কাপালী
কাপালী বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। ব্রিটিশ আমলে এরা সিলেটের চা বাগানগুলোতে চা শ্রমিক হিসাবে স্থায়ীভাবে অভিবাসী হয়। বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন চা বাগানে এদের দেখা যায়। এরা সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। মহাদেব শিবের কপাল থেকে উৎপত্তি বলেই তাদের নামকরণ হয়েছে কাপালী।
কাপালী সম্প্রদায় তিনটি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলো হচ্ছে কাশ্যপ, হরিহর এবং আলীম্মন। এই গোত্র তিনটির প্রতিটি আবার কয়েকটি বংশে বিভক্ত। এই বংশ তথা উপগোত্রই তাদের সামাজিক রীতিনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে এই উপগোত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিজ উপগোত্র তথা বংশের মধ্যে বিবাহ কাপালী সম্প্রদায়ে নিষিদ্ধ। তারা বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী। কাপালী সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় ছেলেরা। মেয়েরা পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত। অতীতে কাপালী সমাজে কোন সামাজিক অথবা পারিবারিক সমস্যার উদ্ভব হলে সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিরা তা সমাধান করতেন। এ কাজ সমাধার জন্য প্রতিটি কাপালী বস্তিতে একজন প্রধান থাকতেন, যাকে মাতববর বলা হত। বর্তমানে সেই মাতববর প্রথা বিলোপ হয়ে গেছে এবং তৎপরিবর্তে গ্রাম পঞ্চায়েত চালু হয়েছে। যে কোন সামাজিক বিচার সালিশে এখন গ্রাম পঞ্চায়েতই বিচারকের ভূমিকা পালন করে। কাপালী সমাজে শিক্ষার হার খুবই কম। মাত্র ১০% লোক অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন।
কাপালী সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা বাংলা। বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণ থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের সময় তারা বাংলা ভাষাই ব্যবহার করে। তারা নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের সময় কক্বরক ভাষা ব্যবহার করে।
কাপালীরা আমিষভোজী। ভাত তাদের প্রধান খাদ্য এবং মাছ, মাংস, ডিম, ডাল এবং নানা ধরণের শাকসবজি আহার করে। জঙ্গলে উৎপন্ন বন্য আলু এবং দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য তাদের নিকট খুব প্রিয়। চা পানের প্রচলনও তাদের মধ্যে ব্যাপক। কাপালী সমাজে মদ্যপানের প্রচলন রয়েছে। নানা উৎসবাদিতে তারা শূকরের মাংস সহযোগে ভোজের আয়োজন করে। পৌষ সংক্রান্তিকে তারা আলন্তি বলে এবং সেদিন পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় সবাই মিলে একত্রে পিঠা খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করে।
কাপালী সম্প্রদায়ের বিবাহ অনুষ্ঠান বেশ আচারবহুল। ছেলেমেয়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হলে অভিভাবকরাই বিবাহের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ছেলের বয়স ২০ থেকে ২৫ এবং মেয়ের বয়স ১৬ থেকে ২০ বছর হলে বিবাহযোগ্যা বলে বিবেচিত হয়। আলাপ আলোচনা চলার পর ছেলেমেয়ের সম্মতি সাপেক্ষে বিবাহের কথা চূড়ান্ত করা হয়। জোকার দেওয়া অর্থাৎ হুলুধ্বনির মাধ্যমে উহা ঘোষণা করা হয়। এই সমবেত জোকার দেওয়ার জন্য প্রতিবেশীর সধবা মহিলাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তারাই সমবেত হুলুধ্বনির মাধ্যমে সবাইকে জানান দেয়। কাপালী বিবাহ অসবর্ণ প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নিজ বংশ বা গোত্রমধ্যে বিবাহ কাপালী সমাজে নিষিদ্ধ। কাপালী সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন বিদ্যমান। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রথাও বিদ্যমান। স্বামী অথবা স্ত্রীর যে কেউ বিবাহ বিচ্ছেদ গ্রহণ করতে পারে। বিবাহবিচ্ছেদপ্রাপ্তা স্ত্রীকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হয়। কাপালী সমাজে যৌতুক প্রথাও বিদ্যমান।
কাপালীরা অধিকাংশ শৈব মতের অনুসারী। তাদের উপাস্য দেবদেবীর মধ্যে শিব, শ্যামা, লক্ষ্মী প্রভৃতি প্রধান। মহাদেব শিব এবং সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মীকে তারা পারিবারিকভাবে পূজা করে। দেবী কালীকে তারা গ্রামের রক্ষাকারী হিসেবে মানে এবং সেভাবেই তারা প্রতিটি গ্রামে কালী দেবীর জন্য নির্দিষ্ট একটি থান সংরক্ষিত রাখে। ধর্মীয় উৎসবাদির মধ্যে কাপালীরা গাজন, কালীপূজা, দূর্গাপূজা, রথযাত্রা, খারচিপূজা প্রভৃতির উৎসব সাড়ম্বরে পালন করে। তারা পূনর্জন্মেও বিশ্বাসী এবং একই সঙ্গে কর্মফলে বিশ্বাসী।
কাপালী সমাজ ঐতিহ্যবাহী নানা গল্প কাহিনী লোকগাঁথা বংশপরম্পরায় সংরক্ষণ করে চলেছে এবং বিভিন্ন সামাজিক উৎসবাদিতে তারা এইসব লোকগাঁথা শুনে শুনে বিশেষ আনন্দ পায়। তাদের সমাজে এক শ্রেণির কথক রয়েছে যারা অতি নিপুণভাবে সেইসব লোকগাঁথা বিভিন্ন উৎসবে পাঠ করেন। [সুভাষ জেংচাম]