ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস
ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদর দপ্তর এবং কোম্পানির ভারত সাম্রাজ্যের ‘হোম গভর্নমেন্ট’। কোম্পানি ভারত সাম্রাজ্যের শাসন কাজ এখান থেকেই পরিচালনা করত। ১৭৮৪ সালে কোম্পানির রাজ্য যখন ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে তখন এটি ছিল পাথরের একটা চারতলা বেমানান বাড়ি। লন্ডন শহরের ব্যস্ত এলাকা ল্যাডেনহল স্ট্রিটের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এ ভবনের সামনের দিক ছিল সংকীর্ণ, মাত্র ৭০ ফুট আর পেছনের দিক ছিল ৩০০ ফুটেরও বেশি প্রসারিত। এতে একটি বেশ বড়সড় হলঘর, একটি বাগান ও উন্মুক্ত উঠোন, কোম্পানির পরিচালকবৃন্দের (ডাইরেক্টরদের) জন্য কয়েকটি কক্ষ, কর্মচারীদের জন্য কয়েকটি অফিসঘর এবং পেছনে বেশ কয়েকটি বৃহদাকার গুদামঘর ছিল। সাম্রাজ্যের প্রসারমান কর্মপরিধির প্রয়োজনে ১৭৯৯ সালে ভবনটি সম্প্রসারিত করা হয়। ১৮৫৮ সালের পর ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস শুধুমাত্র ইন্ডিয়া হাউস নামে অভিহিত হয়। ভারত সচিব নামে আখ্যায়িত মন্ত্রিসভার একজন সদস্য হন এর প্রধান। এরপর ‘হোম গভর্নমেন্ট’ স্থানান্তরিত হয় ওয়েস্ট মিনিস্টারের একটি নতুন কার্যালয়ে।
ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসের নিচতলায় প্রোপ্রাইটরদের জন্য একটি বড় ও বেশ উঁচু ‘জেনারেল কোর্ট রুম’, পরিচালকবৃন্দের জন্য একটি ‘কোর্ট রুম’, বিক্রয়কক্ষ এবং বিভিন্ন ‘কমিটি রুম’ ছিল। ভারতের সঙ্গে চিঠিপত্র আদান-প্রদান নিরীক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ অফিসসহ বেশিরভাগ অফিস ছিল উপরের তলাগুলিতে। কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ডেপুটি চেয়ারম্যানের অফিসের জন্য ভবনটির একেবারে ডানপাশে অতিরিক্ত একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। জেনারেল কোর্টরুমে প্রোপ্রাইটরদের সভা সাধারণত তিন মাসে একবার অনুষ্ঠিত হতো। ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স এর সিদ্ধান্ত বাতিল করার ক্ষমতা কোর্ট অব প্রোপ্রাইটরদের ছিল। পিট-এর ভারত শাসন আইনের (১৭৮৪) অধীনে ডাইরেক্টর সভার কাজকর্ম পর্যবেক্ষণের জন্য পার্লামেন্ট সদস্যদের নিয়ে একটা বোর্ড অব কন্ট্রোল গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে একটি শক্তিশালী বোর্ড অব কন্ট্রোল দ্বারা ডাইরেক্টর সভা নিয়ন্ত্রিত হতো। প্রতিবছর ২৪ জন ডাইরেক্টর নির্বাচন করা ছিল প্রোপ্রাইটরদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ডাইরেক্টরগণ ইংল্যান্ডে কোম্পানির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ডাইরেক্টর সভায় একটি সদস্যপদ লাভ এত লোভনীয় ছিল যে, নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রোপ্রাইটরদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হতো। প্রোপ্রাইটরগণ বেশ কয়েক বছর আগেই প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন বলে রটনা আছে। এতদুদ্দেশ্যে নির্বাচনে ব্যয় করার জন্য তাঁরা প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে রাখতেন।
অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয় দেখাশোনার জন্য ডাইরেক্টরগণ তিন অথবা চার সদস্য বিশিষ্ট একটি সেক্রেট কমিটি গঠন করতেন। ডাইরেক্টর সভা এবং করেসপন্ডেন্স কমিটির উপর, যার মাধ্যমে কলকাতা সরকারের নিকট যাবতীয় নির্দেশ পাঠানো হতো, চেয়ারম্যানের প্রভূত ক্ষমতা ছিল। পৃষ্ঠপোষকতা ছিল ডাইরেক্টর সভার বিশেষ অধিকার। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে এবং প্রাচ্যের অন্যত্র তারা নিজেদের লোকদের চাকুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিশেষ অধিকার প্রয়োগ করতেন। ভারতে প্রেরিতব্য সকল নির্দেশ চিঠিপত্র নিরীক্ষকের দপ্তরে প্রস্ত্তত করা হতো। ভারত থেকে আসা চিঠিপত্রের জবাব দেওয়ার সময় চিঠিতে কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে সে ব্যাপারে নিরীক্ষক এবং তার প্রধান সহকারীগণ প্রচুর প্রভাব খাটাতেন। যদিও সভা শুরু হওয়ার আগে সকল সদস্যকেই চিঠির খসড়া সরবরাহ করা হতো, তবুও নিরীক্ষকের মূল বক্তব্যের বিপরীত সিদ্ধান্ত কদাচিৎ গৃহীত হতো। সব মিলিয়ে একে বিস্ময়কর ব্যাপার বলেই মনে হয় যে, লন্ডনের ল্যাডেনহল স্ট্রিটের একটা চারতলা ভবন থেকে যেন অনেকটা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে শাসিত হতো ভারতবর্ষের মতো একটি বিশাল সাম্রাজ্য। [সিরাজুল ইসলাম]