জীববৈচিত্র্য
জীববৈচিত্র্য (Biodiversity) উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুজীবসহ পৃথিবীর গোটা জীবসম্ভার, তাদের অন্তর্গত জীন ও সেগুলির সমন্বয়ে গঠিত বাস্তুতন্ত্র। তিনটি বিভিন্ন পর্যায়ে এগুলি বিবেচ্য; বংশানুসৃত বৈচিত্র্য, প্রজাতি বৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য। বংশানুসৃত বৈচিত্র্যের মাত্রা সংখ্যায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। এটি প্রজাতি বৈচিত্র্য অপেক্ষা বহুগুণ অধিক। প্রজাতি পর্যায়ে বৈচিত্র্য সম্পর্কেও সম্পূর্ণ তথ্য জানা যায় নি। বিজ্ঞানীদের নানা হিসাব মোতাবেক প্রজাতি সংখ্যা (জীবন্ত) ৩০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি, তন্মধ্যে প্রায় ১৪ লক্ষ শ্রেণীবিন্যস্ত হয়েছে এবং তাতে আছে প্রায় ২,৫০,০০০ উদ্ভিদ, ৭,৫০,০০০ কীটপতঙ্গ, ৪১,০০০ মেরুদন্ডী, বাকিরা অন্যান্য অমেরুদন্ডী, ছত্রাক, শৈবাল ও অণুজীব। এখনও অনেক প্রজাতি অনাবিষ্কৃত রয়েছে। এ বৈচিত্র্যের অধিকাংশই রয়েছে পৃথিবীর গ্রীষ্মমন্ডলে, আর্দ্র-উষ্ণ এলাকায়, বিশেষত বনাঞ্চলে।
জীববৈচিত্র্য প্রজাতি বিলুপ্তি ঠেকাতে সহায়তা যোগায়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক চুক্তিতে দেড় শতাধিক দেশের প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশও এ চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী। সম্প্রতি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফ্লোরা এন্ড ফনা অব বাংলাদেশ’ কোষগ্রন্থে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশের এ পর্যন্ত উল্লিখিত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির প্রাথমিক তথ্যাদি সন্নিবেশিত হয়েছে। বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্যে মোট প্রজাতির সংখ্যা ১২০০০ এর বেশি। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের প্রজাতি ও বাস্ত্তসংস্থানিক উভয় পর্যায়ে লভ্য তথ্যাদি নিম্নে আলোচিত হলো।
উদ্ভিদ উর্বর পলিমাটির জমি এবং উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে খুবই সমৃদ্ধ। এদেশে উদ্ভিদের প্রজাতি সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি, তন্মধ্যে ৩০০ বিদেশি ও ৮ একান্ত দেশিয় (endemic)। বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত ৯৫ প্রজাতির দারুবৃক্ষের ৯২টি আবৃতবীজ, ৩টি নগ্নবীজ। স্বাদু ও লোনা পানিতে আছে মোট ২২৪৪ প্রজাতির শৈবাল ও তাদের জাত। ছত্রাক সম্পর্কে এখনও পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগৃহীত হয় নি। ব্রায়োফাইট প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২৫০। বাংলাদেশে জন্মে এমন ২৫০ প্রজাতির টেরিডোফাইট-এর মধ্যে ২৩০ হলো ফার্ন। সপুষ্পক (আবৃতবীজ) উদ্ভিদ আছে প্রায় ৫,০০০ প্রজাতির। এদেশে জন্মে মাত্র ৪ প্রজাতির নগ্নবীজ উদ্ভিদ তন্মধ্যে ৩টিই (১ সাইকাস, ২ নিটাম) বিপন্ন। বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির ধান রয়েছে এবং প্রকারভেদ প্রায় ১০,০০০।
Nymphaea গণের ৫০ প্রজাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশে রয়েছে ৩ প্রজাতি N. nouchali (শালুক, নীল), N. pubescens (সাদা) ও N. rubra (লাল শাপলা)। সাদা শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। এ গোত্রের আরেকটি ফুল পদ্ম (Nelumbo nucifera), সাদা ও গোলাপি দুই রঙের ফুল ফোটে, দেখতে খুবই সুন্দর। পদ্মমধু মূল্যবান ভেষজ এবং পদ্মবীজ খাওয়া যায়। Moraceae গোত্রের কাঁঠাল (Artocarpus heterophyllus) বাংলাদেশের জাতীয় ফল, তাতে থাকে ১০০-৫০০ বীজ। ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতে কাঁঠালের উদ্ভব এবং আজও সেখানে বন্য অবস্থায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বেশির ভাগ কাঁঠাল ফলে নওগাঁ, দিনাজপুর, সাভার (ঢাকা), গাজীপুর, মধুপুর (টাঙ্গাইল) ও সিলেটে।
বাংলাদেশের প্রধান বনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১. গ্রীষ্মমন্ডলীয় চিরসবুজ ও আধা-চিরসবুজ; ২. গ্রীষ্মমন্ডলীয় আর্দ্র-পত্রমোচী (দেশের অভ্যন্তরীণ বন); ৩. জোয়ারধৌত বন; এবং ৪. স্বাদুপানি বিধৌত বন। গ্রীষ্মমন্ডলীয় চিরসবুজ ও আধা-চিরসবুজ বনের সিংহভাগই রয়েছে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সমতল থেকে ৬০০ মিটার পর্যন্ত উঁচু পাহাড়ি এলাকায়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় আর্দ্র-পত্রমোচী বন কয়েকটি প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি নিয়ে গঠিত। এগুলির মধ্যে শালেরই (Shorea robusta) আধিক্য এবং এসঙ্গে সর্বত্রই আছে Terminalia ও Albizia গণের কিছু প্রজাতি। এসব বন দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত। পূর্বদিকে শালবনের শেষ সীমানা কুমিল্লা। উত্তর-পশ্চিমে এ বন কয়েকটি জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলা অতিক্রম করে অত্যন্ত ছোট হয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতের ত্রিপুরা পাহাড়ে গিয়ে মিশেছে। জোয়ারধৌত বন বা ম্যানগ্রোভ বন একটি চিরসবুজ বন, এটি ৬ মিটার বা ততোধিক উঁচু এবং গাছগুলি বিশেষভাবে জোয়ারধৌত কাদায় অভিযোজিত আর সেখানকার মাটি মাঝারি ঘনত্বের লবণপানিতে সর্বদাই আর্দ্র থাকে এবং জোয়ারের সময় নিয়মিত প্লাবিত হয়। কোনো কোনো প্রজাতি, বিশেষত Rhizophoraceae গোত্রের প্রজাতির ঠেসমূল খাড়া (Heritiera) বা চোখা (Sonneratia, Carapa, Amoora) হয়ে গজায়, আর Litsea গণের প্রজাতির শ্বাসমূল দ্বিধাবিভক্ত। এ ধরনের বন গাঙ্গেয় বদ্বীপের দক্ষিণে (সুন্দরবন) এবং দক্ষিণ-পূর্বে চট্টগ্রামের দক্ষিণে মাতামুহুরী নদীর বদ্বীপে চকোরিয়া সুন্দরবনে (বর্তমানে ধ্বংসপ্রায়) সীমাবদ্ধ। বর্ষাকালে সম্পূর্ণ প্লাবিত স্বাদুপানিধৌত বনে (স্থানীয় নাম পাজুবন) জন্মে প্রচুর নল (Phragmites karka), খাগড়া (Saccharum spontaneum), ইকড় (Eranthus ravannae) এবং কিছু বৃক্ষপ্রজাতি যেমন- হিজল (Barringtonia acutangula), জারুল (Lagerstroemia speciosa) ও পিটালি (Trewia nudiflora)। এ ধরনের বন রয়েছে দেশের উত্তর-পূর্বে সুনামগঞ্জ ও উত্তর-সিলেটের নিম্নাঞ্চলের হাওরে।
শৈবাল যথার্থ মূল, কান্ড, পত্র ও পুষ্পবিহীন এ জাতীয় উদ্ভিদ অত্যন্ত আদিম, Thallophyta পর্বের অন্তর্ভুক্ত। এ পর্বের উদ্ভিদে ক্লোরোফিল থাকে; পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তৃত শৈবাল লোনা ও স্বাদুপানির মুখ্য উদ্ভিদগোষ্ঠী। সমুদ্রের সবগুলি আগাছাই আসলে সামুদ্রিক শৈবাল। স্বাদুপানির অধিকাংশ শৈবালই নীলাভ সবুজ ও সবুজ শৈবাল। মাছের প্রধান খাদ্য এ শৈবাল জলজ খাদ্যশৃঙ্খলের মুখ্য চাবিকাঠি এবং তারাই খাদ্যবস্ত্তর প্রাথমিক উৎপাদক যা এ গোটা শৃঙ্খল সচল রাখার শক্তি যোগায়। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে জলজ জীবে অক্সিজেন সরবরাহেও এদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘকাল থেকেই কিছু কিছু সামুদ্রিক শৈবাল, বিশেষত প্রাচ্যে, খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে। সমুদ্রে সবুজ, লোহিত ও বাদামি শৈবাল। এছাড়া রয়েছে ডায়াটম ও ডাইনো ফ্লাজিট জাতীয় প্লাংকটনের বিপুল সম্ভাবনা।
বাংলাদেশে অর্ধবায়ব (গাছের কান্ড, ঘরের দেয়াল, পাথর, ধাতব খুঁটি ইত্যাদিতে জন্মে), ভূমিজ (আর্দ্র মাটিতে) ও জলজ শৈবাল আছে। জলজ শৈবাল জন্মে স্বাদুপানিতে (ডোবা, পুকুর, হাওর, বাঁওড়, ধানক্ষেত, নদী), স্বল্পলোনা পানিতে (মোহনা এলাকায়) ও সমুদ্রের পানিতে। জলাশয়ের তলবাসী ও উদ্ভিদ-প্ল্যাঙ্কটনসহ বাংলাদেশের শৈবাল প্রজাতি Cyanophyceae, chlorophyceae, Euglenophyceae, Rhodophyceae, Bacillariophyceae, Chrysophyceae, Xanthophyceae ও Chloromonadinae বর্গভুক্ত। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শৈবালের শনাক্তকৃত প্রজাতি ও ভ্যারাইটির সংখ্যা ২২৪৪।
ছত্রাক ক্লোরোফিলবিহীন এক জাতের উদ্ভিদ এবং সালোকসংশ্লেষণে অক্ষম, তাই পরজীবী বা মৃতজীবী (saprophyte)। শৈবালের মতো এদেরও যথার্থ মূল, কান্ড, পাতা ও ফুল নেই। এগুলি দুটি দলে বিভক্ত স্লাইম মোল্ড (slime mold/Myxomycota) ও প্রকৃত ছত্রাক (Eumycota)। শেষোক্তটি ৪ শ্রেণীতে বিভক্ত Phycomycetes, Ascomycetes, Bacidiomycetes এবং Deuteromycetes। পৃথিবীতে ছত্রাক প্রজাতির সংখ্যা লক্ষাধিক। বাংলাদেশে ছত্রাক প্রজাতি সম্পর্কে অনুসন্ধান শেষ হয় নি।
দেশের আর্দ্র জলবায়ু ছত্রাককুলের বৃদ্ধি ও বিকাশের অনুকূল এবং সেজন্য এখানে ছত্রাকের ব্যাপক বৈচিত্র্য স্বাভাবিক। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ বিধায় এখানকার প্রধান ফসলের ধান, আখ, পাট, চা, আলু, টমেটো, বেগুন, গম, ভুট্টা ইত্যাদির ছত্রাক পরজীবীদের ইতোমধ্যেই শনাক্ত করা হয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছত্রাকের মধ্যে ইস্ট ও খাওয়ার উপযোগী মাশরুম উল্লেখযোগ্য। এসব ছত্রাক উৎপাদন বাংলাদেশে এখনও ততটা ব্যাপক না হলেও এগুলি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
লাইকেন নীলাভ-সবুজ ও সবুজ শৈবালের সঙ্গে ছত্রাকের মিথোজীবিতামূলক সহাবস্থানে গঠিত সরল গড়নের এক ধরনের উদ্ভিদ। এগুলিকে সাধারণত পাথর, গাছের কান্ড, খুঁটি ও তদ্রূপ অন্যান্য কাঠামোয় সেঁধে থাকতে দেখা যায় এবং বাড়ে খুব ধীরে। সবুজ শৈবাল ও বর্ণহীন ছত্রাকের মিশ্রণ বিধায় লাইকেন সাধারণত হালকা-সবুজ ও ধূসর রঙের, তবে লাল, কমলা বা বাদামি রঙের প্রজাতিও দেখা যায়। সহবাসী শৈবালকোষ থেকে ছত্রাক খাদ্য সংগ্রহ করে এবং বিনিময়ে শৈবালকে সালোকসংশ্লেষণের জন্য শোষিত ও সঞ্চিত পানির একাংশ যোগায়। বংশবৃদ্ধি একত্রেই সম্পন্ন হয়। ছত্রাক উৎপন্ন এসিডের সাহায্যে পাথরের ক্ষয় ঘটিয়ে নিজেদের অবস্থান মজবুত করে এবং এ প্রক্রিয়ায় পাথর শেষ পর্যন্ত মাটিতে পরিণত হয়।
লাইকেন চরম আবহাওয়ায় অভ্যস্ত বিধায় সুমেরু, কুমেরু ও গ্রীষ্মমন্ডলসহ সর্বত্র জন্মে। এগুলি অঞ্চলবিশেষে জীবের প্রথম অগ্রযাত্রীও হয়ে থাকে। অ্যানিলিন আবিষ্কারের আগে রেশম ও পশমের রঞ্জক হিসেবে লাইকেন ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হতো। নীল ও বেগুনি রঙের লিটমাস ও আরচিল আজও লাইকেন প্রজাতি থেকেই উৎপন্ন হয়। সুগন্ধিশিল্প ও চোলাইকার্যে লাইকেন ব্যবহূত হয়। পৃথিবীতে লাইকেন প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২০,০০০ আর এগুলির শৈবাল প্রধানত Cyanophyceae ও Chlorophyceae বর্গভুক্ত এবং প্রায় সর্বত্রই এককোষী। লাইকেনভুক্ত শৈবাল হলো Nostoc, Stigonema, Rivularia, Gloeocapsa ও Trebauxia গণের প্রজাতি। লাইকেন গঠনে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ ছত্রাক Actinomycetes দলভুক্ত। বাংলাদেশের সচরাচর দৃষ্ট লাইকেনের মধ্যে আছে Parmelia, Usnea, Dermatocarpon, Phaeographina, Leptogonium, Lecanora ও Anaptychia গণের প্রজাতি।
ব্রায়োফাইটা সবুজ উদ্ভিদের একটি দল যা মস (Bryopsida), লিভারওয়ার্ট (Marchantiopsida) ও হর্নওয়ার্ট (Anthocerotopsida) নিয়ে গঠিত। পানি পরিবহণের দারুতন্ত্রের (vascular system) অনুপস্থিতির নিরিখে এগুলি ফার্ন ও সপুষ্পক উদ্ভিদ থেকে পৃথক। বাতাস বা মাটি থেকে পানি শোষণ অপরিহার্য বিধায় প্রায় সব ধরনের ব্রায়োফাইট আর্দ্র পরিবেশে জন্মে। সম্পূর্ণ জলজ ব্রায়োফাইটও আছে। মস সাধারণত ৩ বর্গে বিভক্ত, তন্মধ্যে Bryales বর্গই মুখ্য। যেখানে অন্য উদ্ভিদ নেই সেখানে ব্রায়োফাইটই প্রথম পৌঁছায় ও মাটি গঠনে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। স্ফ্যাগনাম মস প্যাকিং-এ ব্যবহূত হয় এবং এই উদ্ভিদটি থেকে পীট কয়লার সৃষ্টি হয় তবে স্ফ্যাগনাম বাংলাদেশে পাওয়া যায় নি।
ধারণা করা হয় ব্রায়োফাইটা কোনো শৈবাল থেকে বিলুপ্ত পূর্বসূরির (Rhynophyte) মাধ্যমে উদ্ভূত। ব্রায়োফাইটা মেরু থেকে গ্রীষ্মমন্ডল পর্যন্ত সর্বত্রই আছে। গোটা পৃথিবীতে এদের প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ২৪,০০০; অধিকাংশই ছোট, ২-৫ সেমি লম্বা, বাংলাদেশে ক্ষুদ্রতমটি প্রায় ৪ মিমি। অল্পসংখ্যক ব্রায়োফাইটা ৩০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু ব্রায়োফাইটার অবাধ বৃদ্ধির জন্য অনুকূল। এগুলি সারাবছরই, বিশেষত বনাঞ্চলে জন্মে। বাংলাদেশে ব্রায়োফাইটার প্রজাতিসংখ্যা প্রায় ২৫০ (৯২ গণ, ৩৪ গোত্র, ১৪ বর্গ ও ৩ শ্রেণী)। Riccia, Marchantia, Cyathodium, Dumortiera, Pallavicinia, Plagiochasma সহজেই চোখে পড়ে। এগুলো গাছের কান্ড, ডালপালা, ভিজা মাটি ও ইটের উপর জন্মায়। Lejeunia, Frullania ও Jungermannia পরাশ্রয়ী। Ricciocarpus natans ও Riccia fluitans নামের দুটি জলজ ব্রায়োফাইট আছে বাংলাদেশে। Anthocerotopsida শ্রেণীভুক্ত Anthoceros ও Notothylas সাধারণত নদী-নালার পাড়ে ভিজা মাটিতে জন্মে। Semibarbula orientalis ও Hyophila involuta দেয়াল ও ইটে এবং Calymperes, Taxithelium ও Erpodium গাছের বাকলে জন্মে। বাংলাদেশের অন্যান্য বহুদৃষ্ট মসের মধ্যে আছে Fissidens, Bryum, Splachnobryum, Hydrogonium, Physcomitrium, Philonotis, Garckea, Gymnostomiella, Leucophanes, Octoblepharum, Isopterigium, Vesicularia, Glossodelphus এবং Plagiothecium।
টেরিডোফাইটা সরল কাঠামোর উদ্ভিদ, ৪ শ্রেণীভুক্ত Psilotopsida (আদিমতম দারু-উদ্ভিদ, প্রধানত গ্রীষ্মমন্ডলে দেখা যায়), Lycopsida (ক্লাবমস), Sphenopsida (হর্সটেইল) ও Pteropsida (ফার্ন)। এগুলি স্থলজ, অপুষ্পক ও দারুতন্ত্রধর, এদের আছে যথার্থ কান্ড, মূল ও পাতা এবং সুস্পষ্ট জনুক্রম তাতে রেণুধর প্রজন্ম মুখ্য। বীজ নেই। প্রজাতিসংখ্যা প্রায় ১২,৫০০, সিংহভাগই উষ্ণমন্ডল ও উপ-উষ্ণমন্ডলে জন্মে, অধিকাংশই ফার্ন জাতীয় (প্রায় ১১,০০০ প্রজাতি)। ভারত উপমহাদেশে এ জাতীয় উদ্ভিদ প্রজাতি প্রায় ৯০০, তন্মধ্যে ৫০% একান্ত দেশিয়। বাংলাদেশের মোট ২৫০ প্রজাতির টেরিডোফাইটার মধ্যে ফার্নের সংখ্যা ২৩০ এবং স্বভাবের দিক থেকে এগুলি একাধারে পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ, সাধারণ উদ্ভিদ, শৈল-উদ্ভিদ (lithophyte) বা জলজ উদ্ভিদ।
আবৃতবীজ উদ্ভিদ পুষ্পধর উদ্ভিদ যেখানে ডিম্বক বা কচি বীজ ডিম্বাশয় বা বীজকোষের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। পক্ষান্তরে, নগ্নবীজ উদ্ভিদে বীজগুলি বীজকোষবন্দি থাকে না। আবৃতবীজের Magnoliophyta বিভাগে রয়েছে সকল কৃষি ফসল (দানাশস্য ও অন্যান্য তৃণসহ), বাগানের সব ফুল ও ফলের গাছপালা, সব প্রশস্তপত্রী বৃক্ষ ও গুল্ম এবং মাঠ, বাগান ও পথপাশের আগাছা। এসব গাছপালার অর্থনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। বাংলাদেশে দেশি ও বিদেশি মিলিয়ে আবৃতবীজের প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ৪,০০০ (২০০ গোত্র), তন্মধ্যে ৯২ প্রজাতি বিপন্ন। বাংলাদেশের ৪,০০০ প্রজাতির মধ্যে ১৫টি একান্তভাবে দেশিয়।
নগ্নবীজ বীজ উন্মুক্ত, অর্থাৎ বীজ কোষে আবদ্ধ নয় এমন উদ্ভিদ। এ জাতীয় উদ্ভিদের ফুলে গর্ভকেশর এবং দারুতন্ত্রে ভেসেল থাকে না। এদের টিকে থাকা বৃহত্তম দল হলো পাইনবর্গ যাদের বৈশিষ্ট্য সরু, সুচাকার পাতা ও কোণাকৃতি মঞ্জুরি। পৃথিবীব্যাপী এদের প্রজাতিসংখ্যা প্রায় ৭২৫ (গণ ৭০)। নগ্নবীজেরা বিবর্তনের ধারায় অপুষ্পক (টেরিডোফাইটা/ফার্ন) থেকে আবৃতবীজের উৎপত্তির ধারায় একটি অন্তর্বর্তী পর্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে, কেননা এদের মধ্যে দুই দল উদ্ভিদেরই কিছু কিছু চরিত্র বিদ্যমান। প্রায় ৩৫ কোটি বছরের পুরানো নগ্নবীজের ফসিল পাওয়া গেছে। এগুলি মুখ্যত নাতিশীতোষ্ণ, উপ-পার্বত্য ও উপ-হিমালয় অঞ্চলের উদ্ভিদ।
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ে এদের ৪টি প্রজাতি আছে Cycas pectinata, Gnetum scandens, G. funiculare ও Podocarpus nerifolia এবং শেষেরটি ছাড়া বাকি ৩টি প্রজাতিই এখন বিপন্ন, আর সেটা ঘটেছে মূলত আবাসস্থলের বিনষ্টি এবং নানা কাজে অতিমাত্রায় সংগ্রহের জন্য। কয়েক প্রজাতির বিদেশি পাইনের (Pinus carribeana) চাষ চলছে পার্বত্য এলাকায় এবং কিছু আছে পার্ক ও বাগানে (Cycas, Pinus, Araucaria, Cupressus, Thuja) অভিযোজিত হয়ে।
কৃষি জীববৈচিত্র্য কৃষি কর্মসূচিতে ব্যবহূত জীবসম্পদ। দেশের কৃষি বাস্তুসংস্থানিক ভিন্নতার দরুন মানুষ শত শত বছর ধরে ব্যবহারের জন্য ১,৩৬৪ প্রজাতির বেশি দেশি-বিদেশি উদ্ভিদ চাষ ও সংরক্ষণ করে আসছে। বাংলাদেশে ১৭৫ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ রয়েছে। আট থেকে দশ হাজার বছরের পুরানো কৃষি সভ্যতার ধারাবাহিকতার ফসল হলো এখানকার চাষিদের হাতে উৎপন্ন ধান, পাট, আখ, তুলা, তিসি, সরিষা, শসা, শিম, কুমড়া, কলা ও আম ইত্যাদির অজস্র প্রকারভেদ। বসতবাড়ির আঙিনায়ও অনেক জাতের গাছগাছড়ার চাষ হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে ধানের ৩টি প্রজাতি রয়েছে, Oryza sativa, O. coaractata, এবং O. rufipogon। এদের কৃষি প্রকরণের সংখ্যা প্রায় ১০,০০০। সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ধানের বুনো প্রজাতি আছে। গোপালগঞ্জ ও সিলেটের বিলাঞ্চল জলিধানের উৎপত্তিস্থল হিসেবে বিবেচিত। উচ্চফলনশীল (উফশী/HYVs) জাতের ধান চাষ শুরুর ফলে অনেক জাতের দেশি ধান ইতোমধ্যেই লোপ পেয়েছে। গম (Triticum aestivum) এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান দানাশস্য। একটি দেশি জাত ছাড়া, অন্য সবগুলি ‘উদ্ভিদ বংশানুসৃত সম্ভার’ই (plant genetic resource/PGR, 15,739) বিদেশ থেকে আনা। অন্যান্য গৌণ দানাশস্যের সবগুলিই দেশি। অল্প কয়েক জাতের কাউন আর চীনাও আছে। পাটের ক্ষেত্রে তিতাপাট/সাদাপাটের (Corchorus capsularis) ৯৫৮টি সংযোজন রয়েছে। দশটি মরসুমি তৈলপ্রদায়ী প্রজাতির আছে ১২ শতাধিক PGR। সরিষা (Brassica campestris) এবং রেপসিড (B. juncea) দুটিই দেশি ও বিদেশি উৎসজাত। এসব প্রজাতির লভ্য প্রায় ৫০০ PGR নতুন জাত উৎপাদনের জন্য ব্যবহূত হচ্ছে। তদুপরি, B. napus, B. carinata, ও B. nigra বাংলাদেশে ১৯৭০ দশকে প্রবর্তিত হয়েছিল। চীনাবাদাম (৪২০ PGR), সয়াবিন (১৪৫ PGR) ও তিল (১৩২ PGR) আরও তিনটি তৈলপ্রদায়ী প্রজাতি। বাংলাদেশে আমেরিকান জাতের সয়াবিনের চাষ শুরু ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বুনোজাতের দেশি সয়াবিনের PGR পাওয়া যেতে পারে। কিছুকাল আগে বাংলাদেশে তৈলপ্রদায়ী পামগাছের চাষ শুরু হয়েছে। ডাল ও দানাশস্যের ৭০৯৯ PGR-এর মধ্যে ৩৪৬৩ দেশি (স্থানীয় ৮ প্রজাতির), অবশিষ্টগুলি আমদানিকৃত। বাংলাদেশ আখের উৎসস্থল বলে মনে করা হয়। আখের আছে অনেকগুলি PGR: ৪৫৯ Saccharum officinarum, ২৬ S. spontaneum।
এদেশে আছে উচ্চতর PGR বিশিষ্ট ৩৩টি সাধারণ ফলের প্রজাতি। আম, বাতাবিলেবু, পেয়ারা ও কাঁঠালের মোট ৪৬৩ প্রকারভেদ বিভিন্ন ইনস্টিটিউট ও বাগানে শনাক্ত করা হয়েছে। গৌণ ফলের যোগানদার ৫৪ প্রজাতি এবং সেগুলির প্রায় ২৯৮ প্রকারভেদের মধ্যে ২০৭টি স্থানীয়। দেশে রয়েছে ৫২ প্রজাতির সবজির বুনো ফল। তিন ধরনের সবজির PGR থেকে পাওয়া যায় মূল ও স্ফীতকন্দ (১১ প্রজাতি), পাতা (৮ প্রজাতি) ও ফল (২০ প্রজাতি)। এ ৩৯ প্রজাতির সবজির PGR সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। চায়ের স্থানীয় ক্লোন সংখ্যা প্রায় ২৪৬ এবং প্রবর্তিত প্রকারভেদ প্রায় ২৮। কফির আছে ৩টি প্রজাতি, কিন্তু এদেশে কফির বাণিজ্যিক চাষ এখনও সফল হয় নি।
বনজ উদ্ভিদ বাংলাদেশে সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ৪,০০০ এবং তন্মধ্যে ৭০০ বনবৃক্ষ। দারু-উদ্ভিদের সর্বাধিক সংখ্যা Leguminosae গোত্রভুক্ত, এরপর যথাক্রমে অন্যান্য গোত্র- Euphorbiaceae, Moraceae, Lauraceae, Verbenaceae ও Myrtaceae। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম দলের বৃক্ষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য Dipterocarpus turbinatus, D. costatus, Artocarpus chama, Swintenia floribunda, Protium serratum, Toona ciliata, Canarium resiniferum, Calophyllum polyanthum, Michelia champaca, Pterygota alata, Tetrameles nudiflora, Amoora chittagonga, Aphanamixis polystachya, Chukrasia tabularis, Podocarpus nerifolia, Syzygium species, ইত্যাদি। পত্রমোচীদের মধ্যে আছে Albizia procera, Bombax ceiba, B. insignis, Garuga pinnata, Adina cordifoloia, Hymenodictyon orixensis, Duabanga grandiflora, Dillenia pentagyna, Gmelina aborea, Terminalia species। সচরাচর দৃষ্ট বাঁশের প্রজাতির মধ্যে রয়েছে Melocanna baccifera, Bambusa burmanica, B. polymorpha, B. tulda, Schizostachyum dullooa এবং Dendrocalamus longispathus।
সিলেটের বনের দীর্ঘতম প্রজাতির মধ্যে আছে Artocarpus chama, A. lacucha (=A. lakoocha), Elaeocarpus robustus, Holigarna caustica, ও Dysoxylum species। মাঝারিদের মধ্যে রয়েছে Mesua ferra, Amoora wallichii, Palaquium polyanthum, Sapium baccatum, Chisocheton spp, Lagerstroemia speciosa, Duabanga grandiflora, Schima wallichii, ইত্যাদি। পত্রমোচীদের মধ্যে Bombax ceiba, Adina cordiflia, Hymenodictyon orixensis, Spondias pinnata ও Ficus species উল্লেখযোগ্য। গুল্মবনের মুখ্য প্রজাতি Schima wallichii, Sterculia villosa, Vitex peduncularis ও Engelhardtia spicata। খাটো জাতের পাম, Licuala species জাফলং অঞ্চলে দেখা যায়।
শাল (Shorea robusta) আর্দ্র পত্রমোচী (moist deciduous) বনের মুখ্য প্রজাতি। শালের সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য পত্রমোচী প্রজাতি Adina cordifolia, Albizia procera, Bombax ceiba, Butea monosperma, Lagerstroemia parviflora, Dillenia pentagyna, Garuga pinnata, Hymenodictyon orixensis, Semecarpus anacardium, Miliusa velutina, Schleichera oleosa, এবং Terminalia bellerica।
সুন্দরবনের মুখ্য প্রজাতি হলো সুন্দরী (Heritiera fomes) এবং এর সঙ্গে প্রধানত আছে Excoecaria agallocha, Bruguiera sexangula, B. gymnorrhiza, Avicennia alba, A. officinalis ও Sonneratia apetala, Xylocarpus mekongensis, X. granatum, Lumnitzera racemosa, Rhizophora mucronata, Ceriops decandra, Cynometra ramiflora এবং Amoora cucullata। গোলপাতা (Nypa fruticans) দেখা যায় নিয়মিত জোয়ারধৌত নদী ও খালের পাড়ে।
প্রাণী দেশের অমেরুদন্ডী প্রাণীর তালিকা তৈরির কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। এখানকার উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু নিম্নশ্রেণীর প্রাণী, বিশেষত কীটপতঙ্গের সংখ্যাবৃদ্ধির অত্যন্ত অনুকূল। মেরুদন্ডীদের (মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী) তালিকা প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে বলা যায়।
ইলিশ (Temalosa ilisha) বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এটির অন্য ঘনিষ্ঠ প্রজাতি Tenualosa toli। এ মাছ প্রজনন মৌসুমে সমুদ্র থেকে নদীতে প্রবেশ করে। অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক খাতে মৎস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ইলিশের একক অবদান বৃহত্তম। দোয়েল (Copsychus saularis) বাংলাদেশের জাতীয় পাখি। কালো ও সাদা রঙের শরীর ও উপরের দিকে তোলা লেজের এ পাখিটি সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে। স্ত্রী পাখির তুলনায় পুরুষ পাখির রং বেশি উজ্জ্বল। বাংলার বাঘ (Panthera tigris tigris) পৃথিবীর বৃহত্তম বিড়ালগোষ্ঠীর সদস্য। এটি বাংলাদেশের জাতীয় পশু। এক সময়ে দেশের সর্বত্র থাকলেও বর্তমানে আছে শুধুই সুন্দরবনে এবং অত্যন্ত বিপন্ন প্রাণী হিসেবে।
অমেরুদন্ডী প্রাণী Homoptera বর্গের পতঙ্গের মধ্যে পাতা ফড়িং ও জাবপোকাসহ (aphid) আজ পর্যন্ত অনেক প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। Hymenoptera বর্গের মৌমাছি, বোলতা, পিঁপড়াসহ বহু প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে। এদের অনেকেই কলোনিবদ্ধ থাকে, সকলেই ফুলের নির্যাস ও পরাগ খায়। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত শনাক্ত মৌমাছি ও ভ্রমরের ১৮ প্রজাতির মধ্যে ৪টি মৌমাছি Apis cerana indica, A. dorsata, A. florea, A. mellifera এবং ২ প্রজাতির ভীমরুল Bombus eximius (সিলেট) ও B. montivagus (পার্বত্য চট্টগ্রাম) উল্লেখযোগ্য।
অমেরুদন্ডী প্রাণী | |
বিটল Coleoptera বর্গের সদস্য। প্রাণী জগতে প্রজাতি সংখ্যার হিসাবে Coleoptera বৃহত্তম বর্গ। এতে রয়েছে অনেক বড় গলিয়াথ ও হারকিউলিস বিটল (১৫ সেমি বা ততোধিক লম্বা), বিভিন্ন দলের বিটল-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বার্ক বিটল, বমবার্ডিয়ার বিটল, কার্ডিনাল বিটল, ক্যারিয়ন বিটল, ডেথওয়াচ বিটল, ডার্মেস্টিড বিটল, ডাইভিং বিটল, ফায়ার ফ্লাই, গ্রাউন্ড বিটল, লেডিবার্ড বিটল, লিফ বিটল, লং হর্নড বিটল, রাভ বিটল, স্ক্যারাবিড বিটল, টেনিব্রিয়নিড বিটল, উইভিল ইত্যাদি। বাংলাদেশে গুবরেপোকার ৩৫ প্রজাতি এ পর্যন্ত শনাক্ত করা গেছে, সেগুলির অধিকাংশই Onthophagous (২০ প্রজাতি) ও Cathersius (৫ প্রজাতি) গণদ্বয়ের অন্তর্ভুক্ত। পাতাভুক গোবরে পোকারও প্রায় ৩০ প্রজাতি বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। গোটা বিশ্বে লেডিবার্ড বিটলের রয়েছে ৪৯০ গণভুক্ত প্রায় ৪,২০০ প্রজাতি, তন্মধ্যে বাংলাদেশে আছে ৮০ প্রজাতির উপকারী ও ১৩ প্রজাতির উদ্ভিদভুক অপকারী লেডিবার্ড। বাংলাদেশের শস্যক্ষেত থেকে সংগৃহীত লেডিবার্ডের প্রধান গণের মধ্যে উল্লেখ্য Micraspis, Coccinella, Harmonia, Menochilus, Cheilomenes, Propylea ও Brumus। জোনাকি পোকা Coleoptera বর্গের Lampyridae গোত্রের একটি ছোট নিশাচর আলো উৎপাদনকারী মাংসাশী বিটল। গোটা বিশ্বে জোনাকির আছে প্রায় ২০০০ প্রজাতি, তন্মধ্যে এশিয়ায় ২৮০ প্রজাতি ও বাংলাদেশে ২০ প্রজাতি (Lamprophorus tenebrous, Lampyris marginella, Luciola chinensis, L. ovalis ইত্যাদি)।
প্রকৃত মাছিরা Diptera বর্গভুক্ত পতঙ্গ। সারা বিশ্বে এদের শনাক্তকৃত প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ৮৫০০০। বাংলাদেশে রয়েছে ঘরের মাছি (Musca domestica), ক্ষুদে মাছি (Fannia canicularis), ডাঁশ (Stomoxys), নীলমাছি (Calliphora), সবুজ মাছি (Lucilia) ও মাংসের মাছি (Sarcophaga)। অন্যান্য মাছির মধ্যে আছে ব্ল্যাক ফ্লাই, ডিয়ার ফ্লাই, হর্স ফ্লাই, হোভার ফ্লাই, ক্রেইন ফ্লাই ইত্যাদি। এ পর্যন্ত ফলের মাছির ৫ প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে Dacus (Zeugodacus) cucurbitae, D. (Z) tau, D.(Hemigymnodacus) diversus, D. (Bactrocera) dorsalis, এবং D. (B) zonatus।
Diptera বর্গের Culicidae গোত্রের মশা রক্তশোষণকারী পতঙ্গ। এদের মুখ্য গণ Anopheles, Culex, Aedes, Mansonia, Psorophora ও Haemagogus। ডিম পাড়ার জন্য অপরিহার্য বিধায় কেবল স্ত্রী মশা উষ্ণরক্তের মেরুদন্ডীর রক্ত চুষে থাকে। পুং-মশা ফুলের নির্যাস খেয়ে বাঁচে। পৃথিবীতে মশা প্রজাতির সংখ্যা ১৬ হাজারের বেশি, তন্মধ্যে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ১১৩ প্রজাতি। Anopheles dirus, An. philippinensis, An. minimus, An. sundaicus ম্যালেরিয়ার বাহক। ফাইলেরিয়ার বাহক Culex quinquefasciatus এবং Mansonia sp. আর ডেঙ্গু ছড়ায় Aedes aegypti ও Ae. albopictus। জাপানি এনসেফালাইটিসের বাহক Culex tritaeniorhynchus।
Araneae বর্গের Arachnida শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত মাকড়সার আছে ৪ জোড়া পা, মোটা পেট এবং সংযুক্ত মাথা ও বুক। অধিকাংশ মাকড়সা স্থলচর ও শিকারি। পৃথিবীতে এদের ১০৬ গোত্রে ৩,৪৫০ গণের জানা প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩৭,২৯৬। বাংলাদেশে আছে ১৭ গোত্রের ৯৫ গণের ২৯৯ প্রজাতি এবং এদের সিংহভাগ Araneidae (৭৩), Salticidae (৬৩), Tomisidae (২৭), Theridiidae (১৩), Tetragnathidae (১৩), Clubionidae (২৬), Lycosidae (৩০) ও Oxyopidae (২২) গোত্রভুক্ত।
Crustacea শ্রেণীর সদস্যরা মুখ্যত জলজ, কয়েকটি স্থলভাগের আর্দ্র জমির বাসিন্দা, আর কিছু পরজীবী। এ শ্রেণীতে আছে কাঁকড়া, চিংড়ি, লবস্টার, বার্নাকল, জলজ-ফ্লি, হারমিট ক্রাব, সো বাগ, পিল বাগ ইত্যাদি। বিশ্বে এ শ্রেণীর প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ৫২,০০০। বাংলাদেশে ১৮৫। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্বাদু ও লোনা পানির কাঁকড়া, গলদা ও বাগদা চিংড়ি বাংলাদেশে পর্যাপ্ত। স্বাদুপানির পাঁচ ও সামুদ্রিক ৩৫ প্রজাতির কাঁকড়া বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে এবং এগুলির মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে সর্বাধিক সংগৃহীত olivacea প্রজাতি হলো মাইট্য কাঁকড়া Scylla serrata (mud crab or mangrove crab)। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক প্রজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য Portunus pelagicus, P. sanguinolentus ও Charybdis feriatus।
বাংলাদেশে ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া আছে। এর মধ্যে কয়েকটি বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাদুপানির পাঁচ প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে শুধু Sartorina spinigera খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়।
বাংলাদেশে স্বাদুপানি (prawn) ও লোনাপানির চিংড়ি (shrimp) প্রজাতির সংখ্যা যথাক্রমে ৩১ ও ৩৪। স্বাদুপানির গলদা চিংড়ির (Macrobrachium rosenbergii) বাণিজ্যিক গুরুত্ব সমধিক। Penaeus গণের ৮ প্রজাতির মধ্যে চামা চিংড়ি (Penaeus merguiensis) ও বাগদা চিংড়ি (P. monodon) উল্লেখযোগ্য। তবে হরিণা চিংড়ি (Metapenaeus monoceros) এবং নোনা চিংড়ির (M. brevicornis) চাহিদাও যথেষ্ট। বঙ্গোপসাগরে ৪ প্রজাতির লবস্টার (lobster) পাওয়া যায় এবং এদের দুটি অর্থকরী Panulirus polyphagus ও Thenus orientalis। স্বাদুপানির গুরুত্বপূর্ণ জুপ্লাঙ্কটন Daphnia, Cypris ইত্যাদি অনেক ধরনের মাছ ও চিংড়ির খাদ্য। পরজীবী মেছো-উকুন Argulus স্বাদুপানির নানা জাতের মাছকে আক্রমণ করে। সামুদ্রিক জুপ্লাঙ্কটনের মধ্যে Copepoda শ্রেণীর ২০ প্রজাতিই মুখ্য।
Echinodermata পর্বের সব সদস্য সামুদ্রিক। এ পর্বভুক্ত প্রায় ৬,০০০ প্রজাতির মধ্যে আছে স্টারফিশ, সি-আর্চিন, স্যান্ড ডলার, সি-কিউকাম্বার, ব্রিটলস্টার, সি-লিলি, ফেদার স্টার ইত্যাদি। অরীয় প্রতিসাম্য ও পানি সংবহনতন্ত্র এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে স্যান্ড ডলার, স্টারফিস, সি-কিউকাম্বার ও সি-আর্চিন পাওয়া যায়।
মেরুদন্ডী প্রাণী মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ীরা এ দলের অন্তর্ভুক্ত। গোটা পৃথিবীতে মাছের প্রজাতি প্রায় ২৯,০০০; উভচরের ৫,০০০; সরীসৃপের ৭,৪০০; পাখির ৯,৭০২ ও স্তন্যপায়ীর ৪,৬২৯। বাংলাদেশের বনভূমি ও জলাভূমি মেরুদন্ডী প্রাণীতে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের প্রায় ১,৬০০ প্রজাতির মেরুদন্ডীর মধ্যে রয়েছে ৬৫৩ প্রজাতির মাছ (অভ্যন্তরীণ ২৫৯ ও সামুদ্রিক ৪০২), ৩২ প্রজাতির উভচর, ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপ (অভ্যন্তরীণ ১০৯, সামুদ্রিক ১৭), ৬২৮ প্রজাতির পাখি (স্থায়ী ৩৮৮, পরিযায়ী ২৪০) ও ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী (অভ্যন্তরীণ ১১০, সামুদ্রিক ৩)।
গত শতাব্দীতে ১ ডজনেরও বেশি মেরুদন্ডী প্রাণী বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে। IUCN-বাংলাদেশ (২০০০) কর্তৃক দেশের মেরুদন্ডী প্রাণিকুলের বর্তমান অবস্থার মূল্যায়ন অনুসারে বিভিন্ন পর্যায়ের বিপন্ন প্রজাতির সংখ্যা নিম্নরূপ মাছ ৫৪, উভচর ৮, অভ্যন্তরীণ (সামুদ্রিক নয়) সরীসৃপ ৫৮, স্থায়ী বাসিন্দা পাখি ৪০, অভ্যন্তরীণ স্তন্যপায়ী ৪০। তথ্যাভাবে অনেকগুলি প্রজাতি সম্পর্কে কোনো মূল্যায়ন সম্ভব হয় নি।
মাছ পৃথিবীতে ৪৫০ গোত্রের প্রায় ২৯,০০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে, তন্মধ্যে প্রায় ৪০% স্বাদুপানির বাসিন্দা। বাংলাদেশে ১৮ বর্গ ও ১২৩ গোত্রের ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ আছে, এর মধ্যে কোমলাস্থিবিশিষ্ট (শ্রেণী Chondrichthyes) ৩ বর্গ ও ১৫ গোত্রের ৫৬ প্রজাতি; আর কঠিনাস্থিবিশিষ্ট (শ্রেণী Osteichthyes) ১৫ বর্গের ১০৮ গোত্রের ৩৮৬ প্রজাতি। অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে (স্বাদুপানি ও স্বল্পলোনা পানিসহ) আছে ১৪ বর্গ ও ৬১ গোত্রের ২৫১ প্রজাতি। অভ্যন্তরীণ মাছের মধ্যে Cyprinidae গোত্র (বর্গ Cypriniformes) বৃহত্তম, তাতে আছে ২৩ গণ ও ৫৭ প্রজাতি কার্প (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউস ইত্যাদি), বার্ব (পুঁটি, মহাশোল ইত্যাদি), মিনো (দারকিনা, চেলা, মলা ইত্যাদি)।
বাংলাদেশের স্বাদুপানিতে আছে ৫৪ প্রজাতির ক্যাটফিশ (টেংরা, আইড়, সিংগি, মাগুর ইত্যাদি)। জলাভূমিতে এক সময়ে পর্যাপ্ত শোল, টাকি, গজার ইত্যাদি মাছ দেখা যেত, এখন এসব দুর্লভ হয়ে উঠছে। Channidae গোত্রের ৫ প্রজাতির মধ্যে ৩টি বিপন্ন; পিপলা শোল (Channa barca) অত্যন্ত বিপন্ন, গজার (Channa marulius) বিপন্ন এবং তেলোটাকি বিপন্নপ্রায়। বাইমের মধ্যে কুচিয়া (Monopterus) একক উদরীয় ফুলকা ছিদ্রের জন্য বিশিষ্ট এবং একদা পর্যাপ্ত থাকলেও বর্তমানে বিপন্নপ্রায়। দেখতে চমৎকার তারাবাইমও (Macrognathus aral) বিপন্নপ্রায়। Snake eel খারু বা হিজরা বাইমের (Pisodonophis) দুটি প্রজাতি স্থানীয় লোকেরা খায় না বিধায় এখনও নিরাপদ। বৃহত্তর বাইম বামশ/তেলকমা (Anguilla bengalensis) স্বাদুপানি ও মোহনায় দেখা যায়। কাইকা/কুমিরের খিল (Microphis deocata) এখন বিপন্ন। প্রায় ৭৫ প্রজাতির মাছ স্বাদু ও লোনা উভয় পানিতেই পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে ইলিশ (Tenualosa ilisha) সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। একক প্রজাতি হিসেবে নদী থেকে এটিই সর্বাধিক পরিমাণে সংগৃহীত হয়। পুকুরের মাছের মধ্যে কার্পেরই আধিক্য। সুস্বাদু মাছ হিসেবে Perciformes বর্গের কই (Anabas testudineus) বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ বর্গের সিংহভাগ প্রজাতিই সামুদ্রিক, তবে অনেকেই যেমন তক-চামা, পোয়া, তপসি, বাটা ও রূপচাঁদা মোহনা ও নদীতে আসে।
উভচর পৃথিবীতে সর্বমোট উভচর প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৫,০০০। কুনোব্যাঙ ও সোনাব্যাঙেরই রয়েছে ২৮ গোত্র, ৩৩৮ গণ ও ৪,৩৬০ প্রজাতি এবং এগুলির, বিশেষত Ranidae গোত্রের সদস্যরা সর্বত্রই আছে। বাংলাদেশে Amphibia শ্রেণীর প্রজাতিরা শুধুই Anura বর্গের (কুনোব্যাঙ, সোনাব্যাঙ) সদস্য। Gymnophiona (caecilians: ৫ গোত্র, ৩৪ গণ, ১৫৬ প্রজাতি) এবং Caudata (স্যালামান্ডার, নিউট ১০ গোত্র, ৬৩ গণ ও ৪৪০ প্রজাতি) বর্গের কোনো সদস্য বাংলাদেশে নেই। দেশের ৩২ প্রজাতির উভচরের মধ্যে ৮টি বিপন্ন। বাংলাদেশ ১৯৮৮-১৯৯৩ সালে সোনাব্যাঙের (Hoplobatrachus tigerinus) পা রপ্তানি থেকে ২.৬ কোটি মার্কিন ডলার অর্জন করে। বর্তমানে ব্যাঙের পা রপ্তানি নিষিদ্ধ।
ব্যাঙের জীববৈচিত্র্য | |
সরীসৃপ Reptilia শ্রেণীতে কচ্ছপ, টিকটিকি, গিরগিটি, সাপ, গুইসাপ ও কুমির। এগুলি প্রধানত চতুষ্পদী, কিন্তু সাপ ও কিছু গিরগিটির পা লোপ পেয়েছে। ডাইনোসররাও সরীসৃপ, প্রায় ১০ কোটি বছর স্থলভাগে প্রাধান্য বিস্তার করে বিলুপ্ত হয়েছে ৬.৫ কোটি বছর আগে। বাংলাদেশে সরীসৃপের মোট প্রজাতি ১২৬ (১০৯ অভ্যন্তরীণ, ১৭ সামুদ্রিক)। অভ্যন্তরীণ ১০৯ প্রজাতির মধ্যে ২ কুমির, ২২ কাছিম ও কাউঠা, ১৮ টিকটিকি ও ৬৭ সাপ। সামুদ্রিক সরীসৃপের মধ্যে ১২ প্রজাতির সাপ ও ৫ প্রজাতির কাছিম ও কাউঠা। বাদা কুমির (Marsh crocodile) Crocodylus palustris আর প্রাকৃতিক পরিবেশে নেই। অভ্যন্তরীণ সরীসৃপের প্রায় ৫৮ প্রজাতি এখন বিভিন্ন পর্যায়ে বিপদের সম্মুখীন ১২ (২ কুমির, ৭ কাছিম ও কাউঠা, ১ টিকটিকি ও ২ সাপ) মারাত্মক বিপন্ন; ২৪ (১১ কাছিম ও কাউঠা, ২ টিকটিকি, ১১ সাপ) বিপন্ন এবং ২২ (২ কাছিম ও কাউঠা, ৫ টিকটিকি, ১৫ সাপ) বিপন্নপ্রায়। বঙ্গোসাগরের ৫ প্রজাতির কাছিম ও কাউঠা সর্বত্রই বিপন্ন Hawksbill turtle (Eretmochelys imbricata) অত্যন্ত বিপন্ন এবং Loggerhead turtle (Caretta carett), Green turtle (Chelonia mydas), Olive ridley turtle (Lepidochelys olivacea) ও Leatherback turtle (Dermochelys coriacea) বিপন্ন।
কাছিম Testudines বর্গের ১২ গোত্রভুক্ত ২৫০ প্রজাতির কাছিম ও কাউঠা সারা বিশ্বের উষ্ণমন্ডল ও নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশে রয়েছে ৫ গোত্রের (৩ অভ্যন্তরীণ ও ২ সামুদ্রিক) ২৭ প্রজাতি (২২ অভ্যন্তরীণ, ৫ সামুদ্রিক)। অভ্যন্তরীণ ২২ প্রজাতির মধ্যে ২০ প্রজাতিই নানাভাবে বিপদগ্রস্ত। এদের ৭ প্রজাতি অত্যন্ত বিপন্ন, ১১ বিপন্ন ও ২ বিপন্নপ্রায়। বাকি ২ প্রজাতির অবস্থা তথ্যাভাবে জানা যায় নি। অতি বিপন্ন প্রজাতিগুলির মধ্যে রয়েছে বড় কাউঠা (Batagur baska), ধুর কাছিম (Kachuga dhongoka), হলুদ পাহাড়ি কাছিম (Indotestudo elongata), পাহাড়ি কাছিম (Manouria emys), বোস্তামি কাছিম (Aspideretes nigricans), সিম কাছিম (Chitra indica) এবং জাতা কাছিম (Pelochelys bibroni)।
টিকটিকি সারা পৃথিবীতে ২৬ গোত্রের প্রায় ৪,৩০০ প্রজাতির টিকটিকি রয়েছে। বাংলাদেশের টিকটিকি বর্গ Lacertilia ৪ গোত্র Gekkonidae, Agamidae, Scincidae ও Varanidae ও ১৮ প্রজাতিতে (সবগুলিই অভ্যন্তরীণ) অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে ৮টি নানা পর্যায়ে বিপদগ্রস্ত। একটি, উড়ুক্কু টিকটিকি (Draco blanfordii) অতি বিপন্ন, কালোগুই (Varanus salvator) ও সোনাগুই (Varanus flavescens) বিপন্ন এবং অবশিষ্ট ৫টি প্রজাতি বিপন্নপ্রায়।
সাপ সারাবিশ্বে ১৮ গোত্রের প্রায় ২,৭০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে এবং এর সিংহভাগই উষ্ণমন্ডলে। বাংলাদেশে ৭ গোত্রের (৬ অভ্যন্তরীণ, ১ সামুদ্রিক) ৭৯ প্রজাতি (অভ্যন্তরীণ ৬৭ ও সামুদ্রিক ১২) আছে। অভ্যন্তরীণ ১৫ প্রজাতি বিষাক্ত (Elapidae গোত্রের ১০ ও Viperidae গোত্রের ৫)। সামুদ্রিক সবগুলি সাপই বিষাক্ত। বাংলাদেশের অতি বিপন্ন সাপ হলো অজগর (Python reticulata) ও চন্দ্রবোড়া (Vipera russellii) ১১ প্রজাতি বিপন্ন, ১৫ প্রজাতি বিপন্নপ্রায়।
কুমির ও ঘড়িয়াল Crocodilia বর্গের মাংসাশী সরীসৃপ। এ বর্গের ৩টি গোত্রের সব সদস্য উষ্ণমন্ডল ও উপ-উষ্ণমন্ডলের বাসিন্দা ১. Crocodylidae- কুমির ১৩ প্রজাতি; ২. Alligatoridae- অ্যালিগেটর ২ প্রজাতি ও কেইমান ৫ প্রজাতি; ৩. Gavialidae, ঘড়িয়াল ২ প্রজাতি। বাংলাদেশে আছে ১ প্রজাতির কুমির ও ১ প্রজাতির ঘড়িয়াল। লোনাপানির কুমির নামে পরিচিত বৃহত্তম কুমির (Crocodylus porosus) সুন্দরবনের বাসিন্দা। বাদার কুমির (C. palustris) বা স্বাদুপানির কুমির আছে ভারত ও শ্রীলঙ্কায়। বাংলাদেশে এটি আর প্রাকৃতিক পরিবেশে নেই, বাগেরহাটে হজরত খান জাহান আলীর দরগার দিঘিতে কয়েকটি এখনও টিকে (৪/৫) আছে।
Gavialidae গোত্রে রয়েছে দীর্ঘ ও সরু তুন্ডের দুই প্রজাতির কুমির। বাংলাদেশের ঘড়িয়াল (Gavialis gangeticus) উত্তরাঞ্চলে পদ্মা নদীতে এখনও মাঝে মধ্যে দেখা যায়।
পাখি Aves শ্রেণীর বর্গ ও প্রজাতি সংখ্যা যথাক্রমে ২৪ ও ৯,০০০। গায়ক পাখি (passerines) হিসেবে খ্যাত Passeriformes বর্গে রয়েছে অর্ধেকের বেশি পাখি প্রজাতি। অবশিষ্ট বর্গগুলিকে একত্রে non-passerines বলা হয়। ভারতে পাখির প্রজাতি সংখ্যা ১২০০ বা ততোধিক আর বাংলাদেশে আছে ৬৫০ (১৬ বর্গ, ৬৪ গোত্র; ২৭৬ গায়ক, ৩৭৪ অগায়ক)। তন্মধ্যে ৩০১ স্থায়ী (১৬ বর্গ, ৬০ গোত্র; ১৭১ গায়ক, ২১৭ অগায়ক)। বড় সারস (Grus antigone) উপমহাদেশের বৃহত্তম (দাঁড়ানো অবস্থায় উচ্চতা ১,৭৫ মি) পাখি, এখন বাংলাদেশে দুষ্প্রাপ্য। চড়ুইর চেয়ে ছোট অল্পসংখ্যক ফুলঝুরি ও সানবার্ড সম্ভবত ক্ষুদ্রতম পাখি।
বাংলাদেশে পাখির সংখ্যা দ্রুত কমছে। সম্প্রতি ৪১ প্রজাতির পাখি (স্থায়ী ৩৮৮ প্রজাতির পাখির মধ্যে) বাংলাদেশে বিপন্ন, তন্মধ্যে ১৯ অত্যন্ত বিপন্ন, ১৮ বিপন্ন ও ৪ বিপন্নপ্রায়। তথ্যাভাবে স্থায়ী পাখির ১৪৮ প্রজাতির অবস্থা মূল্যায়ন সম্ভব হয় নি। গোলাপি শির (Rhodonessa caryophyllacea), বুঁচাহাঁস (Sarkidioris melanotos), বর্মী ময়ূর (Pavo muticus) ও ময়ূর (P. cristatus) প্রজাতিগুলি ৭০/৮০ বছর আগে এদেশে সর্বত্র দেখা গেলেও এখন বলতে গেলে বিলুপ্ত।
স্তন্যপায়ী বর্তমানে পৃথিবীতে আছে ৪,৫০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, তন্মধ্যে এক-দশমাংশ ভারত উপমহাদেশে। বাংলাদেশে আছে ১২টি বর্গ ও ৩৬ গোত্রের ১১৯ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ স্তন্যপায়ী এবং ১টি বর্গ ও ৪টি গোত্রের ৫টি সামুদ্রিক প্রজাতি। এতে আছে কয়েক গ্রাম ওজন ও কয়েক সেমি লম্বা ছুঁচো ও চামচিকা থেকে ৩ মিটার উঁচু ও ৪ মে টনের বেশি ওজনের হাতি। বৃহত্তম স্তন্যপায়ী নীল তিমির দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৩০ মিটার ও ওজন হয় প্রায় ১৫০ মে টন। বাংলাদেশের ১১৯ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ স্তন্যপায়ীর মধ্যে ৪০টি নানা পর্যায়ের বিপদের সম্মুখীন ১১ অত্যন্ত বিপন্ন, ১৩ বিপন্ন, ৬ বিপন্নপ্রায়। তথ্যাভাবে ৫৩ প্রজাতির অবস্থা মূল্যায়ন সম্ভব হয় নি। বর্তমানে ১৭ প্রজাতি বিপদমুক্ত। বঙ্গোপসাগরের স্তন্যপায়ীর মধ্যে ৩ প্রজাতির তিমি (গোত্র Balaenopteridae) পৃথিবীর সর্বত্রই বিপন্ন। নীল তিমি (Balaenoptera musculus) ও পাখনাওয়ালা তিমি (B. physalus) বিপন্ন এবং কুঁজো তিমি (Megaptera novaeangliae) বিপন্নপ্রায়। প্রায় ১১৯ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ স্তন্যপায়ীর মধ্যে Chiroptera (বাদুড়) বর্গই বৃহত্তম, তাতে আছে ৮ গোত্রের ২৯ প্রজাতি। দ্বিতীয় বৃহত্তম Carnivora বর্গে আছে ৬ গোত্র ও ২৭ প্রজাতি। Felidae গোত্রে অন্তর্ভুক্ত বাংলার বাঘ, চিতাবাঘ, বনবিড়াল ও মেছোবিড়ালসহ সব বিড়াল প্রজাতি।
Primates বর্গের ১০ প্রজাতির সবগুলিই বিপন্ন, এর মধ্যে উল্লুক (Hylobates hoolock) অতি বিপন্ন প্রজাতি। এটি মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে বাস করে। বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনও ৩ প্রজাতির ভল্লুক (২ অতি বিপন্ন, ১ বিপন্ন) আছে সিলেট ও চট্টগ্রামের বনে। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বনে রয়েছে প্রায় ২০০টি হাতি। ডলফিন বর্গের (Cetacea) ৭টি প্রজাতির মধ্যে স্বাদুপানির ডলফিন প্রধান নদীগুলিতে ছড়িয়ে আছে। অন্যদের বাস সুন্দরবনের খাঁড়ি ও উপকূল এলাকায়। [মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম]