কীর্তিপাশা জমিদার পরিবার
কীর্তিপাশা জমিদার পরিবার ঝালকাঠি জেলার বৈদ্য বংশীয় জমিদার। কীর্তিপাশার জমিদারগণের আদি বাসস্থান বিক্রমপুর পরগণার পোড়াগাছা গ্রাম। দুর্গাদাস সেন এ জমিদার পরিবারের আদি পুরুষ। দুর্গাদাস সেনের পুত্র রামজীবন। রামজীবনের দুই পুত্র রামগোপাল ও রামেস্বর সেন। এ বংশের রাজকৃষ্ণ সেন ঢাকায় মুগল সরকারে চাকরি করেন। পরবর্তী সময়ে রাজকৃষ্ণের পুত্র কৃষ্ণরাম, বিষ্ণুরাম ও রঘুনাথ সেলিমাবাদ পরগণার (রায়েরকাঠি) জমিদার রাজা জয়নারায়ণের অধীনে চাকরি করেন। রঘুনাথ সেন স্বীয় দক্ষতা গুণে রায়েরকাঠি রাজাদের প্রধান দীউয়ান নিযুক্ত হন এবং মুগল সরকার থেকে মজুমদার’উপাধি লাভ করেন। ঢাকার নায়েব নাজিম নওয়াজিস মুহম্মদের আমলে কৃষ্ণরামের বুদ্ধিমত্তার গুণে এক সময় খাজনা অনাদায়ের কারণে সেলিমাবাদের জমিদারি নিলাম থেকে রক্ষা পায়। পুরস্কারস্বরূপ রাজা জয়নারায়ণ একটি বৃহৎ তালুক (কীর্তিপাশা) সৃষ্টি করে তাঁকে দান করেন। রায়েরকাঠির রাজা জয়নারায়ণের পৃষ্ঠপোষকতায় আঠারো শতকের মধ্যেই কীর্তিপাশার সেন পরিবার একটি বৃহৎ জমিদার পরিবারে পরিণত হয়। কীর্তিপাশার জমিদারদের মধ্যে কাশীরাম তিন আনি, কৃষ্ণরাম ও রাজারাম ছয় আনি, বিষ্ণুরাম তিন আনি এবং বলরাম সেন চার আনি জমিদারির স্বত্ব লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে বিষ্ণুরাম সেন, বলরাম সেন এবং কাশীরাম সেন স্ব স্ব নামে সেলিমাবাদ পরগনায় জমিদারি ক্রয় করেন।
কীর্তিপাশার জমিদারগণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘মজুমদার’ এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর পর ‘চৌধুরী’ উপাধিতে ভূষিত হন। এ পরিবারের রাজকুমার সেনের আমলে ১২৪৪ বঙ্গাব্দে জমিদারি নিয়ে গৃহবিবাদ শুরু হয়। বরিশালের সাবজজ কীর্তিপাশায় উপস্থিত হয়ে এ বিবাদের অবসান ঘটান। রাজকুমারের মৃত্যুর পর তৎপুত্র প্রসন্নকুমার রায়চৌধুরী নাবালক থাকায় এ জমিদারি বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে যায় এবং সহকারী কালেক্টর মি. রেলী প্রসন্নকুমারের অভিভাবক নিযুক্ত হন। পরে কোর্ট অব ওয়ার্ডস থেকে মুক্ত হয়ে কীর্তিপাশার জমিদারি বড় হিস্যা ও ছোট হিস্যায় বিভক্ত হয়।
প্রসন্নকুমার রায়চৌধুরী ১৮৭১ সালে কীর্তিপাশায় একটি মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় ও ১৮৭২ সালে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৬ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক (১৮২৬-১৯০৪) ঢাকায় আগমন করলে তিনি একজন মানী ব্যক্তি হিসেবে আমন্ত্রিত হন। ১৮৭৭ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস কলকাতায় আগমন করলে প্রসন্নকুমার তাঁর দরবারে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কলকাতার জুওলজিকাল গার্ডেন, রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি, জমিদারি পঞ্চায়েত এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন। তাঁর পুত্র রোহিনীকুমার রায়চৌধুরী ঔপন্যাসিক ও ইতিহাসবিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। রোহিনীকুমার রায়চৌধুরীর বরিশালের ইতিহাস ‘বাকলা’ এবং পারিবারিক ইতিহাস ‘আমার পূর্বপুরুষ’ দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ পরিবারের শশীকুমার রায়চৌধুরী ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ। তাছাড়া অধ্যাপক তপন কুমার রায়চৌধুরী বর্তমান সময়ের একজন খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও লেখক।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এ জমিদার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য দেশত্যাগ করেন। ১৯৫০ সালে জমিদারি বিলুপ্তি আইন কার্যকর হলে কীর্তিপাশা জমিদারির দীর্ঘ ইতিহাসের অবসান ঘটে। উত্তরাধিকারীগণ সরকারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ লাভ করেন। [দেলওয়ার হাসান]