খাদ্যসামগ্রী

খাদ্যসামগ্রী  শারীরিক বৃদ্ধি এবং সুস্থতা বজায় রাখার জন্য দেহে পুষ্টির চাহিদা পূরণের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। এ উদ্দেশ্য পূরণের কাজে দেহে পর্যাপ্ত শক্তি সরবরাহ করার জন্য খাদ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণে শর্করা এবং চর্বি থাকতে হবে। শরীরের ক্ষয়পূরণ এবং সুগঠনের জন্য খাদ্যে আমিষের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। এ ছাড়া বিভিন্ন রোগের কবল থেকে শরীরকে মুক্ত রাখার জন্য খাদ্যে ভিটামিন, খনিজ, অাঁশ (fibre) এবং পানি অপরিহার্য। খাদ্যবাছাইকরণ এবং গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা, ক্ষুধানিবৃত্তি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়। খাদ্যবস্ত্ত উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় কিছু কিছু শর্ত যেমন পুষ্টিকর উপাদানের পর্যাপ্ততা, খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব, খাদ্যে ব্যবহূত সামগ্রী, নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা, খাদ্যের পরিচ্ছন্নতা, খাদ্যে অ্যালার্জি, খাদ্যদূষণ, খাদ্যবাহিত রোগ, খাদ্য সম্পর্কে যুক্তিহীন ও অমূলক ধারণা, খাদ্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধিকরণ, খাদ্যের প্রতি বিরূপ ধারণা বা মনোভাব পোষণ ইত্যাদিকে যথাযথ বিবেচনায় রাখা একটি অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ। যেখানে বাংলাদেশে মানুষের জীবনে অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি সমান্তরালে চলে সেখানে খাদ্যদ্রব্য উন্নয়নের প্রক্রিয়া এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের ওপর এ শর্তগুলি যৌথ প্রভাব বিস্তার করে।

দেশে কিছু কিছু খাদ্যের মান এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার নিয়মনীতি তৈরি করা হয়েছে। রপ্তানিযোগ্য খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট আইন এবং নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় ক্রেতাদের অধিকার রক্ষায় কিছু কিছু খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইন ব্যবস্থার কিছুটা পরিবর্তন করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। খাদ্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অব্যবস্থাপনা দেশে রোগব্যাধি বিস্তারের একটি প্রধান কারণ। বাংলাদেশের মানুষ সুস্বাদু খাদ্যের প্রতি অতিমাত্রায় অনুরক্ত। অধিকাংশ পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্র পর্যায়ের অনুষ্ঠানেও প্রায় একই জাতীয় খাদ্য পরিবেশনে দেশের সংস্কৃতির ধরন পরিলক্ষিত হয়। দেশের প্রধান খাদ্যদ্রব্যের তালিকায় রয়েছে খাদ্যশস্য বা শর্করা,  মাছ, মাংস,  ফল এবং  শাকসবজি, দুগ্ধজাত দ্রব্য ইত্যাদি। শিক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে ক্রমাগত সংযোগের ফলে বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রাচীন, গ্রামীণ রুচি ও রীতিনীতি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর ফলে খাদ্যদ্রব্য বাছাই এবং পছন্দেরও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দেশের বাইরে তৈরি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা হচ্ছে এবং এর ফলে স্থানীয় খাদ্যদ্রব্য বাছাই ও প্রস্ত্ততকরণ পদ্ধতির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়ছে।

এদেশে ব্যবহূত প্রধান খাদ্য উপাদান হলো চাল যা মোট খাদ্যশস্যের প্রায় তিরানববই শতাংশ। পরবর্তী প্রধান খাদ্যশস্য গম, যা দেশে গৃহীত মোট খাদ্যশস্যের প্রায় ৭ শতাংশ। দেশে প্রতি বছর মাথাপিছু খাদ্যশস্য গ্রহণের পরিমাণ প্রায় ২৩৮ কিলোগ্রাম। স্বল্প আয়ের পরিবার অধিক আয়ের পরিবারের তুলনায় বেশি গম ব্যবহার করে থাকে। খাদ্যশস্য থেকে তৈরী খাদ্যের চারটি ভাগ হলো ময়দা থেকে বেকিংয়ের (উত্তাপ বা সেঁকা) মাধ্যমে তৈরী খাদ্যদ্রব্য। এর মধ্যে রয়েছে রুটি, পাউরুটি, পেস্ট্রি, প্যানকেক, চাপাতি, বিস্কুট এবং কেক। রুটি, পরোটা এবং নুডলস এ দলের প্রধান খাদ্যদ্রব্যের অন্যতম।

ভাত বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। শস্য গুঁড়া সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে মিহি চাল, গমের ময়দা, ভুট্টাজাত খাদ্য, দুগ্ধ বা পানিতে সিদ্ধ ভুট্টাচূর্ণ, ভুট্টার মোটা ধরনের গুঁড়া দানা, ইত্যাদি। এ ছাড়া পপকর্ন, ভাজা ও ফোলানো শস্য এবং চাল থেকে ঘরে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী।

চাল থেকে তৈরি খাদ্য  বর্তমানে প্রতি বছর মাথাপিছু চালের ব্যবহারের মাত্রা প্রায় ২০৮ কিলোগ্রাম। চাল দিয়ে খাদ্যে ব্যবহূত আরও কিছু উপাদান ও চিনি সহযোগে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টিজাতীয় খাদ্য তৈরি করা যায়। চালের গুঁড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যদ্রব্য হিসেবে বিবেচিত। চালের গুঁড়া থেকে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাদ্যসামগ্রী যেমন পিঠা, চাপাতি অথবা রুটি তৈরি করা হয়। সুজি ও সেমাই অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীদের আরোগ্যের পর ক্রমশ স্বাস্থ্যলাভের সময়ে অত্যন্ত উপযোগী। বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরীতে ধান ও চাল বিভিন্ন উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয় যেগুলি সহজেই খাওয়া যায় যেমন চিড়া, খৈ, মুড়ি এবং কয়েক প্রকারের ভাজা খাদ্যদ্রব্য।

আলু থেকে তৈরী খাদ্য  বাংলাদেশে আলু প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের তুলনায় সবজি হিসেবে অধিক পরিচিত। বাংলাদেশ প্রায় ৮২ লক্ষ মে টন আলু উৎপাদন করে যা দেশে মোট সবজি উৎপাদনের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি। এ ছাড়া সামান্য পরিমাণে মিষ্টিআলু উৎপাদন করা হয় যা সিদ্ধ করে অথবা পুড়িয়ে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভোক্তার রুচির ওপর নির্ভর করে মাছ, মাংস এবং  ডাল দিয়ে সাধারণত বিভিন্ন প্রকারের আলুর তরকারি তৈরি করা হয়। আলু ভর্তা অত্যন্ত জনপ্রিয়। আলু থেকে তৈরী উল্লেখযোগ্য খাদ্যসামগ্রী হচ্ছে সিদ্ধ আলু, ভাজা আলু, চটকানো আলু, আলুর রুটি (baked potato), আলুর চপ, আলুর সবজি মিশ্রণ, আলু সিঙ্গাড়া, আলু চিপস প্রভৃতি। সম্প্রতি দেশের বেকারি ও ফাস্টফুডের দোকানগুলি আলু দিয়ে নানা রকম সুস্বাদু খাবার তৈরি শুরু করেছে।

মাছজাত খাদ্য  মাছ সবচেয়ে উপাদেয় জনপ্রিয় খাদ্য। কেবল বাংলাদেশের মানুষেরই নয়, পৃথিবীর বহু জাতির কাছেও। মাছ সর্বদাই সুস্বাদু ও উচ্চমানের প্রোটিন সরবরাহ করে থাকে, তাই বাংলাদেশের জনগণের প্রতিদিনের অন্যতম প্রধান খাদ্য মাছ। প্রকৃতি প্রদত্ত ও প্রধান আহার্য বিধায় ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের মানুষকে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। প্রায় ২৬৬ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ এবং ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ দেশে পাওয়া যায়। কিছু কিছু মাছ, যেমন পুঁটি মাছ পচানো বা গাঁজানো মাধ্যমে চ্যাপা শুঁটকি তৈরি করা হয় যা সবার কাছেই অত্যন্ত প্রিয়। মাছ ভাজা একটি জনপ্রিয় খাদ্য। বিশেষ করে  ইলিশ মাছ। নোনা ইলিশের তরকারি একটি সুস্বাদু খাবার। সরিষাবাটা,  পিঁয়াজ এবং অন্যান্য  মসলা সহযোগে রান্নাকৃত ইলিশের স্বাদ অতুলনীয়। নোনা ইলিশ বিভিন্নভাবে রান্না করা যায়। ইলিশ মাছের একটি উপাদেয় খাদ্য হলো ইলিশ পোলাও।

মাংসজাত খাদ্য  বাংলাদেশে গরু, মুরগি, মহিষ এবং খাসির মাংসের ব্যবহার অধিক প্রচলিত। দেশে প্রতি বছর মাথাপিছু সকল প্রকার মাংস গ্রহণের পরিমাণ গড়ে প্রায় ৩.৫ কেজি। যেহেতু খাদ্যশস্যের চেয়ে মাংস তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল, তাই মাংস গ্রহণের মাত্রা উপার্জন মাত্রার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাটকা মাংস খাওয়া হয়ে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাংস রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয় এবং রান্না করার পূর্বে পুনরায় পানিতে ভিজিয়ে নেওয়া হয়। মাংস প্রধানত কারি, ভুনা এবং কাবাব হিসেবে খাওয়া হয়। আবার কখনও কখনও মাংস উত্তাপে ঝলসিয়ে অথবা ভেজে খাওয়া হয়। মাংসের কারি, মাংস পোলাও, বিরিয়ানি, বটি কাবাব, শিক কাবাব, শামি কাবাব, টকমিষ্টি মাংস, মাংসের চাটনি, মাংসের স্ট্যু (stew), পিঁয়াজসহ মাংস, কালিয়া, কোপ্তা, মুসাল্লাম, টিকিয়া, কোরমা এবং আরও অনেক খাদ্যদ্রব্য মাংস থেকে তৈরি করা হয়।

সবজিজাত খাদ্য  কিছু কিছু উদ্ভিদের পাতা, মূল, কান্ড, ফুল অথবা ফল সালাদের সামগ্রী হিসেবে কাঁচা অবস্থায় খাওয়া যায়। আবার কিছু কিছু সিদ্ধ করে, পুড়িয়ে অথবা মাংস, মাছ ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য সহযোগে রান্না করে খাওয়া যায়। প্রায় ২৫০টি প্রজাতির উদ্ভিদ এবং এগুলির বিভিন্ন অংশ শাকসবজি হিসেবে খাওয়ার প্রচলন দেশে রয়েছে। শাকসবজি বিশেষত সবুজ শাকসবজি ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের প্রধান উৎস হিসেবে পরিচিত। এ সবজিগুলিতে ক্যালরি ও আমিষের পরিমাণ কম থাকে এবং পানি ও সেলুলোজের পরিমাণ বেশি থাকে। এগুলি সাধারণত লৌহ এবং ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ সমৃদ্ধ। এজন্য এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদানে সক্ষম খাদ্য বলা হয়।

শুধু একটি সবজি দিয়ে অথবা অন্যান্য শাকসবজি সমন্বয়ে বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা যায়। শাকসবজির সঙ্গে মাছ, মাংস, ডাল অথবা খাদ্যশস্য যোগ করে কিংবা এগুলি ছাড়াই বিভিন্ন প্রণালীতে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হয়ে থাকে। পিঁয়াজ, কাঁচা টমেটো, কাঁচা আম, কাঁচা মরিচ, জলপাই, রসুন, ধনেপাতা, লেবু ও তেঁতুল থেকে সস, চাটনি এবং আচার তৈরি করা হয়। কখনও কখনও টকমিষ্টি স্বাদের জন্য চিনি যোগ করা হয়। কয়েক ধরনের সবজি থেকে হালুয়া এবং মোরববা তৈরি করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য  গাজর, বীট,  লাউ-কুমড়া, মিষ্টিআলু, কাঁচা আম ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে স্যুপ তৈরির কাজে শাকসবজি ব্যবহার করা হয়। খাদ্যশস্য এবং সবজি দিয়ে তৈরীকৃত ভেজিটেবল পোলাও বা খিচুড়ি একটি জনপ্রিয় খাদ্য।  [এম কবিরউল্লাহ]

আরও দেখুন খাদ্যাভ্যাস; খাদ্য নিরাপত্তা; খাদ্য পুষ্টিবৃদ্ধিকরণ; খাদ্যবাহিত রোগ; খাদ্য সংরক্ষণ; খাদ্যে ভেজাল