হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, মহামহোপাধ্যায়

হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, মহামহোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৬১)  সংস্কৃত পন্ডিত, লেখক। ১৮৭৬ সালের ২২ অক্টোবর বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ার উনশিয়া গ্রামে এক বিখ্যাত পন্ডিত বংশে তাঁর জন্ম। পিতামহ কাশীচন্দ্র বাচস্পতি এবং পিতা গঙ্গাধর বিদ্যালঙ্কারও ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত। তাঁরা ছিলেন পশ্চিমদেশীয় বৈদিক ব্রাহ্মণ।

হরিদাস প্রথমে পিতা ও পিতামহের নিকট  কলাপব্যাকরণ অধ্যয়ন করেন এবং স্বগ্রামের আর্যশিক্ষা সমিতির ব্যাকরণ পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য ‘শব্দাচার্য’ উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি ফরিদপুরের আনন্দচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং কলকাতার জীবানন্দ বিদ্যাসাগরের নিকট কাব্য, ব্যাকরণ, স্মৃতিশাস্ত্র, পুরাণ, জ্যোতিষ প্রভৃতি বিষয় অধ্যয়ন করেন। এসব বিষয়ের বিভিন্ন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ‘ব্যাকরণতীর্থ’, ‘কাব্যতীর্থ’ ইত্যাদি উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি ঢাকার  পূর্ববঙ্গ সারস্বত সমাজ কর্তৃক ‘সাংখ্যরত্ন’, ‘পুরাণশাস্ত্রী’ ও ‘সিদ্ধান্তবাগীশ’ উপাধিতে ভূষিত হন। শিক্ষাশেষে হরিদাস ত্রিপুরার রাজপন্ডিত হন এবং পরে কোটালিপাড়ার আর্যবিদ্যালয় ও খুলনার নকীপুর টোলে শিক্ষকতা করেন। তিনি নকীপুরে চতুষ্পাঠীর সম্মুখে একটি ছাপাখানাও প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।

হরিদাস সংস্কৃত ভাষায় অনেক মৌলিক গ্রন্থ রচনা এবং পনেরোটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে কাব্য, নাটক ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: মহাকাব্য রুক্মিণীহরণ (১৯১০), শিবাজীচরিত (১৯৪৬); নাটক বঙ্গীয় প্রতাপ (১৯১৭), মিবার প্রতাপ প্রভৃতি। তিনি বাংলা ভাষায়ও বিবিধবিষয়ক অনেক গ্রন্থ রচনা করেন, যেমন: বিরাজ সরোজিনী (নাটিকা, ১৮৯৯), স্মৃতিচিন্তামণি (স্মৃতিগ্রন্থ, ১৯০৯), প্রতাপাদিত্য চরিত্র, কাব্যকৌমুদী (অলঙ্কার, ১৯৫১) ইত্যাদি।

হরিদাস কর্তৃক সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে সংস্কৃত মহাভারতের সটীক সম্পাদনা সর্বাপেক্ষা পান্ডিত্যপূর্ণ কৃতি। একক প্রচেষ্টায় তিনি ১৫৯ খন্ডে মূলসহ এর বঙ্গানুবাদ বঙ্গাক্ষরে প্রকাশ করেন (১৯২৯-৫০)। ফলে সাধারণ বাঙালি পাঠকের পক্ষে  মহাভারত পাঠ ও আলোচনার পথ সুগম হয়। তাঁর অন্যান্য সম্পাদিত গ্রন্থগুলি: মেঘদূত (১৯১৯), রঘুবংশ (১৯২৪), অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ (১৯২৬), সাহিত্যদর্পণ (১৯২৮), মুদ্রারাক্ষস (১৯২৯) ইত্যাদি।

হরিদাস ১৯৩৫-৩৬ সময়পর্বে  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎএর সহকারী সভাপতি এবং পরে বিশিষ্ট অধ্যাপক নির্বাচিত হন। ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত পন্ডিত সম্মেলনের অভ্যর্থনা সভাপতি এবং মজঃফরপুরে অনুষ্ঠিত অখিল ভারত বঙ্গভাষা সম্মেলনের মূল সভাপতি ছিলেন। তিনি কোটালিপাড়া পাশ্চাত্য বৈদিক সঙ্ঘেরও সভাপতি ছিলেন। সংস্কৃতের স্মৃতি ও উপাধি পরীক্ষায় রৌপ্যপদক প্রদানের জন্য তিনি ১৯৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৩৫০০ টাকা দান করেন।

হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ তাঁর পান্ডিত্য ও কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারসহ বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক বহু সম্মানে ভূষিত হন। তিনি কাশীর ভারতধর্ম মহামন্ডল কর্তৃক ‘মহোপদেশক’, ভারতীয় পন্ডিতমন্ডল কর্তৃক ‘মহাকবি’, শান্তিপুর পুরাণ পরিষদ কর্তৃক ‘ভারতাচার্য’, ভারত সরকার কর্তৃক ‘মহামহোপাধ্যায়’ (১৯৩৩) ও ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৬০) উপাধি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬১) প্রাপ্ত হন। এছাড়া কলকাতা কর্পোরেশন কর্তৃক নাগরিক সম্বর্ধনা (১৯৬০) এবং কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অর্ডার অফ মেরিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।  [কানাই লাল রায়]