চৈতন্যমঙ্গল

চৈতন্যমঙ্গল  চৈতন্যচরিতকাব্য। চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) জীবন ও লীলাবিষয়ক এ কাব্যধারা মধ্যযুগীয়  বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে প্রথম তথ্যানুসৃতি ও ইতিহাস-চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং ইতিহাসবিমুখ বাঙালি ব্যক্তিজীবনের ঘটনাবলি ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে লিপিবদ্ধ করার প্রেরণা লাভ করে।

চৈতন্যচরিতকাব্য প্রথম রচিত হয় সংস্কৃত ভাষায়। মুরারি গুপ্তের শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত (১৫৩৬-১৫৪০) কাব্য এবং কবিকর্ণপূরের নাটক  চৈতন্যচন্দ্রোদয় (১৫৪০-এর পূর্বে) ও মহাকাব্য চৈতন্যচরিতামৃত (১৫৪২) এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। মুরারি গুপ্তের কাব্য কড়চা নামেই অধিক পরিচিত। এসব গ্রন্থে চৈতন্যের মধ্যে অবতারত্ব বা ঈশ্বরত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসই সমধিক লক্ষণীয়। পক্ষান্তরে, বাংলা চরিতকাব্যগুলিতে তাঁর অলৌকিক জীবনের অন্তরালে তাঁর মানবিক পরিচয় অনেকটা পরিস্ফুট হয়েছে।

বাংলা চরিতকাব্যগুলির মধ্যে বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত (১৫৪৬-১৫৫০) প্রথম রচনা। এটি চৈতন্যমঙ্গল  নামেও পরিচিত। শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত কৃষ্ণলীলা অনুসরণে এখানে চৈতন্যলীলা অর্থাৎ চৈতন্যজীবনের প্রথমার্ধ সরস আখ্যায়িকারূপে বর্ণিত হয়েছে; তাঁর উত্তরজীবনের কাহিনী এবং চৈতন্যধর্মতত্ত্ব আলোচিত হয়নি। চৈতন্যপূর্ব নবদ্বীপের ধর্মীয় ও সমাজজীবন এবং তৎকালীন মুসলিম শাসন সম্পর্কে যে বর্ণনা এতে স্থান পেয়েছে, তাতে গ্রন্থটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

গোবিন্দদাসের কড়চা এ সময়ের অপর একখানি চৈতন্যচরিতকাব্য।  গোবিন্দদাস ছিলেন চৈতন্যের সমসাময়িক এবং তাঁর দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের সঙ্গী। তাঁর সে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা চৈতন্যের লীলার আশ্রয়ে সরসভাবে এতে বর্ণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কবি চৈতন্যের জীবনসংক্রান্ত কিছু কাল্পনিক ঘটনা, তাঁর ভাবপরিমন্ডল ও ভাববিভোর লীলাভিনয় বর্ণনা করেছেন।

এরপর চৈতন্যমঙ্গল নামে চৈতন্যের জীবনীকাব্য রচনা করেন জয়ানন্দ ও লোচনদাস। উভয়েই ছিলেন পদকর্তা এবং সমসাময়িক। জয়ানন্দের কাব্যে (১৫৬০) চৈতন্যের ভাবময় ঐশ্বরিক রূপের প্রাধান্য দেখা যায়। কবি এখানে ভক্তিবেগে তাড়িত হয়ে চৈতন্যের রূপ নির্মাণ করেছেন। তাই বিষ্ণুপ্রিয়ার যে বারমাস্যা এতে বর্ণিত হয়েছে তা বৈষ্ণবতত্ত্বের সমর্থন পায়নি। তবে তথ্যসমৃদ্ধি এবং চৈতন্যের তিরোভাব কাহিনীর অভিনবত্বের কারণে গ্রন্থটি এক সময় পন্ডিত মহলে খুবই সমাদর লাভ করেছিল। জয়ানন্দ তাঁর কাব্য রচনা করেছিলেন  পালাগান হিসেবে এবং জনপ্রিয় পালাগানের রীতি অনুযায়ী এর কাহিনী নয়টি খন্ডে বিভক্ত: আদিখন্ড, নদীয়াখন্ড, বৈরাগ্যখন্ড, সন্ন্যাসখন্ড, উৎকলখন্ড, প্রকাশখন্ড, তীর্থখন্ড, বিজয়খন্ড ও উত্তরখন্ড। আর পালাকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে চৈতন্যসংক্রান্ত অনেক তথ্যের অবলেপ এবং অনেক অলৌকিক ঘটনা সন্নিবেশের কারণে পরবর্তীকালে পন্ডিতসমাজে এর গুরুত্ব কমে যায়।

লোচনদাসের কাব্যে (১৫৬০-৬৬/৭৫) চৈতন্যের মাতৃমমতামন্ডিত বাল্যলীলা এবং অতিরঞ্জনমুক্ত মানবীয় রূপটি প্রধানভাবে চিত্রিত হয়েছে। এখানেই এর বিশেষত্ব। কাব্যটিতে মুরারি গুপ্ত এবং বৃন্দাবন দাসের প্রভাব আছে। এ ছাড়া  মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণেরও প্রভাব আছে। এটি চার খন্ডে বিভক্ত: সূত্রখন্ড, আদিখন্ড, মধ্যখন্ড ও অন্ত্যখন্ড। গ্রন্থটি পালা হিসেবে রচিত হলেও একে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে কবি অলৌকিকতাকে প্রাধান্য দেন নি। চৈতন্যজীবনের সত্য ঘটনাকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে ভক্তহূদয়ের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কবি চৈতন্যদেবের একটি শিল্পরূপ নির্মাণ করেছেন। ফলে ভক্তদের ঐতিহ্যগত বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রয়েছে, তবে এর সব ঘটনাই ইতিহাস সমর্থিত নয়।

চৈতন্যজীবনীগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত (১৬১৫)। এতে চৈতন্যের শেষজীবনের কথা বর্ণিত হয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের এটি আকর গ্রন্থ। এতে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের দার্শনিক ভিত্তি এবং অধ্যাত্ম আদর্শ গভীর মনীষা, ভক্তিপরায়ণতা ও অসাধারণ শাস্ত্রজ্ঞানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে চৈতন্যদেবের যে প্রেমবিহবল ও ভাবতন্ময় রূপটি অঙ্কিত হয়েছে তা চৈতন্যভক্ত ও কাব্যরসিকদের অন্তরে প্রস্তরাঙ্কিত চিত্রের ন্যায় স্থায়ী রূপ লাভ করে। এ কারণে গ্রন্থটি চৈতন্যের বাঙ্ময় বিগ্রহরূপে বৈষ্ণব সমাজে পূজিত হয়ে আসছে। অবশ্য অবৈষ্ণব পাঠকসমাজেও এর মূল্য কম নয়। চৈতন্যচরিতামৃত তার বিষয়বস্ত্ত, রচনাশৈলী এবং সাহিত্যগুণে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদরূপে বিবেচিত।

চৈতন্যজীবনী অবলম্বনে রচিত আরেকখানি চরিতকাব্য হলো চূড়ামণিদাসের গৌরাঙ্গবিজয়। গ্রন্থটি তিনখন্ডে সম্পূর্ণ বলে জানা গেলেও কেবল প্রথম খন্ডের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে এবং এটি খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে রচিত বলে মনে করা হয়। নিত্যানন্দের স্বপ্নাদেশে কাব্যটি রচিত এবং এতে চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও মাধবেন্দ্র পুরী সম্পর্কে কিছু নতুন তথ্য পাওয়া যায়। চৈতন্যের জীবনী অবলম্বনে রচিত এ চরিতকাব্যসমূহ তৎকালীন বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। দৈবনির্ভর এবং অস্পৃশ্যতাদোষে দুষ্ট বহুধা বিভক্ত হিন্দু সমাজকে মহামিলনের যে বাণী  চৈতন্যদেব শুনিয়েছিলেন, তার প্রচারের মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এ সময় উল্লেখযোগ্য উৎকর্ষ অর্জন করে। তৎকালীন বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে এ কাব্যগুলি আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।  [দুলাল ভৌমিক]

আরও দেখুন মঙ্গলকাব্য