চাকলা ব্যবস্থা
চাকলা ব্যবস্থা রাজ্যের রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থার একটি প্রশাসনিক পদ্ধতি। ‘চাকলা’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ জেলা বা বৃহৎ প্রশাসনিক অঞ্চল। এ প্রশাসনিক বিভাগ মুগল আমলে সুবাহ্ বাংলায় আঠারো শতকের প্রথম দিক থেকে প্রবর্তিত হয়। বাংলায় চাকলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন সুবাহদার মুর্শিদকুলী খান। এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল যথাসম্ভব রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং যথাসময়ে কোষাগারে রাজস্ব জমা দান নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলা সুবাহকে পূর্ববর্তী ৩৪টি সরকারে বিভক্ত করার ব্যবস্থার পরিবর্তে ১৩টি চাকলায় ভাগ করা। এ চাকলাগুলি হলো বন্দর বালেশ্বরী, হিজলি, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, হুগলি (কলকাতাসহ), ভূষণা (ফরিদপুর), যশোর, আকবরনগর, ঘোড়াঘাট, কুড়িবাড়ি (কুচবিহার ও আসাম), জাহাঙ্গীরনগর (বাংলার পূর্বাঞ্চল), সিলেট ও ইসলামাবাদ (চট্টগ্রাম)। প্রতিটি চাকলা একজন চাকলাদারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। পূর্বের ‘সরকার’ প্রশাসন ব্যবস্থার মতো চাকলার অন্তর্ভুক্ত এলাকার সার্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য একজন ফৌজদারকে (সামরিক প্রশাসক) দায়িত্ব প্রদান করা হয়। রাজস্ব আদায় এবং আদায়কৃত রাজস্ব কেন্দ্রে প্রেরণ করার দায়িত্বও তার উপর ন্যস্ত ছিল। প্রতিটি চাকলায় একজন কাজী ও একজন কোতোয়াল নিয়োগ করা হতো।
আঠারো শতকে বাংলার রাজস্ব ইতিহাসে নতুন প্রশাসনিক একক চাকলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মনে হয়। এ নতুন ব্যবস্থায় বহুসংখ্যক ছোট ছোট জমিদারকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন চাকলাদারের তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ চাকলাদাররা জমিদারের ভূমিকা পালন করতেন। এ ধরনের একটি নীতির মাধ্যমে কতিপয় অভিজাত ভূম্যধিকারীর অধীনে জমিদারিগুলির সম্মিলনের ফলে খেলাপি জমিদারদের কাছে পূর্বের অনাদায়ি পাওনা আদায় করা সম্ভব হয় এবং রাজস্ব আদায়ের ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। এ ব্যবস্থার ফলে সকল শেª্রণর জমিদারদের উপর ন্যস্ত অত্যাবশ্যক দায়িত্ব শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যয়ও কমে যায়।
নিম্নপদস্থদের উপর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োজিত চাকলাদারদের যথাসময়ে সরকারি পাওনা আদায় নিশ্চিত করতে হতো। রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে বড় বড় জমিদারদের চাকলাদার পদে নিয়োগ তাদের ঐতিহ্যগত ক্ষমতা ও মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। ফলত চাকলাদারগণ প্রতিবেশী জমিদার ও তালুকদারদের উপর শক্তি প্রয়োগসহ বহু আপত্তিকর উপায়ে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতেন। চাকলাদারি ব্যবস্থার রমরমা দিনগুলিতে জমিদারির সম্মিলন নীতির ফল হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক দীউয়ানি লাভের সময় (১৭৬৫) ১৫টি বড় জমিদারি থেকে বাংলার প্রায় ৬০% ভূমিরাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। [শিরীন আখতার]