শিশুসাহিত্য
শিশুসাহিত্য শিশুদের উপযোগী সাহিত্য। সাধারণত ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় রেখে এ সাহিত্য রচনা করা হয়। এই বয়সসীমার ছেলেমেয়েদের শিক্ষামূলক অথচ মনোরঞ্জক গল্প, ছড়া, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদিকেই সাধারণভাবে শিশুসাহিত্য বলে।
শিশুসাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর বিশেষ বক্তব্য, ভাষাগত সারল্য, চিত্র ও বর্ণের সমাবেশ, হরফের হেরফের প্রভৃতি কলাকৌশলগত আঙ্গিক। শিশুসাহিত্যের বিষয়বৈচিত্র্য অফুরন্ত। এতে থাকে কল্পনা ও রোম্যান্স, জ্ঞান-বুদ্ধির উপস্থাপনা, রূপকথা, এ্যাডভেঞ্চার আর ভূত-প্রেতের গল্প। বিশ্ববিখ্যাত রচনাদি, যেমন: হ্যান্স এন্ডারসনের ফেয়ারি টেলস, এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড; ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রসো (১৭১৯); জোনাথন সুইফটের গালিভারস ট্রাভেলস (১৭২৬); সারভাস্টিজের ডন কুইকসোট (১৬০৫), ট্রেজার আইলা্যান্ড (১৮৩৩), ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড প্রভৃতি যুগযুগ ধরে সব দেশের শিশুদের আনন্দ দিয়ে আসছে।
বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্যের গোড়াপত্তন হয় ১৮১৮ সালে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত নীতিকথা নামক গ্রন্থের মাধ্যমে। উপদেশমূলক ১৮টি গল্পের সমন্বয়ে প্রণীত এ গ্রন্থটি স্কুলপাঠ্যরূপে ব্যবহূত হলেও প্রকৃতপক্ষে এটিই প্রথম শিশুপাঠ্য গ্রন্থ।
শিশুসাহিত্যের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রমুখের রচনার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের বোধোদয় (১৮৫১), কথামালা (১৮৫৬), চরিতাবলী (১৮৫৬), আখ্যানমঞ্জরী (১৮৬৩), বর্ণপরিচয় (১৮৮৫); অক্ষয়কুমারের চারুপাঠ (৩ খন্ড, ১৮৫৫-৫৯); মদনমোহনের শিশুশিক্ষা (৩ ভাগ, ১৮৫০-৫৫) এবং স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত বালক পত্রিকার উল্লেখ করা যায়।
তৃতীয় পর্যায় হচ্ছে রবীন্দ্রযুগ। রবীন্দ্রপূর্বযুগের শিশুসাহিত্য মুখ্যত জ্ঞানমূলক, উপদেশমূলক ও নীতিকথামূলক; কিন্তু রবীন্দ্রযুগের শিশুসাহিত্য মুখ্যত আনন্দমূলক। সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসাধনায় শিশুরা উপেক্ষিত হয়নি; তাঁর শিশু (১৯০৬) কাব্যগ্রন্থেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে সমকালীন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য। হেমেন্দ্রপ্রসাদের আষাঢ়ে গল্প (১৯০১), যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিরাশি (১৯০২), দক্ষিণারঞ্জনের ঠাকুরমার ঝুলি (১৯০৮), আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ভূত পেতনী (১৩০৯), উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির বই (১৯১০), সুখলতা রাও-এর গল্পের বই (১৯১৩), সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল (১৯২৩), পাগলা দাশু, অবাক জলপান, নজরুল ইসলামের ঝিঙে ফুল (১৯২৬) ইত্যাদি গ্রন্থ বাংলার শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য পত্র-পত্রিকার মধ্যে মুকুল, প্রকৃতি (১৯০৭), সন্দেশ (১৯১৪), মৌচাক (১৯২১), শিশু সাথী (১৯২২), খোকা খুকু (১৯২৩), শুকতারা, টাপুর টুপুর ইত্যাদি উলেখযোগ্য।
মুসলমান শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে প্রথম দিকের লেখক হলেন মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী। তিনি নূরনবী (১৯১৮) নামে একটি উৎকৃষ্ট শিশুপাঠ্য জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: হাবিবুর রহমানের হাসির গল্প (১৯১৭), ইমদাদুল হকের কামারের কান্ড (১৯১৯), ইব্রাহিম খাঁর ছেলেদের শাহনামা (১৯২২), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর সিন্দাবাদ সওদাগরের গল্প (১৯২২), বন্দে আলী মিয়ার চোর জামাই (১৯২৯), মেঘকুমারী (১৯৩২), জঙ্গলের খবর (১৯৩৪), জঙ্গলের রাজা (১৯৩৭); মোহাম্মদ মোদাবেবরের হীরের ফুল (১৯৩১), হবীবুলাহ বাহারের ওমর ফারুক (১৯৩১), আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কচিপাতা (১৯৩২) প্রভৃতি।
পরে যাঁরা শিশুসাহিত্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন তাঁরা হলেন: গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্দীন, কাজী কাদের নেওয়াজ, ফররুখ আহমদ, মোহাম্মদ নাসির আলী, শওকত ওসমান, আতোয়ার রহমান, হাবিবুর রহমান প্রমুখ। জসীমউদ্দীনের চলে মুসাফির একটি সুখপাঠ্য শিশুতোষ ভ্রমণকাহিনী। সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করে আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন (১৯৩০-১৯৯৮) বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে (১৯৫৫), অবাক পৃথিবী (১৯৫৫), খেলতে খেলতে বিজ্ঞান প্রভৃতি গ্রন্থের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বেগম সুফিয়া কামাল, আশরাফ সিদ্দিকী, রোকনুজ্জামান খান, মাহবুব তালুকদার, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হুমায়ুন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ গদ্য ও পদ্যে শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করেছেন।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিশুসাহিত্য চর্চার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী (১৯৭৬) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এযাবৎ প্রায় ৪২৪টি শিশু-কিশোর উপযোগী গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। গ্রন্থগুলির বিষয়বৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্য, যেমন: কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, গল্প, নাটক, জীবনীগ্রন্থ, বিজ্ঞানগ্রন্থ, বাংলাদেশ সিরিজ ইত্যাদি। পাঁচ খন্ডে সমাপ্ত শিশু বিশ্বকোষ (১৯৯৩-৯৮) শিশু একাডেমীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই প্রতিষ্ঠানের মাসিক পত্রিকা শিশু ১৯৯৯ সালে ২৩ বর্ষ পূর্ণ করেছে।
বাংলা একাডেমী থেকেও এযাবৎ শতাধিক শিশুতোষ প্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে উপরিউক্ত বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিবিষয়ক গ্রন্থ, বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থ ইত্যাদি। বাংলা একাডেমী শিশুসাহিত্যে উলেখযোগ্য অবদানের জন্য লেখককে ‘অমর একুশ’ উপলক্ষে পুরস্কার প্রদান করে থাকে।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে বাংলা সাহিত্যে শিশু (২০০২) ও দুই খন্ডে আকর্ষণীয় শিশু বিশ্বকোষ ছোটদের বাংলাপিডিয়া (২০১১) এবং মুক্তধারার মতো বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থাও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশ করে এ ধারার সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। [শেখ আতাউর রহমান]