অলঙ্কারশাস্ত্র
অলঙ্কারশাস্ত্র বাংলা অলঙ্কারশাস্ত্র মূলত সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রেরই অনুবর্তন। সংস্কৃতে একে সাহিত্যশাস্ত্র বা সাহিত্যতত্ত্ব নামেও অভিহিত করা হয়। ভারতবর্ষে সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের চর্চা হয়েছে বহুকাল আগে থেকেই। ঋগ্বেদে (খ্রিপূ ২৫০০-৯৫০) উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অলঙ্কারের প্রয়োগ পাওয়া যায়, কিন্তু তখন পদ্ধতিগতভাবে অলঙ্কারশাস্ত্রের চর্চা হতো কি-না তা জানা যায় না; এমনকি আলঙ্কারিক অর্থে উপমাদি শব্দের প্রয়োগও দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে ঋগ্বেদে ব্যাকরণ আলোচনার সূত্রে ‘উপমান’ বা ‘দৃষ্টান্ত’ অর্থে ‘উপমা’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। বেদোত্তর যুগে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলি, ভর্তৃহরি প্রমুখ মূলত ব্যাকরণের নানা বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্যই ‘উপমা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সুতরাং সে যুগে অলঙ্কারশাস্ত্র ছন্দশাস্ত্রের মতো পৃথক শাস্ত্র হিসেবে গড়ে ওঠে নি।
ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রের এ যাবৎ প্রাপ্ত প্রাচীনতম গ্রন্থ হচ্ছে ভরতের নাট্যশাস্ত্র। গ্রন্থটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। ভরত ছিলেন মুখ্যত নাট্যশাস্ত্রকার, তাই তাঁর আলোচনার মূল বিষয় ছিল নাটক ও তার আনুষঙ্গিক বিষয়। তবে প্রসঙ্গক্রমে তিনি বাক্য, বাক্যবিন্যাস, বাক্যের দোষ, গুণ, অলঙ্কার, লক্ষণ ইত্যাদি এবং শৃঙ্গারাদি আট প্রকার রসের আলোচনাও করেছেন।
ভরতের পরবর্তী দুজন শ্রেষ্ঠ আলঙ্কারিক হচ্ছেন কাব্যাদর্শ প্রণেতা দন্ডী (৬ষ্ঠ শতক) এবং কাব্যালঙ্কার প্রণেতা ভামহ (৭ম-৮ম শতক)। দন্ডী তাঁর গ্রন্থে কাব্যের গুণ, ধর্ম ও প্রকারভেদের পাশাপাশি ছত্রিশটি অর্থালঙ্কারও উদাহরণসহ আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে অলঙ্কারই হচ্ছে কাব্যের সৌন্দর্য-বিধায়ক ধর্ম। অন্যদিকে ভামহের মতে শব্দ ও অর্থের সমন্বয়ই কাব্য। ভামহের পরে আচার্য বামন (৮০০-এর কাছাকাছি) সূত্রাকারে অলঙ্কারশাস্ত্র রচনা করেন এবং তিনি নিজেই এর বৃত্তি (ব্যাখ্যা) রচনা করেন। এজন্য তাঁর গ্রন্থের নাম হয় কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তি। বামনের বিচারে ‘উপমাই’ প্রধান অলঙ্কার এবং তিনি তাঁর গ্রন্থে উপমার আলোচনা প্রসঙ্গেই অন্যান্য অলঙ্কারের আলোচনা করেছেন। তিনিই প্রথম কাব্যের আত্মার কথা বলেন।
অলঙ্কারশাস্ত্রের ইতিহাসে এরপর আচার্য উদ্ভটের (৮০০-এর কাছাকাছি) নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর গ্রন্থের নাম কাব্যালঙ্কারসারসংগ্রহ। তবে পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ আলঙ্কারিক হিসেবে ধ্বন্যালোক রচয়িতা আনন্দবর্ধনের (৯ম শতক) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অভিনবগুপ্ত (১০ম-১১শ) ‘লোচন’ নামে এর ব্যাখ্যা রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি অভিনবভারতী নামে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের একটি বিখ্যাত ভাষ্যও রচনা করেন। আনন্দবর্ধনের পর আলঙ্কারিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন রুদ্রট (৯ম-১০ম)। তাঁর কাব্যালঙ্কার অলঙ্কারশাস্ত্রের ইতিহাসে এক অসাধারণ গ্রন্থ।
নবম শতকের শেষদিকে অলঙ্কার একটি বিশিষ্ট শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং সে সময়ের বিখ্যাত আলঙ্কারিক হচ্ছেন রাজশেখর। তিনি তাঁর কাব্যমীমাংসা গ্রন্থে অলঙ্কারশাস্ত্রকে বলেছেন ‘সপ্তম বেদাঙ্গ’; কারণ তিনি দেখিয়েছেন, অলঙ্কার বেদের অর্থনির্ণয়ে সহায়ক। দশ-এগারো শতকের আর একজন বিখ্যাত আলঙ্কারিক হচ্ছেন কুন্তক। তাঁর বক্রোক্তিতত্ত্ব অলঙ্কারের ইতিহাসে এক বিশেষ অবদান। তাঁর গ্রন্থের নাম বক্রোক্তিজীবিত।
এগারো শতকের শেষভাগ থেকে বারো শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত কাব্যতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে স্মরণীয় হচ্ছেন ক্ষেমেন্দ্র, ভোজরাজ, মম্মটভট্ট এবং রুদ্রট। ক্ষেমেন্দ্রের ঔচিত্যবিচারচর্চা, ভোজরাজের সরস্বতীকণ্ঠাভরণ, মম্মটের ক্যাব্যপ্রকাশ এবং রুদ্রটের শৃঙ্গারতিলক এ সময়ের কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ। তেরো শতকের আলঙ্কারিকদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন বাগ্ভট্ট (বাগ্ভট্টালঙ্কার), জয়দেব, বিদ্যাধর ও বিদ্যানাথ। চৌদ্দ শতকের আলঙ্কারিকরা হচ্ছেন সিংহভূপাল, ভানুদত্ত ও বিশ্বনাথ কবিরাজ। বিশ্বনাথ কবিরাজের সাহিত্যদর্পণ অলঙ্কারশাস্ত্রের ইতিহাসে একখানা অতুলনীয় গ্রন্থ। এতে বহু শ্রেণিভেদসহ ছয়টি শব্দালঙ্কার ও প্রায় সত্তরটি অর্থালঙ্কারের আলোচনা রয়েছে। ষোল শতকের আলঙ্কারিকদের মধ্যে কবিকর্ণপূর ও অপ্পয়দীক্ষিতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সতেরো শতকে পন্ডিতরাজ জগন্নাথ (রসগঙ্গাধর) দন্ডী ও বামনের রীতিপ্রস্থানকে অলঙ্কারশাস্ত্রের বিবেচনায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে সাহিত্যালোচনার ধারাকে বদলে দিয়েছেন।
আচার্য বামন কথিত ‘কাব্যের আত্মা’ মতবাদ পরবর্তীকালে অলঙ্কারশাস্ত্রের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কাব্যের স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে তার আত্মা কি এ নিয়ে আলঙ্কারিকদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হয় এবং এর ওপর ভিত্তি করে অলঙ্কারশাস্ত্রের ছয়টি প্রস্থান বা সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। সেগুলি হচ্ছে: রসপ্রস্থান, অলঙ্কারপ্রস্থান, গুণপ্রস্থান, রীতিপ্রস্থান, ধ্বনিপ্রস্থান এবং বক্রোক্তিজীবিতপ্রস্থান। রসপ্রস্থানের প্রাচীনতম প্রবক্তা আচার্য ভরত। তাঁর মতে রসই কাব্যের আত্মা বা মূল, রস ছাড়া কাব্য হতে পারে না। তিনি তাঁর গ্রন্থে গুণ, অলঙ্কার ও বৃত্তির বিচার করে বলেছেন এগুলি কাব্যের বাহ্য বিষয়, আন্তর বিষয় হচ্ছে রস। ভরত শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুত এ আট প্রকার রসের কথা বলেছেন। বাক্যবিন্যাসের মাধ্যমে যখন এর যে-কোন একটি রসের উদ্ভব ঘটে তখনই তাকে কাব্য বলে। বিশ্বনাথ কবিরাজ প্রধানত এ মতের সমর্থক।
অলঙ্কারপ্রস্থানের প্রধান প্রবক্তারা হচ্ছেন ভামহ, উদ্ভট ও রুদ্রট। এঁদের মতে অলঙ্কারই কাব্যের মূল, অলঙ্কার না থাকলে কাব্যের সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয় না, অলঙ্কারের যথাযথ ব্যবহারেই বাক্য কাব্যময় হয়ে ওঠে। ‘অলঙ্কার’ শব্দের মূলে রয়েছে সংস্কৃত ‘অলম্’ শব্দ, যার একটি অর্থ ‘ভূষণ’। অলঙ্কার শব্দের এ ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ধরে অলঙ্কারবাদীরা বলেন, যার দ্বারা ভূষিত করা হয় তাই অলঙ্কার। নারীদেহের সৌন্দর্য-বিধায়ক কটক-কুন্ডলাদির সঙ্গে কাব্যের অলঙ্কারকে তুলনা করে তাঁরা বলেন: অনুপ্রাস, উপমা, রূপক প্রভৃতি অলঙ্কারই কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। আচার্য দন্ডীও এ মতের সমর্থক। তাঁর মতে, কাব্যের যে-সমস্ত ধর্ম তার শোভা সম্পাদন করে, তাই অলঙ্কার। এ শোভা সম্পাদনের বিষয়টি বাইরে থেকে আরোপিত নয়, তা কাব্যের অঙ্গীভূত সৌন্দর্য। এজন্য বামন বলেছেন: সৌন্দর্যম্ অলঙ্কারঃ সৌন্দর্যই অলঙ্কার। তিনি আরও বলেছেন: কাব্যং গ্রাহ্যম্ অলঙ্কারাৎ কাব্য অলঙ্কারের কারণেই গ্রাহ্য হয়, অর্থাৎ অলঙ্কার আছে বলেই তা পাঠকের কাছে আস্বাদনযোগ্য হয়ে ওঠে। বাক্যের শব্দ ও অর্থকে আভরণহীন না রেখে তাকে অলঙ্কারে ভূষিত করলেই তা কাব্যে রূপান্তরিত হয়। এজন্য এখনও পর্যন্ত অনেকে কাব্য বলতে শব্দ ও বাক্যের অলঙ্কৃত প্রকাশকেই বুঝে থাকেন।
গুণপ্রস্থানের প্রধান প্রবক্তা আচার্য দন্ডী। তিনি অলঙ্কারকে বলেছেন কাব্যের শোভাবর্ধক, কিন্তু গুণকে বলেছেন কাব্যের আত্মা। দন্ডী তাঁর গ্রন্থে শ্লেষ, প্রসাদ, সমতা, মাধুর্য, অর্থব্যক্তি, ওজঃ ইত্যাদি দশটি গুণের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, এক বা একাধিক গুণের সমাবেশেই কাব্যত্বের সৃষ্টি হয়।
রীতিপ্রস্থানের প্রবক্তা আচার্য বামন বলেছেন: রীতিরাত্মা কাব্যস্য, অর্থাৎ রীতিই হচ্ছে কাব্যের আত্মা। রীতি বলতে তিনি পদরচনার পদ্ধতিকে বুঝিয়েছেন। প্রধান পদরীতি হচ্ছে তিনটি গৌড়ী, বৈদর্ভী ও পাঞ্চালী। বামনের মতে, পদরচনার চমৎকারিত্বের ফলেই কাব্যত্বের সৃষ্টি হয়।
ধ্বনিপ্রস্থানের প্রবক্তা হচ্ছেন আনন্দবর্ধন। তাঁর মতে ধ্বনি হচ্ছে কাব্যের আত্মা। ধ্বনিবাদীরা অবশ্য অলঙ্কারকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেন না; তবে তাঁরা অলঙ্কারবাদীদের মতো অলঙ্কারকে কাব্যের বহিরাঙ্গিক বিষয় মনে না করে বরং কাব্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করেন। তাঁরা বলেন, অলঙ্কার কাব্যের আস্বাদন-যোগ্যতা বাড়ায় সত্য, কিন্তু তা কাব্যের আত্মা নয়। মূলত রস ও রূপ এ দু সত্তা নিয়েই কাব্য হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ এবং এ দুটির মধ্যে রয়েছে আজন্ম অচ্ছেদ্য (Organic) সম্পর্ক। যথোচিত অলঙ্কার যেমন নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, তেমনি যথোচিত অলঙ্কার কাব্যেরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তবে ধ্বনিবাদীদের মতে কেবল অলঙ্কারের ওপরই কাব্যত্ব নির্ভর করে না; অলঙ্কৃত বাক্য যেমন কাব্য হয়, তেমনি অনলঙ্কৃত বাক্যও সার্থক কাব্য হতে পারে। আবার, অলঙ্কার অযথার্থভাবে ব্যবহূত হলেও তা কাব্য হয় না। সুতরাং কাব্যের কাব্যত্ব অলঙ্কার থাকা না-থাকার ওপর নির্ভর করে না; কাব্যত্ব নির্ভরশীল অন্য কিছুর ওপর, অলঙ্কারের অতিরিক্ত কিছুর ওপর। নারীর লাবণ্য যেমন তার অঙ্গসংস্থান বা অলঙ্কারের অতিরিক্ত অন্য কোনো বিষয়, তেমনি কাব্যের কাব্যত্ব শব্দ, অর্থ, অলঙ্কার বা রচনারীতির অতিরিক্ত অন্য কোনো বিষয়। আর সে অতিরিক্ত বিষয়ই হচ্ছে ধ্বনি, অর্থাৎ ‘ধ্বনি’ হচ্ছে ব্যঞ্জনা বা প্রতীয়মান অর্থ। যা বাক্যের বাচ্যার্থের চেয়ে ব্যঙ্গ্যার্থকে প্রধান করে তোলে তা-ই ধ্বনি। এ ধ্বনি তিন প্রকার বস্ত্তধ্বনি, অলঙ্কারধ্বনি ও রসধ্বনি। এগুলির মধ্যে রসধ্বনি প্রধান, কারণ অন্য দু ধ্বনিরও রসেই পর্যবসান হয়। অভিনবগুপ্ত ধ্বনিবাদেরই একজন সমর্থক ছিলেন।
বক্রোক্তিপ্রস্থানের প্রবক্তা হচ্ছেন আচার্য কুন্তক। তিনি বক্রোক্তিকে কাব্যের আত্মা বলেছেন। বক্রোক্তি হচ্ছে বক্তার কথা সঠিক অর্থে গ্রহণ না করে ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করা এবং সে অনুযায়ী উত্তর দেওয়া। কুন্তকের মতে, শব্দার্থের এ বক্রতার ফলেই কাব্যত্বের সৃষ্টি হয় এবং তা পাঠককে আনন্দ দেয়।
সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের উপর্যুক্ত ধারায় বাংলা ভাষায় কাব্যবিচার শুরু হয়। তবে এর ইতিহাস খুব পুরনো নয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হচ্ছে যথাক্রমে চর্যাপদ (১০ম শতক) ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (১৪শ শতক)। কিন্তু ওই সময়ে কাব্যতত্ত্ববিষয়ক কোনো গ্রন্থের সন্ধান বাংলা ভাষায় পাওয়া যায় না, যদিও দুটি কাব্যেই শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারের প্রচুর প্রয়োগ রয়েছে। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য কিংবা মধ্যযুগের অন্যান্য ধারার খ্যাতিমান বাঙালি কবিদের রচনায় কাব্যসম্পর্কিত ভাবনার কিঞ্চিদধিক পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁরা যে অলঙ্কারশাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলেন তা তাঁদের রচনায় শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারের ব্যবহার দেখে সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু তাঁরা সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের রীতি ও বৈচিত্র্যের বাইরে স্বতন্ত্র কোনো আলঙ্কারিক ধারা প্রতিষ্ঠিত করেন নি; হয়তো তার প্রয়োজনও অনুভব করেন নি। কারণ সংস্কৃতের সঙ্গে তাঁদের ছিল প্রাত্যহিক সম্পর্ক এবং বিদ্যাশিক্ষার একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল সংস্কৃতের বাধ্যতামূলক চর্চা। ফলে সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রকেই তাঁরা বাংলা ভাষায় কাব্য রচনার সময় প্রয়োগ করেছেন।
তবে স্বাধীনভাবেও তাঁরা কাব্যচিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁদের রচনার মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, আলাওল ও ভারতচন্দ্ররায় গুণাকরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বৈষ্ণবকবিরা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের অনুসারী হলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁরা কোথাও কোথাও স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। উনিশ শতকের প্রথমদিকে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও লালমোহন বিদ্যানিধি কাব্যবিচারে সম্পূর্ণরূপে সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক প্রাচ্য অলঙ্কারশাস্ত্রের আধিপত্যকে ক্রমশ ক্ষুণ্ণ করতে থাকে। বর্তমানে পাশ্চাত্য সাহিত্যাদর্শই বাঙালি সাহিত্যিকদের কাছে সমধিক জনপ্রিয় ও অনুসরণীয়। সুতরাং আধুনিককালের কাব্যাদর্শ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের সংশ্লেষ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি নতুন পথের দিকে ধাবিত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, দীনেশচন্দ্র সেন, প্রমথ চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ আধুনিক বাঙালি সাহিত্যিক সাহিত্যচর্চার যে আদর্শ অনুসরণ করেছেন তা ছিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ধারার সংমিশ্রণ। বর্তমান বাংলা সাহিত্যের আদর্শও পূর্ব-পশ্চিমের সাহিত্যতত্ত্বের সংশ্লেষের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এক নতুন ধারা।
কোন বাক্য পাঠ করার সময় তার দুটি দিক পাঠককে আকৃষ্ট করে: ধ্বনি (Sound) ও অর্থ (Sense)। তাই শব্দের ধ্বনিরূপ ও অর্থরূপের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে প্রধানত দু ধরনের অলঙ্কার সৃষ্টি হয়। ধ্বনিরূপকে অবলম্বন করে যে অলঙ্কার সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় শব্দালঙ্কার, আর তার অর্থকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অলঙ্কারকে বলা হয় অর্থালঙ্কার।
শব্দালঙ্কার এক্ষেত্রে শব্দ বা ধ্বনি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। শব্দের ধ্বনিরূপের বিপর্যয় ঘটলে শব্দালঙ্কারের কোনো তাৎপর্য থাকে না। যেমন জীবনানন্দ দাশের ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ এ পঙক্তিতে ‘র’ ধ্বনির বারবার উচ্চারণের ফলে এক ধরনের ধ্বনিসাম্য সৃষ্টি হয়েছে, যে কারণে কবিতাটি বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। একই ধ্বনির এরূপ পুনরাবৃত্তির মাধ্যমেই শব্দালঙ্কারের সৃষ্টি হয়। শব্দালঙ্কারের নানা শ্রেণিবিভাগ রয়েছে; তার মধ্যে প্রধান বিভাগগুলি হচ্ছে: অনুপ্রাস, যমক, বক্রোক্তি, শ্লেষ ও পুনরুক্তবদাভাস।
অর্থালঙ্কার শব্দের অর্থরূপের সাহায্যে যে-সকল অলঙ্কার সৃষ্টি হয় তাকে বলে অর্থালঙ্কার। অর্থালঙ্কারে শব্দধ্বনি গৌণ, তার অর্থই প্রধান। এজন্য অর্থ ঠিক রেখে শব্দ বদলে দিলেও অর্থালঙ্কারের কোনো পরিবর্তন হয় না। সাধারণ লক্ষণ অনুযায়ী অর্থালঙ্কারকে পাঁচভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হচ্ছে: সাদৃশ্যমূলক, বিরোধমূলক, শৃঙ্খলামূলক, ন্যায়মূলক ও গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক।
সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার সাধারণত দুটি ভিন্ন ধরনের বিষয় বা বস্ত্তর মধ্যেকার কোনো সাদৃশ্যের ওপর নির্ভর করে সৃষ্টি হয়। যেমন: ‘মেয়েটি দিন দিন লতার মত বেড়ে উঠছে’ এখানে ‘মেয়েটি’ এবং ‘লতা’ দুটি ভিন্নধর্মী পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে গুণগত সাদৃশ্যের কারণে তুলনা করায় সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারের সৃষ্টি হয়েছে। আলঙ্কারিক পরিভাষায় এর নাম উপমা। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, অপহ্নুতি, সন্দেহ, নিশ্চয়, প্রতিবস্তূপমা, দৃষ্টান্ত, নিদর্শনা, ব্যতিরেক, ভ্রান্তিমান, সমাসোক্তি, প্রতীপ প্রভৃতি সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারের অন্তর্ভুক্ত।
বিরোধমূলক অলঙ্কার সৃষ্টি হয় দুটি পদার্থের আপাত বিরোধকে অবলম্বন করে। যেমন: ‘বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে’ এখানে আপাত বিবেচনায় ‘বড় হওয়া’ এবং ‘ছোট হওয়া’ এ দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও প্রকৃত কোনো বিরোধ নেই। তাই এটি বিরোধমূলক অলঙ্কারের উদাহরণ। বিরোধমূলক অলঙ্কারের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হচ্ছে বিরোধাভাস, বিভাবনা, বিশেষোক্তি, অসঙ্গতি ও বিষম অলঙ্কার।
শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার হয় বাক্যগঠনের ক্ষেত্রে বাক্যাংশের শৃঙ্খলাকে অবলম্বন করে। যেমন: ‘পরশে চাহনি তার, দৃষ্টিতে চুম্বন/ আর চুম্বনে মরণ’ এখানে ‘পরশ’রূপ কারণের কাজ ‘চাহনি’, ‘চাহনি’ বা দৃষ্টিরূপ কারণের কাজ চুম্বন আর ‘চুম্বন’রূপ কারণের কাজ মৃত্যু। এ তিন বাক্যাংশের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা রক্ষিত হয়েছে বলে এটি শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কারের দৃষ্টান্ত। শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে কারণমালা, একাবলি ও সার।
ন্যায়মূলক অলঙ্কার গড়ে ওঠে যখন কোনো বক্তব্য ন্যায়সঙ্গত সমর্থনসহ উপস্থাপিত হয়। যেমন: ‘এ জগতে হায় সে বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি।/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি\’ এখানে প্রথম চরণের বিষয়টি দ্বিতীয় চরণ দ্বারা সমর্থিত হওয়ায় ন্যায়মূলক অলঙ্কার হয়েছে। ন্যায়মূলক অলঙ্কারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে অর্থান্তরন্যাস ও কাব্যলিঙ্গ।
গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক অলঙ্কার হয় যখন সাধারণ বক্তব্যের আড়ালে আরেকটি গভীর অর্থ থাকে। যেমন: ‘অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ/ কোনো গুণ নাই তার কপালে আগুন।’ এখানে আপাত দৃষ্টিতে নিন্দা বুঝালেও প্রকৃতপক্ষে শিবের প্রশংসা করা হয়েছে। তাই এখানে গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক অলঙ্কার হয়েছে। গূঢ়ার্থমূলক অলঙ্কারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ব্যাজস্ত্ততি ও অপ্রস্ত্ততপ্রশংসা।
আধুনিককালে অসংখ্য পাশ্চাত্য অলঙ্কার বাংলা কাব্যে ব্যবহূত হতে দেখা যায়। সেগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে মহোপমা (Epic Simile), ধ্বনিবৃত্ত (Onomatopoeia), পরাবৃত্তি (Chiasmus), অনুলোম বা পরাকাষ্ঠা (Climax), নিকর্ষ (Anti-climax or Bathos), সু-ভাষণ (Euphemism), বিচিত্র-ভাষণ (Periphrasis), পরোক্ষ-ভাষণ (Litotes), বক্র-ভাষণ (Innuendo), বক্রাঘাত (Irony), পরিবাদ (Sarcasm), অন্যাসক্ত (Transferred Epithet), আদ্যাবৃত্তি (Epanaphora), অন্তযুক্ত (Asyndeton), অভিযুক্ত (Polysyndeton), অনুকল্প (Metonym), প্রতিরূপক (Synecdoche), উল্লিখন (Allusion), যুগ্ম (Zeugma), সম্বোধন (Apostrophe) প্রভৃতি।
বাংলা ভাষায় রচিত অলঙ্কারশাস্ত্রের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: কাব্যবিচার (সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত), সাহিত্য-মীমাংসা (বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য), অলঙ্কারচন্দ্রিকা (শ্যামাপদ চক্রবর্তী), কাব্যালোক (সুধীরকুমার দাশগুপ্ত), রস-সমীক্ষা (রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়), অলঙ্কার-অন্বেষা (নরেন বিশ্বাস) ইত্যাদি। এ ছাড়া কতিপয় সংস্কৃত অলঙ্কারগ্রন্থের বাংলা অনুবাদও অলঙ্কারশাস্ত্রের পঠনপাঠনে বহুলভাবে ব্যবহূত হয়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: নাট্যশাস্ত্র (সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়), ধ্বন্যালোক ও লোচন (সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও কালীপদ ভট্টাচার্য), কাব্যমীমাংসা (নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী), সাহিত্যদর্পণ (অবন্তীকুমার সান্যাল ও গিরীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) ইত্যাদি। [আমীনুর রহমান]
গ্রন্থপঞ্জি জীবেন্দ্র সিংহ রায়, বাঙলা অলঙ্কার, মডার্ন বুক এজেন্সী, কলকাতা, ১৯৬৪; শ্যামাপদ চক্রবর্তী, অলঙ্কার চন্দ্রিকা (২য় সং), ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং, কলকাতা, ১৯৬৭; অতুলচন্দ্র গুপ্ত, কাব্যজিজ্ঞাসা (৩য় সং), বিশ্বভারতী-গ্রন্থালয়, কলকাতা, ১৯৭৩; নরেন বিশ্বাস, অলঙ্কার-অন্বেষা, পুনশ্চ, কলকাতা, ১৯৯৬; SK De, History of Sanskrit Poetics, Luzac, London, 1925; PV Kane, History of Sanskrit Poetics, Motilal Banarsidass, 1971.