কলু
কলু তেলবীজ থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদনে নিয়োজিত পেশাজীবী সম্প্রদায়। দক্ষিণ এশিয়ায় বহুদিন আগে থেকে ভোজ্য তেলের ব্যবহার চালু আছে। দু হাজার তিনশ বছর আগে পুন্ড্রবর্ধন এ এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার জন্য মৌর্য সম্রাট রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ধান, তিল ও সরিষা পুন্ড্রনগরের জনসাধারণকে সরবরাহ করার জন্য স্থানীয় শাসনকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ থেকে তেলের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘কলু’ শব্দটি দেশজ।
হিন্দিতে বলে কোলহু। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও নদীয়া জেলা এবং বাংলাদেশের নাটোর অঞ্চলে কলুকে খলু বলা হয়। কলু শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘তৈল ব্যবসায়ী হিন্দু ও মুসলিম জাতি বিশেষ’। তেলের সঙ্গেই এদের সম্পর্ক। আমাদের দেশের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী কলু ও তেলি (তেলি, তিলি, তিলী, তৈলিক ইত্যাদি বানানও প্রচলিত) মূলত একই অর্থে ব্যবহূত হয়। কলুরা ঘানিতে সরিষা, তিসি, সয়াবিন, সরগুজা (গুজি), সূর্যমুখী, ভেন্না, শুকনো নারিকেল ও মান্দার তুলাবীচি ইত্যাদি ভাঙ্গিয়ে অর্থাৎ পিষে তেল নিষ্কাশন করত। তেলিরা ওই তেল বিক্রয় করত। তবে অতীতের মতো আজও সাধারণত দেখা যায়, যারা কলু তারাই মূলত তেল বিক্রেতা। একই ব্যক্তি বা একই পরিবার উভয় কাজই করে। বাংলাদেশে বর্তমানে কাঠের ও যান্ত্রিক ঘানিতে বা কলে সব রকমের তেল উৎপাদন বা নিষ্কাশন করা হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে কলুরা তেল নিষ্কাশনের নানা কৌশল ও যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে। উড়িষ্যা প্রদেশের উত্তরাংশে সঢ়ইকলা নামক একটি স্থানে তিন রকমের তেল নিষ্কাশনের ঘানি আছে, যেমন: দুই বলদে টানা, নালিবিহীন, কাঠের তৈরি ঘানি; এক বলদে টানা, নালিযুক্ত, কাঠের তৈরি ঘানি; এক বলদে টানা, নালিযুক্ত, দুখন্ড কাঠ দ্বারা তৈরি পিঁড়িবিশিষ্ট ঘানি। প্রথম ধরনের ঘানি শক্ত একখন্ড কাঠ দ্বারা তৈরি। এটি মাটির নিচে ৪/৫ হাত পর্যন্ত পোঁতা হয়, ভূমির উপরে থাকে প্রায় হাত দেড়েক। এ ঘানিগাছের মাথায় খোল থাকে। তেলি তার সুবিধামতো এটি প্রস্ত্তত করে নেয়। অনেকদিন ব্যবহার করলে এর উপরের অংশ ক্ষয়ে যায়, তখন কিছুটা কেটে আবার ব্যবহারের উপযোগী করে নেওয়া হয়। মূল যন্ত্রের নাম হচ্ছে ঘনা। যে দন্ড দ্বারা তেলবীজ পেষা হয় তার নাম লাঠি। বলদ দুটি যে পাটায় জোতা থাকে তাকে পাঁজরি বলে। এর সঙ্গে বাঁশপাতি নামে অন্য একখন্ড কাঠ জোড়া থাকে যার বাঁকা মুখের নাম হলো মগরমুহি। পাঁজরিতে জোয়াল বাঁধা হয়। পাঁজরির উপরে খাড়া মালকুম দন্ডে থাকে দুতিনটি ছিদ্র। আর একখানা বাঁকা কাঠ মালকুমের উপরিভাগে থাকে, তার মধ্যেকার খোপে লাঠির উপরাংশ যথাযথভাবে যুক্ত হয়ে যায়। এ ছাড়া তেল পেষার কাজের সুবিধার জন্য থাকে একটি শাবল, যার মুখখানা ঈষৎ বাঁকানো। খৈল তোলা ও অন্যান্য কাজে তা ব্যবহূত হয়। আর একটা ন্যাকড়া-বাঁধা কাঠের কাঠি থাকে। এর সাহায্যে ঘানির ভেতর থেকে তেল শুষে বের করে নিতে সুবিধা হয়। দু বলদের ঘানি ব্যবহারকারী কলুদের হাতে ব্রাহ্মণ কিংবা বৈষ্ণবরা জল গ্রহণ করে না। জাতি হিসেবে তারা তেলি নামে অভিহিত হয়, তাদের পদবি পড়িহারি। এরা কখনও এক বলদ জোতে না, বলদের চোখে ঠুলি বাঁধে না এবং ঘানি ছিদ্রও করে না। এক বলদে টানা ঘানিগাছ মাটির নিচে থাকে দু হাত ও উপরে থাকে দেড় হাত মাত্র। এরও খোল থাকে, ওই খোলের নিচের দিকে একটি গর্ত থাকে যা দিয়ে নালিপথে তেল চুঁইয়ে বের হয়। এ ঘানির নাম ঘানা। যে নালিপথ দিয়ে তেল বের হয় তার নাম নেরিও। নিচের যে পাত্রে তেল জমা হয় তার নাম গাড়ু অর্থাৎ পাত্র। পেষণ দন্ডের নাম লাটিম। মাটি থেকে উপরের দিকে যে কাঠের পাটা থাকে তাকে বলে কাতের। বাঁকা কাঠের নাম ঢেঁকা। এতে সাধারণত দুতিনটি খোপ কাটা থাকে, এর মধ্যে লাটিমের উপরের অংশ ঢুকানো হয়। লাটিমের সঙ্গে আলগাভাবে যুক্ত থাকে জোয়াল। তার সঙ্গে আড়াআড়িভাবে একটি কাঠি কাতেরের শেষাংশের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে। এ কাঠির নাম গলি। ঘানি চালক কাতেরে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে, আরও ভার লাগলে পাথর বা কাঠখন্ড অর্থাৎ ভারি বস্ত্ত চাপিয়ে রাখা হয়। এক বলদ ও দুই বলদে টানা ঘানির মধ্যে পার্থক্য এই যে, দুই বলদে টানা ঘানির লাঠি লম্বা, এক বলদে টানাওয়ালাদের লাঠি খাটো বা ছোট এবং তা ঘরের মধ্যে বসানো যায়। দুই বলদওয়ালা কলুরা ঘানি স্থাপন করে ঘরের বাইরে। এরা গরুর চোখে ঠুলি বাঁধে না। এক বলদওয়ালা কলুরা গরুর চোখে ঠুলি বাঁধে। দুই বলদে টানা ঘানি মাটির কাছাকাছি থাকে, এক বলদওয়ালার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়, কেননা তাতে গাড়ু বা তেলপাত্র ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তৃতীয় ধরনের ঘানিটি টানা হয় বলদ দিয়ে। এর নামও ঘানা। এর উপরের অংশে কাঠের তৈরি জামবাটির মতো একটা বড় অংশ থাকে, তার নাম হলো পিঁড়ি। পেষণ দন্ডের নাম জাঠ। এর উপরের অংশে একটা বাঁকা কাঠখন্ড আটকানো থাকে, তার নাম মাকড়ি। এ মাকড়ির পিছনে ছিদ্র থাকে, তার ভিতর দিয়ে দড়ি গলিয়ে মত্থম (মতথম) খুটার সঙ্গে আটকানো থাকে। এ মতথম খুঁটা পাটার উপর খাড়াভাবে রাখা হয়। পাটার যে প্রান্ত ঘানার গায়ে ঘষে যায় সেখানে গোলোই নামে একটি কাঠের টুকরা জোড়া লাগানো থাকে। ঘানার যে স্থান দিয়ে তেল বের হয় তার নাম পাতনালি। এর নিচের পাত্রে তেল জমে। ঘানির মধ্যে বীজ নেড়েচেড়ে দেওয়ার জন্য সাঁকনি নামক একটি ঘূর্ণন কাঠি থাকে। গরু জুতবার জন্য থাকে জোয়াল। গরুর চোখে চামড়ার ঠুলি থাকে। জোয়াল পাটার সঙ্গে আড়াআড়িভাবে একটা বাঁকা কাঠি দ্বারা যুক্ত, তার নাম কাইনুড়ি। এসব ঘানির কাঠ শক্ত ও মজবুত হতে হয় এবং এ উদ্দেশ্যে সাধারণত শালকাঠ ব্যবহূত হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশের নানা জায়গায়, বর্তমানে বাংলাদেশেও এক বলদ ও দু বলদে টানা ঘানির কথা জানা যায়। তবে দক্ষিণ বঙ্গে সাধারণত এক বলদে টানা ঘানি দেখা যায়। দু বলদের ছিদ্রহীন ঘানি উড়িষ্যা ও অন্ধ্র প্রদেশে চালু আছে। পশ্চিমবঙ্গ এলাকার মেদিনীপুর এবং হুগলিতেও এর প্রচলন আছে। গুজরাটের ঘানিও এ প্রকারের।
বাংলাদেশে যেসব ঘানি এখনও রয়েছে তা গরুতে অথবা ঘোড়ায় টানে। এসব ঘানিগাছ শক্ত কাঠ দ্বারা তৈরি হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অর্থাৎ যে স্থানে যে ধরনের শক্তকাঠ পাওয়া যায় তা দিয়ে ঘানিগাছ তৈরি করা হয়। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে যেসব ঘানিগাছ আছে তা সাধারণত তেঁতুল, চটকা, কড়ুই গাছের কাঠ দ্বারা নির্মিত। এ কাঠ শক্ত এবং মাটিতে সহসা নষ্ট হয় না। ঘানিগাছের অভ্যন্তরে দেশিয় বাবলা কাঠও ব্যবহূত হয়। দেশি ঘানিগাছ প্রায় ৬ হাত বা তার বেশি লম্বা হয়। এর প্রায় অর্ধাংশ মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয় যাতে নড়াচড়া না করে। দেশি ঘানিগাছের উপরের অংশকে ডোঙ্গা বলে। এখানে তেল তৈরির জন্য সরিষা ঢালা হয়। গাছের উপরের বেড় দেওয়া কাঠকে বলে ওড়া। প্রায় এক হাত বাঁকানো জাট ওড়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে। ঘানিতে ব্যবহূত অন্যান্য দ্রব্যাদির নাম হচ্ছে জাট, মাকড়ি, ওড়া, নলি, এলেবাড়ি, লোহার বাটুল, কাতাড়ি (তক্তা) ইত্যাদি। ঘানিগাছের মাঝামাঝি একটি কাতাড়ি থাকে যার উপর বসা যায়। চালক এর উপর বসে অথবা ওজন বাড়ানোর জন্য তার উপর পাথর বা ভারি দ্রব্য চাপা দিয়ে রাখে। ঘানিগাছের নিচের অংশে নলি দিয়ে তেল বের হয়, এর নিচে থাকে তৈলপাত্র, এ পাত্রেই তেল জমা হয়। প্রথমে অতি সামান্য পানি মিশিয়ে সরিষাকে ঘানিগাছের মাথার খোলে ঢেলে দেওয়া হয়। গরু বা ঘোড়া চলতে থাকলে জাট ঘুরতে থাকে এবং চাপের ফলে সরিষা বা অন্যান্য তৈলদ্রব্য গুঁড়া হয়ে যায় এবং পরিশেষে তেল বের হয়।
কলুদের প্রধানকে বলে পরামানিক। ব্যাপারী ও চৌধুরী হলো ওদের পদবি। ময়মনসিংহে এবং দেশের অন্যান্য স্থানে এক শ্রেণির কলু আছে যারা গরুর বদলে নিজেরাই ঘানি টানে। কলুরা সবরকম তেল প্রস্ত্তত করে ও খইল বিক্রয় করে। তিলের খইল সার হিসেবে ব্যবহূত হয়।
বাংলাদেশের কলুদের অধিকাংশই মুসলমান। হিন্দু কলু থাকলেও তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। অন্যান্য মুসলমানদের অর্থাৎ যারা কলু নয় তাদের সঙ্গে একত্রে কলুরা ধর্মকর্ম পালন করে। তারা একই মসজিদে নামাজ পড়ে। কোনো মুসলিম কলুর মৃত্যু হলে বা কলুদের কোনো অনুষ্ঠানে অন্য মুসলমানরাও অংশ নিতে পারে। হিন্দু কলুরা অ-কলু হিন্দুদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। তারা নিম্নশ্রেণী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
কলুদের সমাজজীবন বহুলাংশেই বিচ্ছিন্ন। যে গ্রামে তারা বসবাস করে সেখানে তারা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। দেখা যায়, ৫/৭ ঘর কলু পরিবার এক জায়গায় পাশাপাশি বা কাছাকাছি বাস করে। তাদের আত্মীয়তা কলু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত। সাধারণ মুসলমানরা কলুদের ‘নিম্নশ্রেণি’ বা ‘ছোট জাতের’ লোক বলে মনে করে। আগে বাংলার সকল অধিবাসীদের মতোই কলুরাও হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল আর তাদের মধ্যে বর্ণ বা জাতপাতের ব্যাপারও বিদ্যমান ছিল। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরেও সে স্মৃতি মুছে যায় নি। কালক্রমে তা আরও স্থায়ী হয়েছে। পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম ও সমাজের উঁচুনিচু বৈষম্য বদলাতে পারে নি। কোথাও কোথাও সাধারণ মুসলমানরা কলুদের সঙ্গে তেমন সামাজিক কাজকর্ম করে না। কলুদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয় নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেই। সাধারণত, কলুরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এ গ্রামে ও গ্রামে বসবাস করে।
কলুদের পেশা এখন হুমকির সম্মুখীন। যেসব এলাকায় যান্ত্রিক ঘানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে তারা তাদের পেশা টিকিয়ে রাখতে পারে নি। সাধারণত একদিনে অর্থাৎ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটি পশুচালিত কাঠের ঘানিতে বড়জোর ২০ কেজির মতো সরিষা পেষা যায়। আর একটি যান্ত্রিক ঘানিতে ওই সময়ের মধ্যে ১০০ কেজির অধিক সরিষা পেশা সম্ভব। কাঠের ঘানিতে গরুকে বিশ্রাম দিতে হয়। সাধারণত গরিব কলুদের একটি মাত্র গরু থাকে। ধনীদের পক্ষে দুটি গরু রাখা সম্ভব। পুঁজি থাকলে সরিষা মজুত রাখা এবং সারাবছর তেল পেষার কাজও থাকে। গরিবের পক্ষে সারাবছর কাজ করা সম্ভব হয় না, তদুপরি তাদের কাঠের ঘানিতে সময়ও বেশি লাগে। যান্ত্রিক ঘানিতে তেলের পরিমাণ বেশি হয়। কারণ প্রায় সব তেলই সরষে থেকে বের করে নেওয়া সম্ভব। কাঠের ঘানিতে তা সম্ভব নয়। সরিষার তেলের ব্যবসায়ীরা যান্ত্রিক ঘানিতে ভিড় জমায়, এর প্রধান কারণ সময় ও পরিমাণগত সুবিধা। কাঠের ঘানিতে বিশ শতকের ষাটের দশকে ১০ সের সরিষা ভাঙ্গিয়ে কলুদের আয় হতো এক টাকা থেকে দুটাকা পঁচাত্তর পয়সা। এখন কলুদের সারাদিনে আয় হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকা। তাছাড়া সরিষা, সয়াবিন, ভেন্না ও অন্যান্য দ্রব্যের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই পেশা হিসেবে কলুরা তাদের পৈতৃক পেশা টিকিয়ে রাখতে পারছে না। ইতোমধ্যেই সারাদেশ থেকে হাজার হাজার কাঠের ঘানিগাছ উঠে গেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই বা যান্ত্রিক ঘানি নেই এমন সব এলাকায় কলুদের পেশা এখনও কোনোক্রমে টিকে আছে। কমদামি সয়াবিন ও পাম তেলের সঙ্গে সরিষার তেল প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। তেলজাতীয় খাদ্যের অভ্যাসও দিন দিন বদলে যাচ্ছে। দেশে বিদ্যুৎ ও যান্ত্রিক ঘানির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে কলুদের পেশা ক্রমশ অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। [আমজাদ হোসেন]