চক্রবর্তী, দেবদাস
চক্রবর্তী, দেবদাস (১৯৩৩-২০০৮) চিত্রশিল্পী। তাঁর জন্ম ১৯৩৩ সালে ২৫ ডিসেম্বর, শরিয়তপুর জেলার এক জমিদার পরিবারে। পিতা তারকব্রহ্ম চক্রবর্তী, মাতা স্নেহলতা চক্রবর্তী। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পরে তাঁর পিতা সপরিবারে কলকাতা চলে গেলে দেবদাস চক্রবর্তী সেখানকার সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন (১৯৪৮)। কিন্তু এক ছাত্রবিক্ষোভে অংশ নিলে (১৯৪৯) স্কুল থেকে তাঁকে বহিষ্কৃত করা হয়। পরে তিনি ঢাকার সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি (১৯৫১) হন এবং চিত্রকলায় স্নাতক সমমানের শিক্ষাকোর্স সমাপন (১৯৫৬) করেন।
দেবদাস চক্রবর্তীর পেশাগত জীবন শুরু হয় প্রথমে ঢাকার আরমানিটোলা হাইস্কুল-এ শিক্ষকতার (১৯৫৭) মধ্য দিয়ে। পরে ঢাকার কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি-তথ্য সার্ভিসে সিনিয়র ডিজাইনার হিসেবে দায়িত্ব (১৯৫৮-৭০) পালন করেন। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ ছিল তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র, যেখানে তিনি সহকারী অধ্যাপক পদে ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগে ডিজাইনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের পক্ষ থেকে প্রচারিত তাঁর অাঁকা একটি পোস্টারের স্লোগান ছিল: ‘বাংলার হিন্দু/ বাংলার খৃষ্টান/ বাংলার বৌদ্ধ/ বাংলার মুসলমান/ আমরা সবাই বাঙালী।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে শিক্ষকতাপর্বে (১৯৭৭-৭৯) তিনি পোলিশ সরকারের বৃত্তি নিয়ে পোল্যান্ডের ওয়ারশ থেকে ছাপচিত্রের ওপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে বামপন্থি রাজনীতির সংস্পর্শে আসায় দেশের অবহেলিত মানুষের প্রতি তাঁর মনে অনুরাগ সৃষ্টি হয়। উক্ত শিক্ষা তাঁকে শিল্পের প্রতি নিষ্ঠ এবং মানুষের ওপর আরও মমতাশীল করে তোলে। এর প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায় তাঁর চিত্রমালায়। তিনি জলরঙ, তেলরঙ, গোয়াশ, প্যাস্টেল প্রভৃতি বিভিন্ন মাধ্যমে চিত্র রচনা করেন। রেখাচিত্রেও ছিলেন তিনি অনবদ্য। অবয়বধর্মী চিত্র অঙ্কনের প্রতিই ছিল তাঁর ঝোঁক। তবে নির্বস্ত্তক চিত্র নির্মাণেও তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলাকে তিনি তাঁর সৃষ্টিশীলতার দ্বারা সমৃদ্ধ করেন। ঢাকা (১৯৬৪, ১৯৭৫, ১৯৯৪, ১৯৯৭, ২০০১), লাহোর (১৯৬৮) ও ওয়ারশতে (১৯৭৭) তাঁর মোট সাতটি একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া তিনি দেশবিদেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যৌথ শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। প্রচ্ছদশিল্পেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
ওয়ারশতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আর্ট ওয়ার্কশপে তিনি চিত্রকলায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন (১৯৭৮)। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানিত বেসামরিক পুরস্কার ‘একুশে পদক’ ও বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের সম্মাননা লাভ করেন। ২০০১ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন তাঁকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান করে। তাঁর মৃত্যু ঢাকায়, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। [সৈয়দ আজিজুল হক]