অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ
অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ (Oxbow Lake) এক ধরনের অর্ধচন্দ্রাকৃতি হ্রদ; যখন কোনো নদী তার সুগঠিত দুটি বাঁকের মধ্যবর্তী অংশ ছেদ করে সরলপথে প্রবাহিত হয় তখন এ ধরনের হ্রদ সৃষ্টি হয়। সাধারণত নদীর প্রবাহ পথে প্লাবনভূমি অঞ্চলে এ ধরনের হ্রদ দেখা যায়। বন্যার সময় বাঁকের ভাঁজগুলি বেশি পরিমাণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং একসময় স্বাভাবিকভাবেই নদীটি একটি সংক্ষিপ্ত সরলপথ সৃষ্টি করে নেয়। বাঁকা পরিত্যক্ত পথটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ হিসেবে গড়ে ওঠে।
প্রাথমিকভাবে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ ও জলপ্রবাহের সংযোগমুখ পলি জমে বন্ধ হয়ে যায় এবং পরে ধীরে ধীরে ভরাট হতে হতে নদী থেকে হ্রদটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।বাংলাদেশের পুরাতন প্লাবনভূমি এলাকায় অনেক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখতে পাওয়া যায়। অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ সাধারণত নদীর প্লাবনভূমিরই অংশ। তবে মূল নদী থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে এ ধরনের হ্রদে মাছের চাষ করা যায়। বন্যার পানি বিধৌত সার, প্রাণীবর্জ্য ও অন্যান্য জৈবিক পদার্থ এই সমস্ত হ্রদে প্রবাহিত হয়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে। এ ভূমিরূপটি আঞ্চলিকভাবে কোথাও কোথাও বিল, বাঁওড় বা ঝিল নামেও পরিচিত। জলপ্রবাহের এ পরিত্যক্ত বাহুগুলি প্রচুর জলজ উদ্ভিদের উপস্থিতির কারণে জৈব উপাদান এবং সে সঙ্গে কাদা বা মিহি পলিকাদা জাতীয় অবক্ষেপ ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ থাকে। এ ধরনের হ্রদগুলি সাধারণত বর্ষা মৌসুমে বন্যা কবলিত হয়। এ বন্যা কখনও স্থানীয় বৃষ্টিপাত ও পৃষ্ঠ জলনিকাশের (Runoff) কারণে, আবার কখনও নদীতে বন্যার কারণেও সংঘটিত হতে পারে। বন্যার পানি নেমে গেলে এ হ্রদগুলির প্রান্তভাগের জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়ে থাকে। যখন গোটা হ্রদ পলি দিয়ে ভরাট হয়ে যায় তখন সম্পূর্ণ হ্রদই ধান চাষের আওতায় চলে আসে।
অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদগুলি বিভিন্ন প্রকারের জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল। কিছু কিছু অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ মিঠা পানির মৎস্যক্ষেত্র হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে যেগুলিকে স্থানীয় ভাষায় জলমহাল বলা হয়। বর্ষার সময় এ হ্রদগুলি স্থানীয় জলাধার হিসেবে কাজ করে এবং স্থানীয় বন্যার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হ্রদগুলি শুষ্কমৌসুমে সেচের উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রতিককালে যশোর অঞ্চলে এধরনের হ্রদকে আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহের আধার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে দু’টি হ্রদ (বাঁওড়) থেকে পানি শোধন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ধরনের অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বা বাওড়ের আশেপাশে সাধারণত অনেক গ্রামবাসী বসবাস করে থাকে এবং নিজেদের বিভিন্ন প্রয়োজনে তারা এ হ্রদের পানি ব্যবহার করে। [মোহা. শামসুল আলম]