উঠলে খাজা হাফিজুল্লাহ ১,৪১,০০০ বিঘা আয়তনের বিশাল পরগনা দুটি ৩৭২ টাকার রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে মাত্র ২১,০০১/- টাকার বিনিময়ে কিনে নেন। ১৮৪৭ সালে খাজা আলীমুল্লাহ সুন্দরবন কমিশনারের সহায়তায় মৌজা দুটির জরিপ করেন। জরিপের ফলে মৌজা দুটির জমির প্রকৃত পরিমাণ ও সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়।
জরিপের ফলাফল নিম্নরূপ:
মৌজা: ফুলঝুরি | পরিমাণ |
১. আবাদযোগ্য ও জঙ্গলবিহীন জমি | ২০,০০০ বিঘা |
২. জঙ্গলাকীর্ণ জমি | ৪,০০০ বিঘা |
মৌজা: আয়লা টিয়ারখালি | পরিমাণ |
১. আবাদয্যেগ্য ও জঙ্গল বিহীন জমি | ১৬,০০০ বিঘা |
২. দক্ষিণের জঙ্গলাকীর্ণ জমির পরিমাণ | ৮৫,০০০ বিঘা |
৩. জঙ্গলাকীর্ণ জমি | ১৬,০০০ বিঘা |
খাজা হাফিজুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র খাজা আবদুল গফুর এস্টেট এবং ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর আমলে জমিদারির পরিধি আরো বিস্তৃতি লাভ করে। তিনি ময়মনসিংহ জেলার আটিয়া পরগনার ২ আনা ৫ গন্ডা অংশ জমিদারি নিজ নামে ক্রয় করেন। উক্ত জমিদারির সদর জমা অর্থাৎ রাজস্ব ছিল ৬০৫৬ টাকা ৩ আনা ৬ পাই। খাজা আবদুল গফুর ১২৩৮ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে মারা যান। খাজা আবদুল গফুরের ব্যবসা ও জমিদারি পরিচালনার জন্য উপযুক্ত কোন পুত্র না থাকায় খাজা আলীমুল্লাহ খাজা পরিবারের মোতয়াল্লীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
খাজা হাফিজুল্লাহর তত্ত্বাবধানে তাঁর ভাতিজা খাজা আলীমুল্লাহ ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পৃথকভাবে ব্যবসা করে শুরু করেন। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি তাঁর ব্যবসার নিজস্ব আয় দিয়ে বরিশাল, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা এবং ঢাকা জেলায় জমিদারি ক্রয় করেন। এ ছাড়া তিনি নীলকুঠিও কেনেন। ফলে তার জমিদারির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। যে সব পরগনা এ সময়ে কেনা হয় তার মধ্যে বলদাখাল, সলিমাবাদ, আটিয়া, সুবিদখালি ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
খাজা আলীমুল্লাহ তাঁর দ্বিতীয় পুত্র খাজা আবদুল গণিকে পরিবারের সকলের সম্মতিতে খাজা পরিবারের মোতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব অর্পনের জন্য একটি ১৮৪৬ সালের ২৩ মে ওয়াক্ফ নামা তৈরি করা হয়। নওয়াব পরিবারের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বিখ্যাত একটি ওয়াক্ফ নামা। এই ওয়াক্ফ নামাটির সূত্রেই ঢাকার খাজা পরিবার ১৮৪৬ সাল পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ সকল ক্ষেত্রে যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে।
উক্ত ওয়াকফনামার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো ছিল: মোতাওয়াল্লী সমস্ত সম্পত্তি দেখাশুনা করবেন, এর উন্নতি সাধন করবেন, সরকারের রাজস্ব জমা দিবেন এবং আয় থেকে নির্ধারিত তালিকা মোতাবেক অংশীদারদের ভাতা দিবেন। উদ্বৃত্ত অর্থ কোষাগারে জমা থাকবে। প্রয়োজনে অবস্থা বুঝে মোতাওয়াল্লী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উদ্বৃত্ত অর্থ বিতরণ করবেন। এ ব্যাপারে মোতাওয়াল্লীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। বর্তমানে যে সম্পত্তি আছে তা যেমন ওয়াক্ফ-এর অন্তর্গত আছে ঠিক তেমনি যে সম্পত্তি ক্রয়ের মাধ্যমে বিদ্যমান সম্পত্তির সাথে যোগ হবে সেগুলিও অত্র ওয়াক্ফ-এর অন্তর্ভুক্ত হবে এবং মোতাওয়াল্লীই ওই সম্পত্তি দেখাশুনা ও পরিচালনা করবেন। পরিবারের সদস্যরা মোতাওয়াল্লীকে অপসারণ করতে পারবেন না। মোতাওয়াল্লী কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারবেন। কোন মোতাওয়াল্লী তার জীবদ্দশায় তার উত্তরসূরি হিসেবে মোতাওয়াল্লী মনোনীত না করলে সে ক্ষেত্রে মোতাওয়াল্লীর আকস্মিক মৃত্যু হলে পরিবারের সদস্যরা নতুন মোতাওয়াল্লী নির্বাচন করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন রয়েছে।
১৮৪৬ সালে ২৩ মে (২৭ বৈশাখ ১২৫৩ বঙ্গাব্দ) যখন ওয়াক্ফ নামাটি সম্পাদিত হয় তখন খাজা পরিবারের পূর্ব পুরুষের এজমালি সম্পত্তির বার্ষিক মোট আয় ছিল ৩,৪৮,৭৪০/- টাকা। উল্লেখ্য যে, খাজা আবদুল গফুরের বিধবা স্ত্রী খাদিজা খানম ওরফে ধনবিবি-এর নেতৃত্বে পরিবারের সকল সদস্য একমত হয়ে ওয়াক্ফ নামাটি সম্পাদন করেছিলেন বলে ঢাকা নওয়াব পরিবারের ইতিহাসে এটি ধনবিবি ওয়াক্ফ প্রপার্টি’ নামে সমধিক পরিচিত। ধনবিবি ওয়াক্ফ প্রপার্টি ঢাকা, বাকেরগঞ্জ, ত্রিপুরা ও ময়মনসিংহ জেলার বিস্তৃত অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। জমিদারি চারটি প্রধান অঞ্চলে অবস্থিত ছিল বলে ঢাকা নওয়াব পরিবারের ইতিহাসে এটি ‘Four Property of Ancestors’ বলেও পরিচিত ছিল।
খাজা আলীমুল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী। তিনি জমিদারির পরিধি বরিশাল, ত্রিপুরা, ময়মনসিংহ, ঢাকা, রাজশাহী এবং পাবনা জেলায় বিস্তৃতি ঘটান। তিনি প্রত্যক্ষ্য করেন যে, উত্তরাধিকারীদের মধ্যে জমিদারি বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের জমিদারির পরিধি ছোট হয়ে যায় এবং এক সময় জমিদারিটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ উপলব্ধি থেকে তিনি ওয়াক্ফনামাটি সম্পাদন করেন। এর মাধ্যমে পূর্ব পুরুষের সম্পত্তি চতুষ্টয় ছাড়াও তিনি তাঁর নিজে অর্জিত যাবতীয় সহায় সম্পত্তির জন্যও আবদুল গণিকে পৃথকভাবে মোতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেন এবং ওই সব সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর অনুকূলে ছেড়ে দিয়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। প্রকৃতপক্ষে ১৮৪৬ সালের এই বিখ্যাত ওয়াক্ফ নামার মাধ্যমে খাজা আবদুল গণি যেমন পূর্ব পুরুষদের এজমালি সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব পান। তেমনি সেই সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি পরিচালনা করতে দেন। দায়িত্ব থেকে পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়ার জন্য খাজা পরিবারের সদস্যরা খাজা আবদুল গণিকে একটি নাদাবীনামা বা ফোরখাতনামা লিখে দেন। তাছাড়াও তিনি তার ব্যক্তিগত জমিদারি ও সম্পদ হেবা-এল-এওয়াজ বা দানপত্র দলিলের মাধ্যমে তাঁর উত্তরসূরি খাজা আবদুল গণিকে দান করেন। ১৮৪৫-৪৬ সালে সম্পাদিত দানপত্রের মাধ্যমে তিনি বাকেরগঞ্জ জেলার বরদাখাত পরগনার কিছু অংশ জমিদারি হেবা-এল-এওয়াজ এর মাধ্যমে তিনি খাজা আবদুল গণিকে দেন। ওই একই দানপত্রে আরো কয়েকটি পরগনা দান করার বিষয়টি উল্লেখ পাওয়া যায়।
১৮৫৪ সালে খাজা আলীমুল্লাহর মৃত্যু হয়। খাজা আবদুল গণি পিতার অনুকরণে পুত্র খাজা আহসানুল্লাহকে শিক্ষা, দীক্ষা ও ব্যবসা পরিচালনাসহ সকল কর্মকান্ডের জন্য যোগ্য ও প্রশিক্ষিত করে তোলেন। জমিদারিকে একক প্রপার্টি বা ইউনাইটেড প্রপার্টি হিসেবে ভবিষ্যতে পথ চলার জন্য তিনি তার পিতার নীতিই অনুসরন করেন। খাজা আহসানুল্লাহকে উত্তরসূরি ও মোতওয়াল্লী নির্বাচনের জন্য ১৮৬৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর একটি তিনি ওয়াক্ফনামা তৈরি করেন এবং পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে খাজা আহসানুল্লাহকে খাজা পরিবারের মোতাওয়াল্লী-এর দায়িত্ব অর্পন করা হয়। মোতাওয়াল্লী হিসেবে তিনি পূর্বোক্ত ধনবিবি প্রপার্টি ও খাজা আবদুল গণির নিজের অর্জিত সম্পত্তি দেখাশুনা ও জমিদারি পরিচালনা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নওয়াব খাজা আবদুল গণির সরাসরি তত্ত্বাবধানে নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহ জমিদারি পরিচালনা করেন ও নতুন জমি ক্রয় করে জমিদারির পরিধি আরো বিস্তৃত করেন।
খাজা আবদুল গণির সময় থেকেই খাজা পরিবারটি দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক কর্মকান্ডের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। খাজা আহসানুল্লাহ নিজস্ব ব্যয়ে ঢাকা শহরের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করেন এবং রাস্তায় গ্যাস বাতি সরবরাহ করেন। ১৮৭৪ সালের ৬ আগস্ট গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক এ বিশুদ্ধ পানির কলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ঢাকাবাসীকে পঞ্চায়েত মহল্লার অন্তর্ভুক্ত করে তিনি তাঁর নেতৃত্ব এবং সামাজিক দায় দায়িত্বের বড় রকমের স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর সময়ে জমিদারির বিস্তৃতি বা হ্রাস কোনটিই হয়নি। আহসানুল্লাহ তাঁর জমিদারি বিস্তৃতির পরিবর্তে তাঁদের জমিদারির ভিত্তি শক্ত ও ব্যবস্থাপনাকে সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত করার পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, কেননা তাঁর সময়ে দেশে জমিদারি প্রথার ওপর ‘bengal Tenancy Act’, 1885 হুমকি রূপে আবির্ভুত হয়। এ আইন প্রবর্তনের পরপরই দেশে দূরদর্শী জমিদাররা জমিতে বিদ্যমান মধ্যস্বত্ব ক্রয় করার একটা প্রবণতা প্রদর্শন করেন। এ কৌশল অবলন্বন করা হয় উদ্ভুত ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের প্রজাদের ওপর জমিদারদের সনাতনী নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখার উদ্দেশ্যে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আহসানুল্লাহ পরিবারের বাড়তি সম্পদ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য রায়তি এবং প্রজাস্বত্ব ক্রয় করেন এবং এগুলিকে খাস জমি হিসেবে ব্যবস্থা প্রদান করেন। এ নতুন ব্যবস্থাপনায় খাজাগণ নিজেরাই তাদের এস্টেটের প্রজাতে রূপান্তরিত হন। এ দূরদর্শিতাপূর্ণ কাজের কারণে যখন ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয় তখন নওয়াব এস্টেট চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়।
নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহর মৃত্যুর পর নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ মোতাওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জমিদারির পাশাপাশি রাজনীতি করতে গিয়ে সলিমুল্লাহ ঋণ গ্রহণ করেন। তিনি এ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে জমিদারি ‘কোর্ট অব ওয়ার্ডের’ ব্যবস্থাপনায় দায়বদ্ধ করতে বাধ্য হন। ১৯১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর নওয়াব সলিমুল্লাহর মৃত্যু ঘটে। তবে তার পূর্বেই তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র খাজা হাবিবুল্লাহকে নওয়াব এস্টেটের মোতাওয়াল্লী মনোনীত করেন। কিন্তু নওয়াবজাদা খাজা আতিকুল্লাহ খাজা হাবিবুল্লাহকে মোতাওয়াল্লী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি নিজেকে মোতাওয়াল্লী হিসেবে দাবি করেন। কিন্তু তাঁর এই দাবি অগ্রাহ্য হয়। অবশেষে তিনি নিজেকে মোতাওয়াল্লী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৫ এপ্রিল ১৯১৫ সালে ঢাকা ১ম সাবজজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। উক্ত মামলার বাদী ছিলেন তিনজন (১) নওয়াজাদা খাজা আতিকুল্লাহ (২) খাজা রসুল বক্স (৩) খাজা সুলেমান কাদর এবং একমাত্র বিবাদী ছিলেন নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ। মামলায় খাজা আতিকুল্লাহ হেরে যান। খাজা হাবিবুল্লাহ নওয়াব এস্টেটের কোন উন্নতি করতে পারেননি। তাঁর আমলেই নওয়াব এস্টেটের চূড়ান্ত পতন হয়।
শুরুতে ঢাকা নওয়াব এস্টেটের চীফ ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন খ্যাতিনামা ইংরেজ কর্মকর্তাগণ। শেষের দিকে দুইজন এদেশীয় মুসলিম নওয়াব এস্টেটের চীফ ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। যারা চীফ ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মি. জি এল গার্থ, আর ডি লায়াল, কর্নেল মি. জে হডিং, এইচ সি এফ মায়ার, এলজি পিনেল, পিজে গ্রিফিথ, পিডি মার্টিন, মৌলবী মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, আবদুর রহমান সন্যামত প্রমুখ। এইচ এফ সি মায়ারের সময় নওয়াব এস্টেট কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে চলে যায়। মৌলবী মোহাম্মদ আবদুর রহমান সন্যামত চীফ ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে পাকিস্তান সরকার নওয়াব এস্টেট অধিগ্রহণ করেন।
১৮৪৬ ও ১৮৬৮ সালে সম্পাদিত ওয়াক্ফ নামা ছিল খাজা পরিবারের ঐক্যের এবং একই সাথে সামগ্রিক উন্নতির মূলমন্ত্র। এই মূলমন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম ঝড় ওঠে ১৮৮০ সালে। সৈয়দ আবদুল শফি-এর নেতৃত্বে পরিবারের বেশ কিছু সদস্য মোতওয়াল্লীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং মোতওয়াল্লীকে অস্বীকার করেন। তারা ১৮৪৬ ও ১৮৬৮ সালে সম্পাদিত ওয়াক্ফ নামা ও নিয়োজিত মোতাওয়াল্লীর পদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ঢাকার সাবজজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় নওয়াব আবদুল গণি ও নওয়াব আহসানুল্লাহকে বিবাদী করা হয়। তারা ওয়াক্ফ নামায় বর্ণিত সম্পত্তির ওপর পরিবারের সবার অধিকার দাবি করেন। কিন্তু মামলাটি নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই খাজা পরিবারের শুভাকাঙ্খীদের দ্বারা উভয় পক্ষের মধ্যে মীমাংসার উদ্যোগ নেয়া হয়। নওয়াব পরিবারটির এজমালি সম্পত্তি যেন ভেঙ্গে না যায় এবং এ এস্টেট যেন অটুট থাকে, সে লক্ষ্যে তৎকালীন লে. গভর্নর স্যার অ্যাশলে ইডেন এবং ঢাকার তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট জজ মি. এফ আর রেম্পিনি ও ঢাকা বেঞ্চের প্রিন্সিপাল মি. ফ্রেজার আপোষ মীমাংসার উদ্যোগ নেন। তারা উভয় পক্ষের সাথে আপোষ মীমাংসার বিষয়ে আলোচনা করেন এবং সমঝোতার জন্য ১৮৮১ সালের ২৬ আগস্ট একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে সদস্যদের ভাতা বৃদ্ধি পায়। ‘Memorandum of Agreement’ স্বাক্ষরের পর বাদীপক্ষ মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। ১৮৮১ সালের এ চুক্তিনামাটি নওয়াব পরিবারের দ্রুত পতনকে ঠেকানোর ক্ষেত্রে প্রথম দলিল বলে গণ্য করা হলেও বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ১৮৮০ সালে দায়েরকৃত মামলা এবং ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৮১ সালে সম্পাদিত চুক্তি নওয়াব পরিবারের সমৃদ্ধি অবনতির দিকে ধাবিত হয়। মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্টের তাৎক্ষণিকভাবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে সহায়তা করলেও অন্তঃকোন্দলকে ঠেকাতে পারেনি।
খাজা পরিবারের দ্বিতীয় দফা ভাঙ্গনের জন্য দায়ী ছিলেন খাজা আলীমুল্লাহ। তিনি ১৮৯৪ সালে খাজা পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হন। তিনি ১৮৮০ সালে দায়ের করা মামলার অনুকরণে নওয়াব আহসানুল্লাহর বিরুদ্ধে ঢাকার সাবজজ আদালতে পৃথকভাবে তিনটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১৮৪৬ ও ১৮৬৮ সালের ওয়াকিলনামার মাধ্যমে বাদীগণের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী থেকে বঞ্চিত করার কারণে ক্ষতিপূরণ দাবী করা হয়। মামলা চলাকালে ১৯০১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে নওয়াব আহসানউল্লাহর মৃত্যু হয়। নওয়াব সলিমুল্লাহ মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব গ্রহণের পর বাদীগণের সাথে আপোষ করেন। ফলে বাদীগণ মামলা প্রত্যাহার করেন।
নওয়াব এস্টেটের অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের জন্য যে সব কারণ খুঁজে পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ:
জামিদারির অংশীদারিত্ব, পারিবারিক কোন্দল এবং পরিবারের সদস্যদের অসহযোগিতা।
নওয়াব সলিমুল্লাহর পেশা পরিবর্তন। অর্থাৎ জমিদারি পরিচালনার পরিবর্তে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ।
দেশ ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়।
এস্টেটের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর নির্ভরশীল হওয়া।
ঢাকা নওয়াব পরিবারের উত্থানের প্রথম দলিলটি ছিল ১৮১২ সালে বাকেরগঞ্জের দুটি পরগনা আয়লা টিয়ারখালি ও ফুলঝুরি নিলামে ক্রয়ের দলিল। আর নওয়াব পরিবারের পতনের প্রথম দলিলটি হল ১৯০৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা নওয়াব পরিবারের এজমালি সম্পত্তি ও নওয়াব সলিমুল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া দলিলটি।
উল্লেখ্য নওয়াব সলিমুল্লাহ যখন নওয়াব এস্টেটের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সে সময়ে নওয়াব এস্টেটের অর্থনৈতিক অবস্থায় মন্দা চলছিলো। যদিও নওয়াব এস্টেট তখনও ঋণের জালে জর্জরিত হয়নি। নওয়াব সলিমুল্লাহ কর্তৃক মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব গ্রহণকালেও জমিদারি মোটামুটি স্বচ্ছল ছিলো। একটি হিসাব থেকে জানা যায় নওয়াব আহসানুল্লাহর মৃত্যুকালে নগদ টাকা প্রমোসরী নোট ও ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭ লাখ। সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ড এবং দান খয়রাতের দিক থেকে তিনি তাঁর পিতা ও পিতামহের যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন। দান খয়রাত করা ছাড়াও জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডে এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কারণে তাঁর প্রচুর অর্থ খরচ হয়। কিন্তু জমিদারির আয় খরচের তুলনায় তেমন বৃদ্ধি পায় না। ফলে তিনি ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হন। উল্লেখযোগ্য যে, তিনি জনকল্যাণ কাজেই তাঁর বিপুল অর্থ সম্পদ ব্যয় করেছেন।
১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনের জন্য ঢাকায় মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স-এর সভা অনুষ্ঠানের সকল ব্যয় তিনি নিজেই বহন করেন। ফলে তার ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকে। মাড়োয়ারী ও অর্থলগ্নীকারী মহাজনদের নিকট থেকে গৃহীত ঋণের পরিমাণ ছিল চৌদ্দ লক্ষ টাকা। ঋণ দাতারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। কিন্তু জমিদারির আয় তেমন না থাকায় তিনি জমিদারির আয় থেকে এ ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। ঋণ পরিশোধ করতে তিনি সম্পত্তি বন্ধক রাখতে বাধ্য হন। ব্রিটিশ সরকারের নিকট সম্পত্তি বন্ধক রেখে ষোল লক্ষ পচিশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে হিন্দু মহাজন ও মাড়োয়ারীদের নিকট থেকে গৃহীত ঋণ পরিশোধ করেন।
খাজা আতিকুল্লাহ পরিবারের অন্যান্যদের সমর্থন নিয়ে নওয়াব সলিমুল্লাহর বিরোধিতা শুরু করেন। একদিকে অর্থনৈতিক সংকট এবং অপরদিকে পারিবারিক কোন্দলে-এ উভয় সংকটে নওয়াব সলিমুল্লাহর পক্ষে এস্টেট পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার ইতোপূর্বে বিশেষ কতগুলি কারণে দেশীয় জমিদারদের মধ্যে যারা তাদের জমিদারি সফলভাবে পরিচালনা করতে অপারগ ছিলেন তাদের এস্টেট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ১৮৭৯ সালে ‘বেঙ্গল কোর্ট অব ওয়ার্ড’ অ্যাক্ট প্রণয়ন করেন। এ আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল এস্টেট পরিচালনায় ব্যর্থ জমিদারের জমিদারি সরকারের অধীনে নিয়ে পরিচালনা করা এবং সকল খরচ মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অর্থ এস্টেটের অংশীদারগণের মধ্যে প্রাপ্য অংশ মতো প্রদান করা।
নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ খাজা পরিবারের এজমালি সম্পত্তি এবং তার নিজের সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। উক্ত সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে নিয়ে পরিচালনা করার জন্য পূর্ব বাংলা ও আসাম সরকারের নিকট ২১ জুলাই ১৯০৭ সালে একটি পত্র দেন (পত্র নং ২৭৫/সি)। উক্ত পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলা ও আসাম সরকারের বোর্ড অব রেভেনিউ কোর্ট অব ওয়ার্ড অ্যাক্ট (Act No 1X 1879)-এর ১০ নং ধারা অনুযায়ী পূর্ব বাংলা ও আসাম গেজেটে ২১ আগস্ট ১৯০৭ এবং ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯০৭ তারিখে নোটিশ প্রকাশ করে।
নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ তাঁর নিজের অংশ কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে পরিচালনা করার জন্য ন্যস্ত করার পর নওয়াব এস্টেটের অন্যান্য অংশীদারগণও জমিদারি পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন। একে একে অন্যান্য অংশীদারগণও তাঁদের নিজ নিজ অংশ কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে পরিচালনার জন্য ন্যস্ত করেন। নওয়াব খাজা আতিকুল্লাহ তাঁর অংশ কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনে পরিচালনা করার জন্য আবেদন জানান। তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে জে টি র্যাংকিন, সেক্রেটারি, স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ গেজেট প্রকাশ করা হয়।
পরবর্তী সময়ে খাজা আতিকুল্লাহ নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহকে এস্টেটের মোতাওয়াল্লী হিসেবে মেনে নেন। কিন্তু নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ নওয়াব এস্টেটের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। নওয়াব এস্টেট কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীনেই চলতে থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ এবং ইংরেজ শাসনের অবসান হয়। পাকিস্তান সরকার দেশ পরিচালনায় বিভিন্ন নিয়মনীতি প্রবর্তন করে। সরকার জমিদারি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন অ্যাক্ট প্রণয়ন করে। জমিদারি উচ্ছেদ আইন ১৯৫০ এর ক্ষমতা বলে ১৯৫২ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তান সরকার ঢাকা নওয়াব এস্টেট অধিগ্রহণ করে। [মোঃ আলী আকবর]