চিত্রকলা

চিত্রকলা  বাংলায় চিত্রকলার প্রাচীনত্ব নির্ণয় বেশ দুরূহ। তবে প্রাপ্ত নিদর্শনের বিবেচনায় বাংলার প্রাচীনতম চিত্রকলার নিদর্শন পাল-আমলে (৭৫০-১১৬২ খ্রি.) রাজা মহীপাল দেব (৯৯৩-১০৪৩ খ্রি.)-এর সময়ে তালপাতায় অঙ্কিত নালন্দা মহাবিহারের ‘বৌদ্ধ-অনুচিত্র’। অঙ্কনশৈলীর বিচারে এ চিত্রকলা সর্বভারতীয় ধ্রুপদী চিত্রকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পশ্চিম ভারতের ‘অজন্তা-দেয়ালচিত্রের’ সমগোত্রীয়। সঙ্গতকারণে এ বৌদ্ধ-অনুচিত্রগুলি বাংলার চিত্রকলার সর্বপ্রাচীন বা প্রাথমিক পরিচয় নয়। ওই সময়ের পূর্বে এ অঞ্চলে চিত্রচর্চার ঐতিহ্য বজায় ছিল।

বঙ্গীয় অঞ্চলে মানবসভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ‘পান্ডুরাজার ঢিবিতে’। প্রাচীন যুগের মানুষের চিত্রাংকন দক্ষতার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন পান্ডুরাজার ঢিবিতে পাওয়া মৃৎপাত্রের গায়ে অাঁকা নানা নক্সাধর্মী অলঙ্করণ। আদি মৃৎশিল্পী শুধুমাত্র বিমূর্ত বা অর্ধবিমূর্ত নক্সাই অঙ্কন করেনি, মৎস্য বা পাখির রেখাচিত্রও অঙ্কন করেছিল। এ চিত্রে অঙ্কন শিল্পীর দক্ষতা নয়, স্বতস্ফূর্ততাই লক্ষণীয়। উল্লেখ্য, পান্ডুরাজার ঢিবির মৃৎপাত্র অলঙ্করণে কোনো পশু বা মনুষ্যমূর্তির অনুপস্থিতি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। অথচ সমসাময়িক সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্রে ওইসব বস্ত্তর উপস্থিতি দেখা যায়।

টেরাকোটা মূর্তি, মহাস্থান

পালপূর্ব আমলের প্রাচীন বাংলার ইতিহাস যেমন অস্পষ্ট, ওই সময়ের শিল্পকলাও বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্ত। বাংলাদেশের বগুড়া অঞ্চলে মহাস্থানের প্রাচীন ‘পুন্ড্রনগর’-এ প্রাপ্ত মৌর্যযুগের (খ্রি.পূর্ব ৩২২-১৮৫) এবং ‘চন্দ্রকেতুগড়’-এ আবিষ্কৃত সুঙ্গ যুগের (খ্রি.পূর্ব ১৮৫-৭১) টেরাকোটা ফলকচিত্রগুলি এবং ময়নামতির গুপ্ত পরবর্তী (৬ষ্ঠ-৭ম খ্রি.) ও পাহাড়পুরের প্রাথমিক পালযুগের (৮ম-৯ম খ্রি.) পোড়ামাটির ফলকগুলি বিবেচনা করা চলে। ‘রিলিফ’ পদ্ধতিতে নির্মিত বলে ফলকচিত্রগুলিতে এক ধরনের স্বাভাবিক চিত্রধর্মীতা বর্তমান। উল্লিখিত পোড়ামাটির ফলকগুলিতে ফুলপাতা থেকে শুরু করে পশুপাখি, নরনারী, দেবদেবী এবং কাল্পনিক গল্পগাথাও রূপায়িত হয়েছিল। স্থানীয় লোকশিল্পীদের এ শিল্পকর্ম রাজশিল্পের দৃষ্টিতে উচ্চশিল্পবোধসম্পন্ন না হলেও এতে বাংলার লোকজীবনের বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গী প্রতিফলিত হয়েছে। এ টেরাকোটা ফলকগুলির মাধ্যমে পালপূর্ব বাংলার অজ্ঞাত চিত্রকলা সম্পর্কে অনুমান করা চলে। তবে ঐতিহ্যগত ভারতশিল্প মূলত ‘সমবায়িকশিল্প’ (যৌথশ্রমে নির্মিত শিল্পকলা)।

বাংলার চিত্রকলার সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক নিদর্শন পাল আমলের তালপাতার পুথিতে এবং কাঠের প্রচ্ছদে অঙ্কিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুচিত্রগুলি যা ভারতশিল্পের ইতিহাসে ‘পালচিত্র’ নামে পরিচিত। এ চিত্র সম্পর্কে প্রথম কথা হচ্ছে, পুথির লেখার সঙ্গে চিত্রায়িত হলেও এগুলি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এখানে বুদ্ধ এবং অন্যান্য বৌদ্ধ দেবদেবীর প্রতিমূর্তিগুলি মূলত পুথিকে দৈবগুণসম্পন্ন করার প্রয়োজনে অঙ্কিত হয়েছিল। পালচিত্রের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ‘মিনিয়েচার’ বা অনুচিত্র যুগের সূচনা। অবশ্য ক্ষুদ্রাকার হলেও পাল পুথিচিত্রকে প্রকৃত মিনিয়েচার বলা সঙ্গত নয়। কারণ অনুচিত্রের মূল চরিত্র বিষয়ের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম অঙ্কন ও অলঙ্করণ। অথচ পালচিত্রে এ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যই অনুপস্থিত। ক্ষুদ্রাকার এ চিত্রে ‘ম্যুরাল’ বা দেয়ালচিত্রের চরিত্র দৃশ্যমান। ‘গোয়াস’ মাধ্যমে অঙ্কিত পালচিত্রের আঙ্গিক প্রধানত রৈখিক হলেও তা আলঙ্কারিক নয়। কারণ চিত্রী ব্যবহূত রেখাকে একই সঙ্গে মোটা, সরু কিংবা হাল্কাভাবে প্রয়োগ করে বিষয়বস্ত্ততে ঢৌলাভাস সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে ‘মডেলিং’ তৈরির জন্য রঙের সঙ্গে সাদা বর্ণের মিশ্রণও লক্ষণীয়। উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে চিত্রকলা শিল্প ধ্রুপদী চরিত্র অর্জন করেছিল গুপ্তযুগের (৩২০-৫৭৫ খ্রি.) চূড়ান্ত পর্বে। যার সর্বোত্তম নিদর্শন পশ্চিম ভারতীয় ‘অজন্তা দেয়ালচিত্র’। অবশ্য দশম শতকের শেষ পর্যায় থেকে পাল চিত্রকলার প্রচুর নিদর্শন পাওয়া যায় এবং দ্বাদশ শতকে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরও তা অব্যাহত ছিল। তবে ওই সময়ে মুসলিম সুলতানদের দরবারে ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ধারার চিত্রকলার আবির্ভাব ঘটে। সুলতানী দরবারের চিত্রশৈলী সর্বাংশে ঐতিহ্যগত পারস্য চিত্রকলার ‘সাফাভী চিত্ররীতি’ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল।

পাল পুথিচিত্র

হোসেন শাহী বাংলায় (১৪৯৪-১৫৩৮) নবদ্বীপের চৈতন্যদেব (১৪৮৫-১৫৩৩) প্রভাবিত যে নতুন সংস্কৃতির উত্থান ঘটে, এর অনুপ্রেরণায় সতের ও আঠার শতকের প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত বিষ্ণুপুর ও অন্যান্য জায়গায় বাংলার এক নিজস্ব চিত্রকলা বিকাশ লাভ করে। এ ধারার অন্যতম চিত্রাঙ্গিক কাগজে অাঁকা ‘জড়ানোপট’ এবং পুথির প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহূত কাঠের উপরে অঙ্কিত ‘পাটাচিত্র’। বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে ভক্তিমূলক কাহিনীধর্মী এ চিত্র উজ্জল রঙে সুঢৌল রেখায় অঙ্কিত। পাটাচিত্রের অবক্ষয়ী রূপ দৃষ্টিগোচর। এ চিত্রকলায় একই সঙ্গে অনুচিত্রের অনুপুঙ্খ, দেয়ালচিত্রের প্রসারতা এবং আবহমান বাংলার লোকায়ত পটচিত্রের অনেক বৈশিষ্ট্য প্রকটভাবে উপস্থিত।

আলীবর্দী খানের আমলে (১৭৪০-১৭৫০) মুগল চিত্রশৈলী প্রভাবিত ‘মুর্শিদাবাদ চিত্ররীতি’ নামে একটি স্বতন্ত্র চিত্রকলার জন্ম হয়েছিল। সুশৃঙ্খল ও সংযত অঙ্কনশৈলী এবং শীতলাভ ছায়াচ্ছন্ন বর্ণের প্রাধান্যে চিত্রিত এ চিত্রকলায় মুগল শৈলী ছাড়াও রাজপুতনা-চিত্র এবং বাংলার পটচিত্রের সম্মিলন ঘটেছিল। মুর্শিদাবাদ এবং পরে কলকাতায় স্থানীয় শিল্পীরা ভারতীয় জনজীবন ও প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির যে বাস্তবধর্মী চিত্রাঙ্কন করেন, তা ‘কোম্পানিচিত্র’ নামে পরিচিত যা কোম্পানি শাসনের অবসানের কিছুকাল পরও টিকে ছিল।

উপনিবেশিক অর্থনীতির সহায়ক শক্তি হিসেবে স্থানীয় শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষে এখানে পাশ্চাত্যের অনুকরণে ‘আর্ট-স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভারতীয় শিল্পীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঐতিহ্য ছিল না, শিল্পকলা ছিল বংশানুক্রমিক কৌলিক শিক্ষার অংশ। ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতশিল্পে বৈশিষ্ট্যগত এবং শিল্পীদের ক্ষেত্রে শ্রেণীগত পালাবদলের সূচনা ঘটে। এভাবে বাংলা তথা ভারতবর্ষের শিল্পকলার ইতিহাসে প্রাচীন ও মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিকতার সূত্রপাত হয়। [ফয়েজুল আজিম]

দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে যেসব শিল্পী চারুশিল্পের চর্চা সূচিত করেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সৃজনশীল শিল্পী হিসেবে সফিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান ও শেখ মোহাম্মদ সুলতান। চল্লিশের দশকের শিল্পীদের সাধারণ ঐক্যসূত্রটি স্বদেশের প্রকৃতি ও জনজীবনকে শিল্পে প্রতিবিম্বিত করার প্রয়াসের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।

আধুনিকযুগে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন শিল্পচর্চার পথিকৃৎ। ১৯৪৩-এর বাংলার মন্বন্তর-ভিত্তিক চিত্রমালা তাঁকে ভারতব্যাপী খ্যাতি এনে দেয় এবং এক সকরুণ মানব-ট্র্যাজেডির তাৎক্ষণিক, সহানুভূতিপূর্ণ ও সবল রূপায়ন হিসেবে এগুলি বহির্বিশ্বেও শিল্পরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দুর্ভিক্ষের স্কেচে, কেবল তুলির কালো রেখায় যার সূচনা, সেটাকে বর্ণপ্রয়োগের ন্যূনতায় ও স্পেস ব্যবহারের পরিমিতিবোধে তিনি ক্রমশ এক নিজস্ব শৈলীতে রূপান্তরিত করেন। তাঁর এপর্যায়ের ছবিগুলো- ‘বিদ্রোহী’, ‘মই দেওয়া’, ‘সাঁওতাল যুগল’ ‘সংগ্রাম’ এবং লোকশৈলীর মটিফে জ্যামিতিক বিন্যাসে সন্নিবেশিত চিত্র- ‘পাইন্যার মা’, ‘প্রসাধন’, ‘গুণটানা' প্রভৃতি।

পটচিত্র, সতেরো শতক

তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অাঁকা স্ক্রলচিত্র ‘নবান্ন’ এবং সত্তরের ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষের অসহায়তাকে অবলম্বন করে চিত্রিত ‘মনপুরা ৭০’।

এ দশকের অন্যতম শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ, একইসঙ্গে চিত্রকর এবং ছাপচিত্রশিল্পী হিসেবে সৃজনশীলতায় ও উৎকর্ষে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। ‘বনের পথে’, ‘সাঁওতাল বালা’, ‘ঘরে ফেরা’ তাঁর প্রাথমিক পর্বের উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম। পরে জল, মাছ ও নৌকা এবং প্রতীকায়িত চোখ তাঁর শিল্পকর্মের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। ক্রমশ তিনি আঙ্গিকের আধাবিমূর্ত জ্যামিতিকায়নের দিকে ঝুঁকেছেন এবং বাঙালির লোককলার নানা মটিফকে তিনি চিত্রতলে সম্পৃক্ত করাতেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

কামরুল হাসান অতি অল্প বয়সেই গুরুসদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দেন এবং শিল্পীর সমগ্র জীবনে এর এক ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা  যায়। লোকজ চিত্রকলা, পুতুল, ভাস্কর্য, কারুকলা ইত্যাদির প্রতি তাঁর আগ্রহ ও শিল্পচর্চায় এদের অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহারে এ প্রভাব লক্ষণীয়। প্রথমদিকে তাঁর ছবিতে নারীদেহ পুতুলের মত ভরাট, গ্রীবা দীর্ঘ ও চোখ-নাক লৌকিক আদলে আবদ্ধ। ‘তিনকন্যা’, ‘গুনটানা’ এ রীতির কাজ। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রামের রূপ তাঁর চিত্রকলায় প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়। এ সময়ে তাঁর অাঁকা জনপ্রিয় পোস্টার ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায়ের স্বপ্নভঙ্গ ও হতাশা তাঁর চিত্রকর্মে নানা প্রতীকে রূপায়িত হয়েছে।

শেখ মোহাম্মদ সুলতান জীবনযাপনে এবং আচার-আচরণে যেমন, তেমনই শিল্পচরিত্রে ও শিল্পভাবনায়ও তাঁর স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন। তাঁর পেশীবহুল অতিকায় মানব-মানবী একই সঙ্গে মৃত্তিকা-সম্পৃক্ততা ও অপারাজিত মানবসত্তার প্রতীক। চারা রোপণ, ভূমিকর্ষণ, মাছধরা, ফসল তোলা প্রভৃতি চিরকালীন গ্রামীণ দৃশ্যের গতানুগতিকতাকে তিনি মোচন করেন অতিরঞ্জিত মানবশরীরের তেজীয়ান মনোভঙ্গী দ্বারা।

পঞ্চাশের দশকে ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আধুনিক ধারার চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তৎকালীন জনপ্রিয় নির্বস্ত্তক রীতির আন্তর্জাতিক আদল ও আবেদন স্বাভাবিকভাবেই প্রতিফলিত হয়। ফলে আধুনিক ইউরোপীয় শৈলীসমূহের মধ্যে বিমূর্ততার চর্চা লক্ষ করা যায়। এ ধারার বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। চিত্রকলা ও ছাপচিত্র চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্বতা প্রতিভাত। রঙ রেখা ও বুনটের নির্বস্ত্তক উপস্থাপনার মাধ্যমে তিনি নির্মাণ করেন একটি নিজস্ব শিল্পজগৎ। শিল্পী আমিনুল ইসলাম নির্বস্ত্তকতার মধ্যেই শিল্পের সারাৎসার অনুভব করেন, তবু কখনও তাঁর তুলিতে ফিরে আসে মানবদেহ, কখনও ব্যবহূত হয় ভাঙ্গা আয়না, কখনো কোলাজ। ফ্রেস্কো ও মোজাইক পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য কিছু দেয়ালচিত্র রচনা করেন আমিনুল ইসলাম। হামিদুর রহমান নিরীক্ষাপ্রবণ শিল্পী। বহুমুখিনতা সত্ত্বেও তাঁর প্রধান ঝোঁক মূর্ত ও বিমূর্ত প্রকাশবাদিতার দিকে। ম্যুরাল বা ভিত্তিচিত্রের ক্ষেত্রে হামিদুর রহমান এদেশের অন্যতম পূর্বসূরী। ভাস্কর নভেরা আহমেদের সঙ্গে মিলিতভাবে তিনি ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক শহীদ মিনারের নকশাকার। রশিদ চৌধুরী তেলরঙ ছাড়াও কাজ করেন টেম্পেরা, গোয়াশ ইত্যাদি স্বল্পপ্রচলিত মাধ্যমে। তবে তাঁর সর্বপ্রধান ভিন্নতা ট্যাপেস্ট্রি মাধ্যমের শিল্পী হিসেবে। রশিদ চৌধুরী তাঁর শিল্পের উৎস হিসেবে প্রত্যাবর্তন করেছেন বাংলার লৌকিক ঐতিহ্যে। তিনি চেষ্টা করেছেন লোকচিত্রের বর্ণবৈশিষ্ট্য এবং দ্বিমাত্রিক বিন্যাস, আলোছায়ার উদ্ভাস ও কারিগরিকে একসঙ্গে মেলাবার। পঞ্চাশের দশকের অন্যতম বৈচিত্র্যসম্পন্ন ও নিরীক্ষাপ্রবণ শিল্পী মুর্তজা বশীর। তিনি চিত্রকলা, ভিত্তিচিত্র, ছাপচিত্রকলা ও ভাস্কর্যই শুধু সৃষ্টি করেননি, বিচরণ করেছেন সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও গবেষণার জগতেও। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ক্রমপরিবর্তনশীল ও অনুসন্ধানী একটি মানসকে প্রতিবিম্বিত করে। ফলে মূর্ত ও বিমূর্ত বিবিধ ধারার শৈলীতে তিনি বিভিন্ন সময় কাজ করেন। আবদুর রাজ্জাক চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও ছাপচিত্র তিনটি মাধ্যমেই শিল্পচর্চা করেন।

লোকশিল্পের কারুকাজ ও নকশা কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণার উৎসস্থল। তাঁর সাম্প্রতিকতম চিত্রমালায় বর্ণ হয়ে উঠেছে প্রবলভাবে উজ্জ্বল এবং অবিমিশ্র, লোকজ মটিফ ও নকশা নেমে এসেছে ইঙ্গিতমাত্রে, নির্মাণ হয়ে উঠেছে অধিকতর স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। দেবদাস চক্রবর্তীর প্রথম পর্বের নিরীক্ষাধর্মী কাজে দেখা যায় আধাবাস্তব, আধাবিমূর্ত ঢঙে মনুষ্য-অবয়ব, মিছিল, নারীমুখ ইত্যাদি। দ্বিতীয়পর্বে সমসাময়িকদের মতো দেবদাস চক্রবর্তীর যাত্রাও বাস্তবধর্মীতা অতিক্রম করে বিমূর্তভাব প্রকাশের দিকে। সৈয়দ জাহাঙ্গীরও অন্যান্য সহগামীদের মতো নির্বস্ত্তকতার প্রতি আসক্ত হয়ে ওঠেন। বিমূর্ততার প্রাথমিক পর্যায়ে নুড়ি ও বরফির আকৃতি ক্যানভাসময় ছড়ানো, জীবনের ক্লান্তিহীন চলমানতার প্রতিচ্ছবি। পরবর্তী পর্যায়গুলি থেকে তাঁর চিত্রভাবনা হয়ে ওঠে অনেক বেশি দর্শন ভাবাপন্ন। কাজী আবদুল বাসেতের প্রথম পর্বের ছবিতে বিষয়বস্ত্ত গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন দিক; বিশেষত একক ও যুগল নারী। বিদেশ-প্রত্যাগত হয়ে আবদুল বাসেতও বিমূর্ত শৈলীতে চিত্রাঙ্কন শুরু করেন। তাঁর কাজ ক্রমশ অগ্রসর হয়েছে দৃশ্যমানতার আপাত-চিহ্নগুলি মুছে ফেলে প্রকৃতির একটি নির্বিশেষ রূপ নির্মাণের দিকে। পঞ্চাশের দশকের প্রধান শিল্পীদের পাশাপাশি নিয়মিত সৃজনশীল শিল্পনির্মাণে ব্রতী থেকেছেন নিতুন কুন্ডু, কাজী আবদুর রউফ, সৈয়দ শফিকুল হোসেন, শাহতাব, মুবিনুল আজিম, শামসুল ইসলাম নিজামী প্রমুখ। নিতুন কুন্ডু তৈলচিত্র, ছাপাই ছবি ও ভাস্কর্য নির্মাণে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

ষাটের দশকের অন্যতম শিল্পী আবু তাহের। বিমূর্তধর্মী চিত্রতলে বুনট, অাঁচড় বা বিক্ষত উচ্চাবচ জমিন তৈরি করে অনুভূতিকে প্রবলতর করবার প্রবণতা তাঁর চারিত্র্যলক্ষণ। সমরজিৎ রায়চৌধুরী বাংলাদেশের প্রকৃতি ও লোকজীবনের বিভিন্ন উপাদান ও মটিফ অবলম্বন করে চিত্রতলে গড়ে তোলেন একটি নকশাদার উপস্থাপনা।

রাজনীতি ও সমাজ-সচেতন হাশেম খান বাণিজ্যকলায়, বিশেষত পুস্তক প্রকাশন, প্রচ্ছদ ও অলংকরণ শিল্পে, অধিক পরিচিতি অর্জন করেন। তাঁর শিল্পকর্মে রয়েছে প্রতীক, অর্থ ও বক্তব্য। রফিকুন নবী পুস্তক অলংকরণ এবং কার্টুন শিল্পী হিসেবে অধিক পরিচিতি পেলেও ছাপচিত্রকলায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভের পর তিনি বর্তমানে দেশের অন্যতম ছাপচিত্রী ও চিত্রকর হিসেবে স্বীকৃত। কিছুটা লৌকিক, কিছুটা জ্যামিতিক ছাঁদে বিষয়কে বিন্যস্ত করেন তিনি। বিমূর্ত বা আধাবিমূর্ত শৈলীর অন্যান্য শিল্পী দেলোয়ার হোসেন, গোলাম সারোয়ার, মোহাম্মদ মহসীন, আনোয়ারুল হক পিয়ারু প্রমুখ।

কোম্পানী শৈলী, ঢাকা

সত্তরের দশকের প্রধান চিত্রশিল্পীদের মধ্যে বিশেষভাবে নন্দিত স্পেনপ্রবাসী মনিরুল ইসলাম। তাঁর শিল্পকর্ম সূক্ষ্ম সংবেদনশীল রেখা, স্বত:স্ফূর্ত বর্ণের লেপন ও ইতস্তত তুলির ছোপ ও ফোঁটা ফোঁটা রঙের সমন্বয়ে একটি আনন্দময় নান্দনিক অভিব্যক্তি। শিল্পী শহীদ কবিরের চিত্রভাবনায় কিছুটা যুক্ত হয়েছে মরমীয়া আধ্যাত্মিকতা, মানবিক অস্তিত্বের সঙ্কট ও মৃত্যুচিন্তা। তবে সাম্প্রতিক চিত্রকর্মে অকিঞ্চিৎকর বস্ত্তকে রঙের বিক্ষত প্রয়োগে ও পরিসরব্যাপি উপস্থাপনের প্রয়াসে ভিন্নতর দ্যোতনা সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষণীয়। শিল্পচর্চায় মনসুরউল করিম নিরীক্ষাপ্রবণ। তাঁর পরিণত ও স্বকীয় প্রকাশভঙ্গি জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা বিশেষভাবে শিল্পমনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। চন্দ্রশেখর দে বিমূর্ত আকৃতির সুচারু বিন্যাস ও সংবেদনশীল বর্ণের পারস্পরিক সম্পর্ককে কুশলতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। তবে পরবর্তীকালে কখনও তিনি কাজ করেছেন সরলীকৃত মানবরূপের বিন্যাস নিয়ে, কখনও অত্যন্ত অলংকৃত নকশাদারিত্বই তাঁর চিত্রতলের মূল বিষয় হয়ে উঠেছে।

হাসি চক্রবর্তীর প্রধান আকর্ষণ বর্ণের সুষমা ও প্রকৃতিতে আলোছায়ার খেলার প্রতি। তাঁর লাবণ্যময় বর্ণবিন্যাস ও আলোছায়ার ঝিলিমিলি এক ছন্দোময় মায়াবী জগতের রূপ তুলে ধরে। কাজী গিয়াস জলরঙ ও তেলরঙ উভয়ক্ষেত্রেই চিত্রতলকে গড়ে তোলেন ঘননিবদ্ধ বুনট-ধর্মিতায়। বর্ণ ব্যবহারে তিনি সূক্ষ্ম-সংবেদনশীল কুশলতার অধিকারী। স্বপন চৌধুরী চিত্রতলে বুনট নির্মাণের প্রতি অতিশয় আগ্রহী; বিভিন্ন বস্ত্ত ক্যানভাসে সেঁটে চিত্রতলে বিশেষ অনুভূতির আবহ নির্মাণ করতে চান তিনি। মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যে, ভিন্নতায় এবং অভিনবত্ব উপস্থাপনায় সত্তরের দশকের জাঁকালো শিল্পী কালিদাস কর্মকার। তিনি তেলরঙ, গোয়াশ থেকে বিচিত্র রকমের মিশ্র মাধ্যমে কাজ করেছেন। মূর্ত বা বিমূর্তবাদী যাই হোক তাঁর ছবিতে একটি প্রাচ্য-চরিত্র লক্ষগোচর থাকে। মাহমুদুল হক জাপানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ছাপচিত্রে কারিগরী কুশলতা অর্জন সত্ত্বেও তিনি প্রধানত তৈলচিত্রী হিসেবেই অধিক মনোযোগী রয়েছেন এবং ক্রমশই অগ্রসর হয়েছেন পশ্চাৎপট থেকে জ্যামিতি ও রঙের আলাদা আলাদা পরিসর মুছে ফেলে একটি পরস্পর বিলীয়মান রঙের বিমূর্ত চিত্রাভাস নির্মাণের দিকে। শাহাবুদ্দিন মানবশরীরের নিছক বাস্তবতাকে ভেঙে তুলির প্রবল ক্ষিপ্র চালনায় গড়ে তোলেন ভিন্নতর দ্যোতনা। শাহাবুদ্দিনের সমসাময়িক কেএমএ কাইয়ুম-এর অন্বিষ্ট চিত্রে অবিমিশ্র শুদ্ধ সৌন্দর্য। কাইয়ুম স্বভাব-রোম্যান্টিক, তাঁর ছবিতে আপাত কোনো মূর্তমানতা বা সাদৃশ্য লক্ষ্যগোচর না হলেও এগুলি একটি জৈবিক প্রাণময়তার অনুভূতি সঞ্চার করে। ফরিদা জামান বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাঙালি জীবনের অতি পরিচিত নদী, মাছ, জাল। ইতোপূর্বে বিষয়টি বহু-ব্যবহূত হলেও তিনি তাতে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি চরিত্র অর্পণ করতে সমর্থ হয়েছেন।

উল্লিখিত শিল্পীরা ছাড়া আরও কতিপয় শিল্পী সত্তরের দশকে চিত্রকর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং বিভিন্ন শৈলীতে শিল্পসৃষ্টি করে চলেছেন। এঁদের মধ্যে মনজুরুল হাই, বীরেন সোম, প্রয়াত মাহবুবুল আমিন, আবুল বারক আলভী, প্রয়াত কাজী হাসান হাবিব, আসেম আনসারী, মারুফ আহমেদ, বনিজুল হক প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়।

কালীঘাট পটচিত্র

শিল্পের বিভিন্ন শাখায় ও মাধ্যমে নতুন নতুন শৈলী ও প্রকরণের পরীক্ষানিরীক্ষায় আশির দশকের শিল্পধারা যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ। এ দশকের একটি বৈশিষ্ট্য হলো বেশসংখ্যক মহিলা শিল্পীর আগমন। আশির দশকে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে শিল্পে স্থান দেওয়ার ক্ষেত্রে আবেগের পরিবর্তে বুদ্ধিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটেছে। পাশ্চাত্যের অতি-আধুনিক নানা প্রকরণও আরও বেশি করে ঠাঁই করে নিয়েছে বাংলদেশের শিল্পে। বিমূর্ততা একটি বড় ধারা হিসেবে থাকলেও পাশ্চাত্যশিল্পের অন্যান্য অতি-আধুনিক ধারার প্রভাবও কিছু কিছু পড়েছে-যেমন চিন্তনধর্মী শিল্প (Conceptual Art), বিশেষ করে  স্থাপনা (Installations) শিল্পকর্মের প্রচলন। আশির দশকের চিত্রশিল্পী হিসেবে যাঁদের নাম উল্লেখ করা যায় তাঁরা হলেন রনজিৎ দাস, কাজী রকিব, জামাল আহমেদ, মোহাম্মদ ইউনুস, তরুণ ঘোষ, শাহাদত হুসেন, রুহুল আমিন কাজল, জিএস কবির, ঢালী আল মামুন, নাসরীন বেগম, রোকেয়া সুলতানা, শিশির ভট্টাচার্য, নিসার হোসেন, নাজলী লায়লা মনসুর, দিলারা বেগম জলি, শেখ আফজাল, নিলুফার চামান, আতিয়া ইসলাম অ্যানি প্রমুখ।

নববইয়ের দশকের সূচনাকাল থেকে প্রধানত চিত্রকলা এবং চিত্রকলাসম্পৃক্ত মিশ্র উপস্থাপনের মাধ্যমে কাজ করছেন আবদুস শাকুর শাহ, কনকচাঁপা চাকমা, মাহবুবুর রহমান, তৈয়বা বেগম লিপি, অশোক কর্মকার, সুলেখা চৌধুরী, তাসাদ্দুক হোসেন দুলু ও রনি আহাম্মদ প্রমুখ।

চিত্রকলাভিত্তিক কাজের মাধ্যমে আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন ফাহমিদা আক্তার কাকলী, ফারুক আহাম্মদ, বিপুল শাহ, জাহেদ আলী চৌধুরী, আশরাফুল হাসান, আবদুস সালামসহ অনেক নবীন শিল্পী। সম্ভবত আগামী কয়েক দশকের শিল্পরূপ এঁদের হাতেই পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। এ দশক থেকে বাংলাদেশের শিল্পকলা জগতে নব্য শিল্পচিন্তাসমূহের প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়তে শুরু করে। এসময় চারুশিল্পীরা ইনস্টলেশনস বা স্থাপনাশিল্পের পাশাপাশি করছেন ভিডিওচিত্র, পারফর্মেন্স, সাইট-স্পেসিফিক আর্ট, হ্যাপেনিং ইত্যাদি নানাবিধ সংস্থাপন ও উপস্থাপন। এ কারণে শিল্পের এসব প্রকাশশৈলীকে প্রচলিত বিভাজনের কুঠুরির মধ্যে ফেলে আর বিবেচনা করা সম্ভব নয়।  [আবুল মনসুর]

গ্রন্থপঞ্জি  অশোক দত্ত, ‘আর্লিয়েন্ট এভিডেন্স অফ পেইন্টিং ইন বেঙ্গল’, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম বুলেটিন, (কলকাতা, ১৯৮৮-১৯৮৯); সরসীকুমার সরস্বতী, পালযুগের চিত্রকলা, (কলকাতা, ১৯৭৮), পার্সী ব্রাউন, ইন্ডিয়ান পেইন্টিংস আন্ডার দ্যা মুঘলস, (নিউ-দিল্লী, ১৯২৯); কে.কে. গাঙ্গুলী, ‘পেইন্টিংস অফ মুর্শিদাবাদ’, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ডায়মন্ড-জুবিলী ভল্যুম, (কলকাতা, ১৯৮১); মিলড্রেড এন্ড ডব্লিউ.জি. আচার, ইন্ডিয়ান পেইন্টিংস ফর দ্যা ব্রিটিশ, (লন্ডন, ১৯৬৫)।