জ্ঞাতিত্ব
জ্ঞাতিত্ব রক্ত-সর্ম্পকের সামাজিক সত্তা। এটা প্রাথমিকভাবে গড়ে ওঠে পিতা-মাতা ও সন্তানদের মাধ্যমে। বিবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্পর্কও জ্ঞাতিত্বের আওতায় পড়ে। কোন ব্যক্তির কার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। আত্মীয়বর্গের মধ্যে সক্রিয় সদস্য হওয়ার জন্য একজনকে অবশ্যই জ্ঞাতিত্বের অবস্থানের অধিকার ও দায়িত্ব এবং জ্ঞাতিবর্গের সদস্যদের মধ্যে প্রথাগত আচরণ সম্পর্কে জানতে হয়। জ্ঞাতিসম্পর্ক, পরিবার ও অন্যান্য সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত দলের মাধ্যমেই লোকজন সাধারণত তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত কার্যাদি পরিচালনা করে থাকে। আত্মীয় সম্পর্কীয় দলসমূহের মধ্যে দ্বি-মুখী ভূমিকা ও পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টি দিলে বাংলাদেশের পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের সংগঠন এবং এতে বিদ্যমান সহযোগিতা ও সংঘাত অনুধাবন করা সহজ হয়। প্রতিটি পরিবারে একদল ব্যক্তিত্ব থাকে যারা সার্বক্ষণিকভাবে সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদি বিনিময় করে থাকে এবং নিজেদের লক্ষ্য ও চাহিদা পূরণের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করে থাকে। জ্ঞাতিত্ব, জ্ঞাতিগোষ্ঠীর ব্যাপ্তি এবং সাধারণ জীবনযাপনের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক একক রয়েছে। একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আত্মীয়দের অধিকার, দায়িত্ব ও আচরণ জ্ঞাতিত্ব পদ্ধতিরই অংশ।
অন্য অনেক সমাজের মতো বাংলাদেশে আত্মীয়পদ বলতে বোঝায়:
১. | প্রজন্ম পর্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিচার (পিতা, পুত্র, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি প্রভৃতি)। প্রতিটি আত্মীয়পদ দ্ব্যর্থহীনভাবে আত্মীয়ের প্রজন্মকে নির্দেশ করে থাকে। |
২. | একই প্রজন্মের মধ্যে বয়সের তারতম্য বিচার (বড় এবং ছোট ভাই-বোন, পিতার বড় ও ছোট ভাই প্রভৃতি)। |
৩. | এক বংশভুক্ত (lineal) এবং সহগামী (collateral) আত্মীয়ের পার্থক্য বিচার। একবংশ সূত্রীয় রীতি বলতে একটি রেখার মাধ্যমে চিহ্নিত সংগঠিত আত্মীয়দের বোঝায়। এ পদ্ধতিতে, শুধু পুরুষ দ্বারা পরিচিতি দেওয়া হলে তাকে পিতৃবংশ পদ্ধতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। উভয় লিঙ্গের সন্তানরা তাদের পিতার বংশের অন্তর্ভুক্ত। ওই পুরুষের সন্তান ও সন্তানের সন্তান এবং তাঁর সন্তান একই বংশের অন্তর্ভুক্ত। জ্ঞাতিসম্পর্ক আত্মীয়বন্ধনের মাধ্যমে নির্ণীত হয়। বাংলাদেশে আত্মীয়তা প্রধানত পুরুষের মাধ্যমে বংশধারা বন্ধনকে স্বীকার করে। |
৪. | আত্মীয়দের মধ্যে লিঙ্গের প্রভেদ (ভাই, বোন, ভাতিজা, ভাতিজি ইত্যাদি)। |
৫. | সম্বোধনকারীর লিঙ্গ বিচার, (পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথক পদ্ধতির শব্দাবলি রয়েছে)। |
৬. | যে ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে তাদের লিঙ্গ তারতম্য (পিতার ভাই, মাতার ভাই, পিতার বোন ইত্যাদি)। একে বলা হয় বিপরীত লিঙ্গবন্ধন (cross sex tie)। |
৭. | জন্মসূত্রে এবং বিবাহের মাধ্যমে সম্পর্কিত আত্মীয়ের মধ্যে পার্থক্য (বোন বা মা বনাম স্বামীর মা) অর্থাৎ রক্তের সম্বন্ধযুক্ত বনাম বৈবাহিক সম্বন্ধযুক্ত বন্ধন। |
৮. | ডাকবলা সম্পর্ক (সম্বোধনের মাধ্যমে সম্পর্ক) বা কল্পিত আত্মীয়বন্ধন এবং এর সঙ্গে রক্তের সম্পর্কযুক্ত বা বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধনের সংযুক্ততা। |
জ্ঞাতিত্বের সামাজিক কাঠামো সৃষ্টি ও সংরক্ষণে ঘর-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ঘর বলতে আক্ষরিক অর্থেই একটি আবাসিক একক বোঝায় যেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিবারের যেকোনো ধরনের সকল সদস্য অবস্থান করে। প্রতিটি একক ঘরকে বলা হয় চুলা বা খানা যার অর্থ হচ্ছে ‘একই সঙ্গে আহার গ্রহণকারী একক’। ঘরের সদস্যপদ প্রধানত পিতৃবাসের ওপর ভিত্তি করে নিরূপিত হয়। এটি উৎপাদন ও খরচের প্রাথমিক একক। ঘর হচ্ছে একটি আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্র। রক্তের সম্পর্কের সদস্য, তাদের বিবাহিত সঙ্গী এবং এক থেকে তিন প্রজন্মের ব্যক্তি সমন্বয়ে ঘর গঠিত হয়ে থাকে। এছাড়া, কখনও কখনও অন্যান্য আত্মীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তি এতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
একটি বাড়িকে ঘিরে জ্ঞাতিত্ব গড়ে ওঠে। বাড়ি বলতে সাধারণভাবে একই আঙ্গিনায় একগুচ্ছ ঘরকে বোঝায়। বাড়ির অভ্যন্তরে, ঘরের প্রধানগণ হয় রক্তীয় অথবা বৈবাহিক সম্পর্কের দ্বারা যুক্ত। কিছু কিছু ঘরের প্রধানগণ উল্লিখিত দুই সম্পর্কের কোনোটার দ্বারাই সম্পর্কযুক্ত নয়। অবশ্য এরকম ঘটনা খুবই বিরল। প্রতিটি পরিবারের একজন কার্যকরী প্রধান থাকে। কিন্তু সাধারণত বাড়ির কোনো স্বীকৃত প্রধান থাকে না। বাড়ির সদস্যরা একে অপরকে সাহায্য করে থাকে, বিশেষ করে কোনো সংকটময় মুহূর্ত উপস্থিত হলে এমনটি দেখা যায়। বাড়ির বয়োবৃদ্ধ পুরুষ ও মহিলাকে বিশেষ সম্মান দেখানো হয় এবং বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়। বাড়ির অভ্যন্তরে প্রতিটি ঘরের সদস্যদের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকলেও বাড়ি মূলত একটি সামাজিক বন্ধনযুক্ত একক। একটি বাড়ি সাধারণত তাঁর সবচেয়ে কৃতিত্বপূর্ণ জীবিত অথবা মৃত সদস্যের মর্যাদার উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে।
সাধারণত গোষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞাতিত্বের সন্ধান মেলে। গোষ্ঠীর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে বিয়ে হয়ে সংসারে আসা স্ত্রীগণ ও বিয়ে হয়ে অন্য সংসারে যাওয়া কন্যাগণ ব্যতীত একগুচ্ছ ঘর বা পরিবার যারা সকলেই সগোত্রীয়। প্রপিতামহের সকল পুরুষ বংশধর এর অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ বংশ একটি অধিকারবোধ জাগ্রত করে যা গোষ্ঠীর সদস্যদের একই বন্ধনে আবদ্ধ করে। সদস্যরা একজন মৃত বা পূর্বপুরুষের মধ্যে তাদের সাধারণ উৎস খুঁজে থাকে। কোনো গোষ্ঠীর কোনো অবস্থাসম্পন্ন সদস্যের একই গ্রামের বা কখনও কখনও পাশ্ববর্তী গ্রামে নতুন আবাসিক প্লটে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস অস্বাভাবিক নয়। ফলে, একই গোষ্ঠীর সদস্যরা একই বাড়ির আঙ্গিনায় বসবাস করতেও পারে, নাও পারে। গোষ্ঠীর সদস্যগণ যারা একক সাধারণ পুরুষের মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষের সন্ধান করে তারা একত্রে বাস করুক বা না করুক, তারা একই কুলের বা বংশের অন্তর্ভুক্ত। তবে হিন্দুদের মধ্যে কুল সম্পর্কে সচেতনতা মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশি। অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে গোষ্ঠীসচেতনতা অনেক বেশি শক্তিশালী। যদিও কুল ও গোষ্ঠী উভয়ই সমার্থক শব্দ, মুসলমানগণ তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের পারলৌকিক কল্যাণের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা এবং মৃত ব্যক্তির মঙ্গল কামনায় গরিব দুস্থদের আহার করিয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, হিন্দুরা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ও সন্তুষ্টির জন্য খাবার পরিবেশন ও পূজা করে থাকে। বিয়ের পর একজন মুসলমান মহিলা তাঁর স্বামীর গোষ্ঠীর সদস্যপদ লাভ করে, তবে একইসঙ্গে তাঁর পিতৃগোষ্ঠীর সদস্যপদও বহাল থাকে। একজন মুসলমান মহিলা বিয়ের মাধ্যমে অনেকটা দ্বৈত গোষ্ঠী সদস্যপদ অর্জন করে। সে ও তাঁর সন্তানরা বাপের বাড়ি বেড়ানোর সময় আত্মীয়-গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে উপহার গ্রহণ করলেও, পিতৃগোষ্ঠীতে তাঁর উত্তরাধিকার ও সেখানে আশ্রয়ের অধিকার বহাল থাকে। বিয়ের পর একজন হিন্দু মহিলার তাঁর পিতার পরিবারে আর কোনো সদস্যপদ থাকে না। স্বামীর গৃহে আসার পর সে স্বামীর গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে যায়।
বাংলাদেশে জ্ঞাতিত্ব বলতে সাধারণত আত্মীয়-স্বজনকে বোঝানো হয়। এ জটিল শব্দটির সংজ্ঞা দিতে গেলে আত্মীয় ও স্বজন শব্দ দুটিকে আলাদাভাবে এবং একটি জটিল বিন্যাসে বিবেচনা করতে হবে। একটি গোষ্ঠীতে সকল সদস্যের সাধারণ পূর্বপুরুষ থাকে। বংশ তালিকায় এটা দৃষ্টিগোচর হয়। মোটকথা এসব লোকদের বলা হয় ‘নিজের লোক’ (স্বজন)। আত্মীয় হওয়ার জন্য এ ধরনের সাধারণ পূর্বপুরুষের প্রয়োজনীয়তা নেই। আত্মীয় শব্দটি এসেছে আত্মবাচক শব্দ ‘আত্মা’ থেকে। আত্মীয় সদস্যপদে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে, আবার এ সদস্যপদ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তৃত হতে পারে। বৈবাহিক সূত্রে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গ নিজেদের আত্মীয় সদস্যরূপে দাবি করে থাকে। মায়ের রক্তের সম্পর্কিত লোকজন (যেমন মায়ের ভাই) এবং পুরুষের রক্তের সম্পর্কিত বিবাহিত মহিলাদেরকেও আত্মীয়-স্বজনরূপে গণ্য করা হয়।
পিতৃগোষ্ঠীর মাধ্যমে রক্ত সম্পর্কিত বাড়ির সকল সদস্যদের মধ্যে গভীর নৈকট্যবোধ থাকে; তারা মনে করে যে, তাদের পরস্পরের সম্পর্ক বাড়িতে বধূ হিসেবে আনা গৃহিণীদের সঙ্গে সম্পর্কের চেয়ে অনেক বেশি গাঢ় ও নির্ভরশীল। এ কারণে, নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে যখন কোনো মহিলার বিবাহ হয়, তখন সে তাঁর পিতৃপরিবারে ভাই-বোনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। ভাইরাও তাদের বোনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলে এবং সুযোগ-সুবিধামতো উপঢৌকন দিয়ে ও বাড়িতে দাওয়াতের মাধ্যমে ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে। যখন কোনো ভাই বিবাহিত বোনের বাড়ি বেড়াতে যায় তখন বোন তাঁর বিশেষ যত্ন নেয় এবং উত্তম আহারাদি পরিবেশন করে। গ্রামের সকল মহিলাই বিয়ের পরে স্বামীর পিতার গৃহে গমন করে এবং সারাজীবন সেখানে কাটায়। কিন্তু একজন মহিলার সবসময়ই তাঁর বাপের বাড়ির জন্য বিশেষ অনুভূতি থাকে। বাপের বাড়ি বেড়ানোর জন্য সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। যখনই সম্ভব হয় একজন পিতা তাঁর বিবাহিত কন্যাকে ‘নাইওর’ আনার ব্যবস্থা করেন। এ সময় যদি জামাই সঙ্গে আসে তখন অবশ্যই বিশেষ খাবার প্রস্ত্তত করা হয়। ফলে, এ ধরনের আমন্ত্রণ ঘরের ছেলেমেয়েরা খুবই উপভোগ করে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারে শিশুরা তাদের পিতামাতা ও ভাইবোন দ্বারা লালিত-পালিত হয়ে থাকে। সাধারণ পরিস্থিতিতে, ঘরের বন্ধন খুবই ঘনিষ্ঠ। একজন পুরুষের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাঁর নিজের ঘর বা পরিবার দেখাশোনা করা। এরপর সে গোষ্ঠী বা স্বজনের দিকে নজর দিতে পারে। এ ধরনের কর্তব্য প্রথমে নিকট আত্মীয় ও আত্মীয়-স্বজন, এরপর সমাজ এবং পাড়া-পড়শির মধ্যে বিস্তৃত হতে পারে। আত্মীয় ও আত্মীয়-স্বজনের বিস্তারলাভ ঘটে থাকে সমাজ বরাবর এলোপাতাড়িভাবে। কারণ এ ধরনের সম্পর্ক সাধারণত তৈরি হয় বিয়ের মাধ্যমে। কখনও কখনও গোষ্ঠী বিস্তার ঘরের সীমানা এবং প্রায়শই গ্রাম ছাড়িয়ে যায়।
বাংলাদেশে ঘরকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক একক হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে সকলে একসঙ্গে কাজ করে, ফসল ফলায়, গবাদিপশু দেখাশোনা করে এবং সর্বোপরি, তারা যে সমস্ত জিনিসপত্র ভোগ করে তাঁর বেশির ভাগই নিজেরা উৎপাদন করে। একটি গৃহ নানা ধরনের বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ দ্বারা আবদ্ধ। এর কিছুটা হয়ে থাকে বৃহত্তর সামাজিক সংগঠন, যেমন গোষ্ঠী, আত্মীয়, স্বজন দ্বারা। তারা বৈবাহিক সম্পর্ক বাছাই, মোহরানা ও কনের পণ নির্ধারণ, দত্তক গ্রহণ ইত্যাদি গৃহস্থালি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। এ নিয়ন্ত্রণ অধিকার আসে রক্তীয়, বৈবাহিক বা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। এ ধরনের বিষয়ে গোষ্ঠী সদস্যদের প্রভাব আত্মীয়-স্বজনভুক্ত সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশি। এ তিন দলের ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রভাব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে সাধারণত গৃহে পুরুষের মর্যাদা ও কর্তৃত্ব মহিলার চেয়ে বেশি। অবশ্য কনিষ্ঠ পুরুষ সদস্যের ওপর বয়স্ক মহিলাদের প্রভাব থাকতে পারে। বিয়ের পূর্বপর্যন্ত একজন মহিলাকে তার পিতামাতার কর্তৃত্বে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আবার বিয়ের পর স্বামীর, বিশেষ করে কয়েকজন ছেলেমেয়ে না হওয়া পর্যন্ত শাশুড়ির কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকে। বিধব্য অবস্থায় সে সাধারণত তার অবিবাহিত উপযুক্ত পুত্রের তত্ত্বাবধানে থাকতে পছন্দ করে। যথাসময়ে পুত্র যদি বিয়ে করে, সে তার সঙ্গেই বসবাস করতে থাকে। তবে সকল পুত্রই আর্থিকভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। পুরুষ কর্তৃক সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ এবং শিশু যত্নের শ্রম থেকে মুক্ত থাকার ফলে পুরুষ বিশেষত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকায় যেমন, মাঠের কাজ করা, মাছ ধরা, বাজারে বেচা-কেনা এবং সমাজের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করতে পারে।
জ্ঞাতিত্বের বন্ধন লোকজনের মধ্যে আনুগত্যের সৃষ্টি করে। একটি সাধারণ ভাষায় কথা বলা ও খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গৃহের সদস্যদের একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক সহজ করে তোলে। তারা একে অন্যকে ভালভাবে বুঝতে পারে। তারা অনুভব করে যে প্রয়োজনের সময় তারা একে অন্যের প্রতি আস্থার সাথে নির্ভর করতে পারে।
প্রতিটি মুসলমান ও হিন্দু গৃহ এক একটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি হিন্দু পরিবার আবার একটি বর্ণভুক্ত। মুসলমানদের বেলায় এটি প্রযোজ্য নয়। একজন বাঙালি চাষি তার গ্রামের সঙ্গে এবং অন্যরাও তার পরিবার, গোষ্ঠী ও দ্বিপাক্ষিকভাবে সম্প্রসারিত আত্মীয়ের সঙ্গে কিছু কর্মকান্ডে জড়িত থাকে। এদের সকলেই তার গ্রামের বাসিন্দা হতেও পারে, নাও পারে। মুসলমান হলে তার মসজিদের সঙ্গে কিছু কিছু কর্মকান্ড সংশ্লিষ্ট থাকে। গ্রামের সামাজিক সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে বর্ণ, সমাজ ও জ্ঞাতিত্ব। এগুলি গ্রামকে বিভিন্ন সামাজিক দলে বিভক্ত করে। মুসলমান এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই কিছু কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আত্মীয় সদস্যদের বিশেষ অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। এভাবে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে বিভিন্ন আত্মীয়দলের সদস্যরা বিদ্যমান সামাজিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় করে।
মুসলমানরা প্রায়শ নবজাতকের নামকরণ উৎসবে আকিকা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। আকিকা পালনে ছেলেশিশুর জন্য দুইটি ও মেয়েশিশুর জন্য একটি ছাগল কুরবানি দেওয়া হয়। কুরবানি পশুর মাংস তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এর এক ভাগ নবজন্ম শিশুর পরিবার, এক ভাগ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং তৃতীয় ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। জিয়াফত বা মেজবানি অর্থাৎ কোনো উৎসব উপলক্ষে রক্ত ও বিবাহসূত্রে সকল ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
হিন্দু ধর্মীয় পঞ্জিকায় পালনের জন্য বিভিন্ন দিবস রয়েছে। তাদের সবচেয়ে প্রত্যাশিত উৎসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রথযাত্রা উপলক্ষে আয়োজিত মেলা। এ সময় মহিলারা পরিবারের সদস্যদের সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি কামনা করে স্থানীয় মন্দিরে দেবতা জগন্নাথের উদ্দেশ্যে খাদ্য ও অর্থ নিবেদন করে থাকে। বাড়ির মহিলা ও শিশুরা ধর্মীয় চেতনার উৎকর্ষ ঘটানো ও বিনোদনের উদ্দেশ্যে একত্রে গ্রামের বাইরে যাবার যে সকল সুযোগ পায় এ মেলা তার অন্যতম। মেলায় এক বাড়ির সদস্যরা অন্য বাড়ির, বিশেষ করে বৈবাহিকসূত্রে সম্পর্কিত আত্মীয় সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয়। বাড়ির বা গৃহের বাইরে আরও কয়েকটি বড় ধরনের ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এ ধরনের উৎসব একটি গ্রামের একই বর্ণের প্রায় সকলের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে আয়োজন করা হয়। বেশির ভাগ গ্রামেই বর্ণভিত্তিক দল বৈবাহিক জোটের মাধ্যমে একটি আত্মীয়দলে রূপান্তরিত হয়। এভাবে দুর্গা পূজা, কালী পূজা, গঙ্গা পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা, শীতলা পূজা এবং মনসা পূজার মতো বড় বড় ধর্মীয় উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে বর্ধিত আত্মীয়দল একটি সার্বজনীন ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে একসঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। বাংলাদেশের হিন্দুসমাজের সবচেয়ে বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজার সময় পূর্বপূরুষের স্মৃতির উদ্দেশে প্রার্থনা করা হয়। প্রতিটি পরিবার তার মৃত পূর্বপুরুষের জন্য বলিদান করে থাকে। ব্রাহ্মণকে কিছু দান করলে তা পূর্বপুরুষগণ পায় বলে বিশ্বাস করা হয়। সুতরাং মৃত আত্মীয়স্বজন যে সমস্ত উপাদান পছন্দ করত সেগুলিই পুরোহিতকে দান করা হয়।
হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিবাহের সময় রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় এবং বৈবাহিক সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনকে আমন্ত্রণ জানানোর রীতি প্রচলিত আছে। পুত্র বা কন্যার বিয়ের সময় পিতা তার নিজের বংশের লোকজনদের ছাড়াও শ্বশুর, মামা, মামাশ্বশুর, জামাই ও সন্তানদের শ্বশুরকুলের লোকজনদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে শুধু বংশের একজন প্রতিনিধি বিবাহ কর্মকান্ডে অংশ নেয়। হিন্দুদের মধ্যে বিধবাগণ বিবাহ সংক্রান্ত কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে না, তবে বিবাহ অনুষ্ঠানাদিতে অংশ নিতে তাদের কোনো বাধা নেই। হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রাথমিক পর্যায়ে বর ও কনের পিতাদেরকে পুরোহিতের সামনে স্মৃতি থেকে পূর্বপুরুষের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চারণ করতে হয়। তাদের অবর্তমানে ভাই কিংবা পুত্রগণও এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারে। বর ও কনের নিজ নিজ বাড়িতে আলাদাভাবে এ অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয়। কোনো বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর যদি রক্তসম্পর্কীয় কোনো আত্মীয়ের মৃত্যু সংবাদ আসে তাহলে সেই বিয়ে কয়েক দিনের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।
হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি অনুষ্ঠান নির্ধারিত কিছু আত্মীয়-স্বজনকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হয়। এ ধরনের একটি অনুষ্ঠান জামাইষষ্ঠীর সময় সকল জামাইকে অবশ্যই আমন্ত্রণ জানাতে হয়। সাধারণত মেয়ের স্বামীকে এ ধরনের নিমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে ধনাঢ্য পরিবারগুলি ভাইয়ের মেয়ের স্বামীকেও নিমন্ত্রণ করে থাকে। এ সময় জামাই ও শাশুড়ি পরস্পরকে নতুন কাপড় উপহার দিয়ে থাকে। শাশুড়ি জামাইয়ের দীর্ঘায়ু প্রত্যাশায় আশীর্বাদ করে। এ ধরনের আরেকটি উপলক্ষ আছে যার নাম শীতল-ষষ্ঠী। এ সময় মা তার ছেলের দীর্ঘায়ু কামনায় আশীর্বাদ করে থাকে। অন্য আরেকটি অনুষ্ঠান ভ্রাতৃ বা রাখিবন্ধন-এর মাধ্যমে ভাই এবং বোন পরস্পরের দীর্ঘজীবন কামনা করে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে।
হিন্দুদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আচার-অনুষ্ঠানে আত্মীয়দের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। মৃতের পুত্র, পিতৃপক্ষের রক্ত সম্পর্কীয় ব্যক্তি বা অন্য আত্মীয় মৃতদের শ্মশানে নিয়ে যাবে। যারা মৃতের মুখে আগুন (মুখাগ্নি) দিতে পারবে তারা হচ্ছে পুরুষের ক্ষেত্রে জীবিত জ্যেষ্ঠ পুত্র, অথবা স্ত্রী, অথবা কন্যা, অথবা ছোট ভাই, অথবা পিতা, বা চাচা বা দাদা, বা মামা, বা নানা এবং অন্যান্যরা। নারীর ক্ষেত্রে পুত্র বা কন্যা বা সতীনের ছেলে বা স্বামী বা পুত্রবধূ বা ভাই এবং অন্যান্যরা। মৃত্যুর পর অশুচিকাল পালন করতে হয়। এটি বিভিন্ন প্রেক্ষাপট, যেমন মৃতব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির আত্মীয়তার ধরন, তাদের পেশা, বর্ণ ইত্যাদি ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। অশুচিকাল শেষে সব ধরনের বিধিনিষেধ উঠে যায় এবং পুত্ররা মাথা ন্যাড়া করে পুরোহিতের সহায়তায় একটি অনুষ্ঠান পালন করে যার নাম শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধের দিন পুত্ররা রক্তসম্পর্কীয় সকল আত্মীয়কে মৃতের আত্মার শান্তির জন্য তাদের সঙ্গে স্নান ও আহারের নিমন্ত্রণ করে।
মুসলমান ও হিন্দু উভয়েই বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য ভোজের আয়োজন করে থাকে। মৃত্যু পরবর্তী ‘ভোজ’ আয়োজনের জন্য প্রয়োজন হলে মৃতব্যক্তির সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রয় করা হয়। মুসলমান বা হিন্দু উভয়ের মধ্যেই এ প্রথা চালু রয়েছে। আত্মীয়-স্বজন সমন্বয়ে বেশির ভাগ ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই ভোজন ও উপহার প্রদানের ব্যবস্থা থাকে। প্রত্যেক পরিবার প্রতিটি ধর্মীয় উপলক্ষ যথাযথভাবে পালনের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে ঈদ বা পূজার ছুটির সময় গ্রামের বাইরে বা দূরদেশে বসবাসকারী পরিবারের সদস্যরা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে আনন্দোৎসবে যোগদানের জন্য সচেষ্ট থাকে। এভাবে তারা নিয়মমাফিক জীবনযাত্রার বাইরে এসে আনন্দ উপভোগ ও আত্মীয়দের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক আচরণ প্রকাশের সুযোগ পায়।
বাঙালি আত্মীয়তা একটি ব্যাপক বর্ণনার বিষয়। শব্দটির অর্থ বহুমুখী এবং এর পরিসর অনাত্মীয় সামাজিক সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত। এ কারণে অনেক দূরের সম্পর্কের লোকদেরও আত্মীয়রূপে শ্রেণিকরণের একটি অবিরাম প্রবণতা বিদ্যমান। বাংলাদেশের সমাজে প্রায় দু’শরও বেশি আত্মীয় সম্পর্কের পদশব্দ রয়েছে। সামান্য পার্থক্যবিশিষ্ট এসব সম্পর্কের বিশ্লেষণ অত্যন্ত কঠিন। তবে তাদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের রীতি বা শ্রেণিবিভাগ অনুসরণ তেমন কঠিন নয়। [কে.এম.এ আজিজ]