কাজী

কাজী  ব্রিটিশপূর্ব যুগে মুসলমান আইন সম্পর্কিত বিচার কার্য সম্পাদনকারী পদস্থ কর্মকর্তা। মুসলমান শাসকগণ কুরআন অনুসারে দীউয়ানি ও ফৌজদারি উভয় প্রকার আইন প্রয়োগের জন্য প্রধানত শহরে কাজী নিযুক্ত করতেন। যদিও তত্ত্বগতভাবে সুবাহদার ছিলেন মৃত্যুদন্ড, উত্তরাধিকার এবং মুসলিম আইনের ব্যাখ্যা দানের ক্ষেত্রে তাঁর সুবাহতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, তবুও এসব বিষয় শুরু হতো কাজীর এজলাসে। সুবাহদার শুধু কাজী প্রদত্ত রায় অনুমোদন, পরিবর্তন কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে বাতিল করতে পারতেন।

প্রথম দিকে বিবাদ মীমাংসা করা ছিল কাজীর কাজ, কিন্তু পরে তাঁর কর্মক্ষেত্রের পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এসময়ে এতিমখানা এবং পাগলাগারদের তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা, ধর্মীয় আইনে বিচার সম্পাদন ও বাস্তবায়ন এবং রাজস্বমুক্ত ভূ-সম্পত্তির তত্ত্বাবধানও তাঁর আওতাভুক্ত হয়। কখনও কখনও তিনি অসহায় বিধবাদের উপযুক্ত পাত্রে বিয়ের ব্যবস্থা করতেন। যে সকল সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ আছে তেমন সম্পত্তি তাঁর বা তাঁর মনোনীত ব্যক্তির নিকট গচ্ছিত থাকত। তিনি অন্যায়কারীকে শোধরাতে সাহায্য করতেন। গভর্নর বা নির্বাহি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ছিল আইনের মর্যাদা রক্ষার কাজে তাঁকে সাহায্য করা। কেন্দ্র কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে এবং গভর্নর বা নির্বাহি বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে কাজী মুসলিম শরিয়া (ইসলামিক আইন) বা আদাহ অর্থাৎ সমদর্শিতা ও যুক্তির ভিত্তিতে বিচার কাজ সমাধা করতেন। আইনের আওতার মধ্যে বিরোধে জড়িত পক্ষগুলির মাঝে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করাও তাঁর কাজ ছিল। জঘন্য অন্যায় বা জালিয়াতির জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত, বা পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়া সকল মুসলমানই বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী হিসেবে গৃহীত হতেন। নতুন সাক্ষ্য বা যুক্তির আলোকে কাজী নিজেই রায় বদলাতে পারতেন।

কাজী-ই-মামালিক বা কাজী-উল-কুজ্জাত ছিলেন দীউয়ান-ই-কাজা বা বিচার বিভাগের প্রধান। সমগ্র বিচার বিভাগ এবং ধর্ম বিষয়ক প্রশাসন কাজী-ই-মামালিকের দায়িত্বাধীন ছিল। তিনি নিম্ন আদালত থেকে আপিল শুনতেন এবং স্থানীয় কাজীদের নিয়োগ দিতেন। প্রাক-মুগল ও মুগলযুগসহ সমগ্র মুসলিম আমলে কাজী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজীর ক্ষমতা দ্রুত লোপ পেতে থাকে। ১৭৯৩ সালের কর্নওয়ালিস কোডএর আওতায় কাজীর বিচার বিষয়ক ক্ষমতা ছিল না বললেই চলে। অবশ্য দীউয়ানি মামলার ক্ষেত্রে ইংরেজ বিচারককে তাঁর আদালতে একজন কাজী রাখতে হতো। ১৮৬১ সালের হাইকোর্ট আইন কাজীর এ ক্ষমতাও কেড়ে নেয়। এরপর থেকে কাজীর দায়িত্ব শুধু মামলার কাগজপত্র প্রণয়ন ও প্রত্যয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাছাড়া কাজী মুসলমান সমাজের বিয়ে, মৃতের শেষকৃত্য (জানাজা ইত্যাদি) এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি তদারক ও আইনসিদ্ধ করতেন।

বর্তমানে কাজীর একমাত্র আইনগত কাজ হচ্ছে মুসলমানদের বিয়ে নিবন্ধীকরণ ও বিয়ে পড়ানো। বিয়ে নিবন্ধীকরণ করে যে ফি আয় হয় তাই দিয়ে সরকার অনুমোদিত কাজী অফিসের ব্যয় নির্বাহ হয়। ইসলামি শাস্ত্রজ্ঞ এবং একজন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনকারী ব্যক্তি হিসেবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাজী সমাজে যথেষ্ট সম্মানের পাত্র ছিলেন। তারপর থেকে শুধু বিয়ে নিবন্ধীকরণ তাঁর দায়িত্ব হয়।  [আবদুল করিম]