জৈনধর্ম

জৈনধর্ম  ভারতের প্রধান ধর্মগুলির অন্যতম জৈনধর্ম উপমহাদেশের কোনো কোনো অংশে ধর্ম হিসেবে এখনও টিকে আছে। বাংলায় জৈনধর্মের উদ্ভব ঘটলেও এতদঞ্চলে এর অনুসারীদের কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়।

জৈন ঘটনাপঞ্জি মতে চবিবশ জন তীর্থঙ্কর এ ধর্মের মতবাদ প্রচার করেন। এঁদের মধ্যে তেইশতম প্রচারক পার্শ্বনাথ ও চবিবশতম মহাবীর ছিলেন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। মহাবীর ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক এবং তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ থেকে ৪৬৮ অব্দ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। তাঁর পূর্বসূরি পার্শ্বনাথের আবির্ভাব ঘটে প্রায় আড়াই শ বছর আগে। পার্শ্বনাথ ও মহাবীরের শিক্ষা থেকেই জৈন ধর্মমতের উৎপত্তি। পার্শ্বনাথের ধর্মোপদেশকে বলা হয় চতুর্যাম। এতে পরিত্রাণের চারটি উপায়ের কথা বলা হয়েছে, যথা- সর্বজীবে দয়া, মিথ্যাকথন থেকে বিরত থাকা, চৌর্যবৃত্তিতে অংশ না নেওয়া এবং পার্থিব সম্পদ থেকে দূরে থাকা। পরবর্তী সময়ে মহাবীর আরও একটি উপায় সংযোজন করেন। এটি হলো কোনো পোশাক পরিধান না করা। এভাবে জৈনরা দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পার্শ্বনাথের অনুসারীদের বলা হয় শ্বেতাম্বর অর্থাৎ সাদা বস্ত্র পরিধানকারী, আর মহাবীরের অনুসারীদের বলা হয় দিগম্বর অর্থাৎ নগ্ন (আক্ষরিক অর্থে, আকাশই হচ্ছে আচ্ছাদন)।

মহাবীরের জীবনকালেই বাংলায় জৈনধর্মের আবির্ভাব ঘটে। মহাবীর তাঁর মতবাদ প্রচারের জন্য রাঢ়ে (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশ) এসেছিলেন। এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, চবিবশ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে বাইশ জন পশ্চিমবঙ্গের পরেশনাথ পাহাড় নামে পরিচিত পার্বত্য অঞ্চলে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। বোধিসত্ত্বভবদানকল্পলতার ভাষ্য মতে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পুন্ড্রবধ©র্ন (উত্তরবঙ্গ) জৈনধর্ম অনুসৃত হতো। তখন জৈন মন্দিরের নেতা ছিলেন পুন্ড্রবর্ধনের অধিবাসী ভদ্রবাহু। তিনি ‘কল্পসূত্র’ নামে বেশ কিছু জৈন অনুশাসনের একটি সংকলন প্রকাশ করেন। তাঁর তিরোধানের পর গোডাস নামে তাঁর এক শিষ্য  পুন্ড্রবর্ধন এর জৈন মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর অনুসারীদের বলা হয় গোডাসগণ। পরবর্তী পর্যায়ে ‘গোডাসগণ’ সম্প্রদায় তাম্রলিপ্তিকীয়, কোটিবর্ষীয়, পুন্ড্রবর্ধনিয়া ও ধসিখরবতিকা নামে আরও চারটি উপ-সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং এটা ধরে নেওয়া যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব চার-তিন শতকের মধ্যে সমগ্র বাংলা জৈন মতবাদ প্রচারকদের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ঐতিহাসিক যুগের গোড়ার দিকে জৈনধর্ম বাংলায় একটি অনুসৃত ধর্ম ছিল। ১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম মহাস্থানগড়ে একটি জৈন মূর্তি আবিষ্কার করেন যেটি পরবর্তীকালে ১৯১২ সালে রাজশাহীর  বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর এ স্থানান্তর করা হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সাত শতকের চীনা তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং  পুন্ড্রবর্ধন (উত্তরবঙ্গ) ও সমতট এ (দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ) বহুসংখ্যক দিগম্বর জৈন প্রচারকদের দেখতে পান। জৈনদের পরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলো: (১) দন্ডায়মান মহাবীর, কৃষ্ণপ্রস্তর মূর্তি, উচ্চতা ৭৩.৬ সেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, আনু. ১০ম-১১শ শতক; (২) দন্ডায়মান পার্শ্বনাথ, কৃষ্ণপ্রস্তর মূর্তি, উচ্চতা ৬০.৯ সেমি, দিনাজপুর জাদুঘর, আনু. ১০ম-১১শ শতক; (৩) দন্ডায়মান তীর্থঙ্কর, কৃষ্ণপ্রস্তর মূর্তি, উচ্চতা ৯৩.৯ সেমি, দিনাজপুর জাদুঘর, আনু. ৯ম-১০ম শতক; (৪) দন্ডায়মান শান্তিনাথ, কৃষ্ণপ্রস্তর মূর্তি, উচ্চতা ৬৫ সেমি, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর; (৫) দন্ডায়মান ঋশ্বনাথ, কৃষ্ণপ্রস্তর মূর্তি, আনু. ১০ম-১১শ শতক, মেদিনীপুর থেকে সংগৃহীত; (৬) দন্ডায়মান পার্শ্বনাথ, কৃষ্ণপ্রস্তর মূর্তি, আনু. ১১শ শতক, বাঁকুড়া থেকে সংগৃহীত; (৭) দন্ডায়মান পার্শ্বনাথ, কৃষ্ণপ্রস্তর মূর্তি, আনু. ১১শ শতক, ২৪ পরগনা থেকে সংগৃহীত; (৮) উপবিষ্ট ঋশ্বনাথ, কৃষ্ণপ্রস্তর মূর্তি, উচ্চতা ৯৯ সেমি, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর।

পশ্চিমবঙ্গের বিহারীনাথ, বহিলারা, ধারাপাত, হরমস্র, দেউলবীর্য, পরেশনাথ, অম্বিকা নগর, চিংরী দেবী, বারোকলা, ধিদা ও কেন্দুইয়ায় আরও জৈন নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে। পাহাড়পুরলালমাই-ময়নামতী থেকে আরও কিছু ভগ্নশিলা নিদর্শনও সংগৃহীত হয়েছে। কলকাতার আশুতোষ জাদুঘরে খন্ডাংশ জোড়া দিয়ে গঠিত বিগ্রহের একটি নমুনা সাজানো আছে। এটি ফরিদপুর থেকে সংগৃহীত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে। এসব নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয় যে, এগারো শতক পর্যন্ত সমগ্র বাংলা জুড়ে জৈনধর্ম প্রচলিত ছিল।

ধর্মীয় কর্মকান্ডে ব্যবহূত জৈন কেন্দ্রগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো নির্মাণ-কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ বাংলায় প্রায় নেই বললেই চলে। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত (আনু. পাঁচ শতক) গুপ্ত তাম্রশাসনে বটগোহালী গ্রামে একটি জৈন আশ্রমের উল্লেখ আছে। পাহাড়পুরে ১৯৮০-৮১ সালে খননকালে আট-নয় শতকের পূর্বেকার নির্মাণ কাঠামোর নিদর্শন পাওয়া গেছে। পন্ডিতগণ বিশ্বাস করেন যে, প্রাচীন এসব কাঠামো বটগোহালীর জৈন আশ্রমের সঙ্গে সর্ম্পকযুক্ত হতে পারে। তীর্থঙ্করের আরাধনায় নিবেদিত দুটি মন্দির বগুড়া শহরের সাতমাথা ও মেহেরপুর শহরের বখশী লেনে এখনও দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু স্থাপত্যশৈলীর নিরিখে এগুলি উনিশ শতকে নির্মিত। স্থানীয় জনগণের মতে ভারতের গুজরাট থেকে আগত কতিপয় বণিক কর্তৃক এগুলি নির্মিত হয়েছিল।

বাংলার জৈনরা ছিল ‘দিগম্বর’ মতাদর্শের অনুসারী। প্রাপ্ত তথ্যাবলি থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, বাংলায় প্রাপ্ত তীর্থঙ্করের বিগ্রহগুলির সবই নগ্ন। তীর্থঙ্করের প্রতিটি বিগ্রহেই কায়াতসর্গ, অন্যকথায় সমপদথানক ভঙ্গির প্রকাশ দৃশ্যমান। অল্প কয়েকটি বিগ্রহে দেখা যায় যে, তীর্থঙ্করগণ তাদের সঙ্গী তীর্থঙ্করদের দ্বারা পরিবেষ্টিত রয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তীর্থঙ্কর ছাড়া অপর কোনো বিগ্রহ পাওয়া যায় নি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের জৈনরা তীর্থঙ্করদের ছাড়াও সলক পুরুচ, আচার্য, বাহুবলী, যক্ষ-যক্ষী, চক্রবর্তী, বাসুদেব, বলদেব, শসন দেবী, দিকপাল, ক্ষেত্রপাল, নবগ্রহ, অগ্নি, নৈর্ঋত, ব্রহ্ম, শ্রুতি দেবী ও হরিণ-গোমেশের প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করে। এসব তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঐতিহাসিক যুগের গোড়ার দিকে জৈনধর্ম বাংলায় প্রচলিত থাকলেও এটি কখনই অন্যান্য অঞ্চলের মতো এদেশে ততটা বিস্তার লাভ করে নি।  [গোপাল কৃষ্ণদাস]

গ্রন্থপঞ্জি  PC Bagchi, 'Development of Religious Ideas' in RC Majumdar (ed), History of Bengal, Vol-1, Dacca, 1968 (2nd edn); AK Roy, A History of the Jainas, New Delhi, 1984.