জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ
জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ বাংলার সুলতান। রাজা গণেশের পুত্র। তাঁর বাল্য নাম ছিল যদু এবং ইসলামে ধর্মান্তরিত হলে তাঁর নতুন নামকরণ হয় জালালুদ্দীন মুহম্মদ। তিনি দু’পর্যায়ে ১৪১৫ থেকে ১৪১৬ এবং ১৪১৮ থেকে ১৪৩৩ (হিজরি ৮১৮-৩৬) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। ১৪১৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা গণেশ তাঁকে সিংহাসনচ্যুত ও বন্দি করে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন। তাঁর প্রকৃত শাসন শুরু হয় ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা গণেশ ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রের চূড়ান্ত উৎখাতের পর।
প্রায় দু’দশকের শান্তিপূর্ণ রাজত্বকাল জালালুদ্দীনকে পূর্ববঙ্গ (মুয়াজ্জমাবাদ) ও চট্টগ্রামসহ প্রায় সমগ্র বাংলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। তিনি ফতেহাবাদ (ফরিদপুর) অধিকার করেন এবং দক্ষিণবঙ্গে রাজ্য সম্প্রসারণ করেন। তিনি, ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু শাসক ছিলেন।
তিনি হানাফি মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং উলামা ও শেখদের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করেন। তিনি রাজা গণেশ কর্তৃক ধ্বংসকৃত মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় ইমারত পুনঃনির্মাণ ও মেরামত করেন এবং নতুন ধর্মীয় ইমারতও নির্মাণ করেন। বহু চমৎকার ইমারত নির্মাণ করে তিনি পান্ডুয়া নগরীর শোভা বৃদ্ধি করেন। তিনি তাঁর রাজধানী পান্ডুয়া থেকে গৌড় এ স্থানান্তর করেন এবং সেখানে একটি মসজিদ, একটি পুকুর (জালালী পুকুর) ও একটি সরাইখানা নির্মাণ করেন। তাঁর রাজত্বকালে সুতিয়ার প্রশাসক একটি জামে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। পবিত্র মক্কা নগরীতে বিতরণের জন্য তিনি অর্থ প্রেরণ করেন এবং সেখানে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করান। তাঁর রাজত্বকালে বাংলার সম্পদ ও জনবল বৃদ্ধি পায়।
জালালুদ্দীন হিরাতের তৈমুরি শাসক শাহরুখ, চীনের ইয়াং লো এবং মিশরের মামলুক সুলতান আল-আশরাফ বার্সবে-র সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি ‘সুলতান’ ও আমীর উভয় উপাধি ব্যবহার করেন এবং আববাসীয় খলিফার নিকট থেকে সম্মানসূচক পোশাক খিলাত ও খেতাব লাভ করেন। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ খলিফাত-আল্লাহ উপাধি ধারণপূর্বক তিনি ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে একটা নতুন মুদ্রা চালু করেন। তিনি তাঁর মুদ্রায় কালিমা উৎকীর্ণ করেন।
সুলতান জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ-এর দু’টি শিলালিপি এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথমটি গোদাগারী, রাজশাহী থেকেসুলতানগঞ্জ লিপি, এবং অপরটি ঢাকা থেকে মান্দ্রা লিপি। উভয় লিপিই দু’টি মসজিদ স্থাপনের স্মারক। লিপি দু’টির অস্তিত্ব প্রমান করে যে, উক্ত অঞ্চলে সুলতান কর্তৃক বিজিত হয় ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হয়।
অমুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল, সহিষ্ণু ও উদার জালালুদ্দীন রাজ্যধর নামক একজন হিন্দুকে তাঁর সেনাপতি নিয়োগ করেন এবং পন্ডিত ও ব্রাহ্মণদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। ৮৩৭ হিজরির রবি-উস-সানিতে (১৪৩৩-৩৪ খ্রি.) তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি পান্ডুয়ার বিখ্যাত একলাখী সমাধিসৌধ-এ সমাহিত রয়েছেন। [আবু তাহের]