গঙ্গার পানিবণ্টন
গঙ্গার পানিবণ্টন বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল। ৫৮টি আন্তর্জাতিক নদীসহ কমপক্ষে ২৩০টি নদ-নদী বিধৌত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীগুলির মধ্যে ৫৫টির উৎপত্তি ভারত থেকে এবং তিনটি মায়ানমার থেকে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার উপনদী ও শাখানদী বিধৌত মোট এলাকার পরিমাণ ১৭,২০,০০০ বর্গকিলোমিটার। এ এলাকার শতকরা সাত ভাগ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত।
বর্ষা মৌসুমে পানি বৃদ্ধির ফলে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ স্থলভাগ জলমগ্ন হয়, আবার শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ নদীতে প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার ফলে জলাভাব দেখা দেয়। উভয় পরিস্থিতিই জনজীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এসব নদীর ভাটি অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান হেতু নদীগুলির জলপ্রবাহের ওপর এদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সাত হাজার মিটার উচ্চতায় হিমালয়ের হিমবাহে উৎপন্ন গঙ্গা নদী ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্য দিয়ে ২,৫৫০ কিলোমিটার পথে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের গোয়ালন্দের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশে গঙ্গার (বাংলাদেশে যা পদ্মা নামে অভিহিত) দৈর্ঘ্য ২৬০ কিলোমিটার। গঙ্গা বিধৌত মোট অঞ্চলের আয়তন ১০,৮৭,০০১ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৮,৬০,০০০ বর্গকিলোমিটার ভারতে, ১,৪৭,১৮১ বর্গকিলোমিটার নেপালে, ৩৩,৫২০ বর্গকিলোমিটার চীনে এবং ৪৬,৩০০ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে। ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রথম পরিকল্পনা করে ১৯৫১ সালে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে এর সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তখন থেকেই পাকিস্তান সরকার প্রতিবাদ জানাতে থাকে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার নতুন পথ উন্মুক্ত হয় এবং বাংলাদেশ সরকার গঙ্গার পানি বণ্টনের সমস্যা সমাধানে মোটেও বিলম্ব করে নি। এ অঞ্চলের পানিসম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একটি স্থায়ী যৌথ নদী কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে এক যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের নভেম্বরে একটি যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। নদী কমিশনের লক্ষ্য ছিল উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলি থেকে সর্বাধিক সুবিধা লাভের লক্ষ্যে যৌথ প্রয়াস চালানো, বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও যৌথভাবে তা বাস্তবায়ন করা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস নির্ণয়ের বিশদ পদক্ষেপ সুপারিশ করা এবং পানিসম্পদের সুষম বণ্টনের ভিত্তিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পগুলোর জন্য সমীক্ষা ও জরিপ চালানো। ১৯৭৪ সালের মে মাসে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি যৌথ ঘোষণাপত্রে একমত প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ ও কলকাতা বন্দরের পূর্ণ চাহিদা মেটানোর জন্য শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কার কাছে গঙ্গা নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন এবং এ লক্ষ্যে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার আগেই উভয় দেশের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য চুক্তি সম্পাদন সম্ভব। ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে ভারতকে ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য বাঁধের সংযোগ খালগুলো পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার অনুমতি দেয়া হয়।
১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও ভারত একতরফা গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে আলোচনার উদ্যোগ ভেঙে যায় এবং বাংলাদেশ বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সমস্যাটি প্রথম উত্থাপিত হয় ১৯৭৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ইসলামি দেশসমূহের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সম্মেলনে এবং এরপর ওই বছর আগস্টে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে।
১৯৭৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৩১তম অধিবেশনে বিষয়টি উত্থাপনের সিদ্ধান্তের ফলে দু’দেশের কূটনৈতিক কর্মকান্ড জোরদার হয়ে ওঠে। সেনেগাল, অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার অনুরোধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক কমিটি ভারত ও বাংলাদেশকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার আহবান জানায়। সিরিয়া, মিশর, শ্রীলঙ্কা, আলজেরিয়া ও গায়ানার মধ্যস্থতায় সাড়া দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ ঢাকায় আলোচনায় বসতে সম্মত হয়। কিন্তু আলোচনা ফলপ্রসূ হয় নি।
ভারতে জনতা দল সরকার গঠনের পর আলোচনার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের জিয়াউর রহমান সরকারের সঙ্গে পানি বণ্টন বিষয়ে পাঁচ বছর মেয়াদী একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮২ সালে সে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮২ সালের ৪ অক্টোবর জেনারেল এরশাদ সরকার ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন বিষয়ে দু বছর মেয়াদী একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ১৯৮৫ সালের ২২ নভেম্বর তিন বছরের জন্য আরেকটি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু যেহেতু তখনও পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির ব্যাপারে কোনো চুক্তি ছিল না, তাই ভারত পানি বণ্টন বিষয়ক সমঝোতা চুক্তির মেয়াদ আর বৃদ্ধি করতে সম্মত হয় নি। সর্বশেষ চুক্তিতে বাংলাদেশের ৩৪,৫০০ কিউসেক পানি পাওয়ার কথা থাকলেও ভারত ১৯৯৩ সালের শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে ১০ হাজার কিউসেকেরও কম পানির প্রবাহ রাখে। কোনো চুক্তি কার্যকর না থাকায় ভারত বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে অব্যাহতভাবে বঞ্চিত করে চলে। ভারতের সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি না হওয়ায় বিএনপি সরকার বিষয়টি আবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করে। ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে সাইপ্রাসে অনুষ্ঠিত কমনওয়েল্থ শীর্ষ সম্মেলনেও তা উত্থাপিত হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর গঙ্গার পানি বন্টন সম্পর্কে নতুন করে আলোচনা শুরু হয় এবং ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে নির্ধারিত হয় যে, উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে গৃহীত ফর্মুলা মোতাবেক ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়ে দু’দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি হবে, এবং ভারত নদীটির জলপ্রবাহের মাত্রা গত ৪০ বছরের গড় মাত্রায় বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। যেকোন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানির নিশ্চয়তা পাবে। দীর্ঘ মেয়াদে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে উভয় দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজনে এবং দুদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্যান্য নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ চুক্তিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে একমত হয়।
এ দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির ফলে বাংলাদেশে গঙ্গার পানিপ্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারতের পূর্বশর্ত প্রথমবারের মতো তুলে নেওয়া হয়, এবং ভাটি অঞ্চলের অংশীদার হিসাবে গঙ্গার বিদ্যমান পানিপ্রবাহে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ চুক্তির ফলে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্কের তিক্ত একটি ইস্যুর অবসান ঘটে এবং সমগ্র অঞ্চলের পানিসম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বৃহত্তর সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত হয়। [এনামুল হক]
আরও দেখুন ফারাক্কা বাঁধ।