শালবন বিহার

শালবন বিহার  ময়নামতীর প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থানগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। কুমিল্লার কাছে কোটবাড়ির বর্তমান বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর লাগোয়া লালমাই পাহাড়ের মধ্যবর্তী এলাকায় এর অবস্থিতি। এখানে খননের ফলে পাহাড়পুর বিহারের মতো এক বিরাট বৌদ্ধবিহার ও অন্যান্য উপকরণের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলি সাত থেকে বারো শতকের বলে ধরা যায়।

এক কেন্দ্রীয় মন্ডপের চতুর্দিকে ক্রুশ আকারে চারটি  শাখায় এ বিহারের পরিকল্পনা করা হয়। এ বৌদ্ধ মঠের আয়তন ১৬৭ বর্গমিটার। এতে মোট ১৫৫টি কক্ষ রয়েছে। এ বিহারের মূল প্রবেশপথ মাত্র একটি। আর সেটির অবস্থান উত্তর শাখার মধ্যবর্তী স্থলে। এ প্রবেশপথের সম্মুখভাগ ২২.৬ মিটার চওড়া, আর এর দুপাশ থেকে বাইরের দিকে প্রলম্বিত রয়েছে দুটি প্রহরিকক্ষ। বিহারের সকল দেওয়াল বিশালায়তন ও ইট নির্মিত। পেছনের দেওয়াল সবচেয়ে পুরু ও বিশাল। এই দেওয়াল ৫ মিটার পুরু। এ বৈশিষ্ট্য ও সেইসাথে প্রহরিকক্ষসম্বলিত একমাত্র প্রবেশদ্বারের কড়া নিরাপত্তার আলামত ও বহিঃপ্রাচীরের বিশাল আকৃতি এ বিহারকে সুনিশ্চিতভাবে এক দুর্গের নমুনা হিসেবে তুলে ধরে। এরকম এক দুর্গপ্রাসাদের প্রয়োজন ছিল এ কারণে যে, এ ধরনের ধর্মীয় স্থাপনাগুলির বিত্তবৈভব তখন বৃদ্ধি পাচ্ছিল আর যুগপৎ নিরাপত্তার অভাবও ছিল।

ভুমি নকশা, শালবন বিহার

শালবন বিহার এলাকায় অনেক গভীরে খনন চালিয়ে এখানে চার স্তরে সংস্কার-মেরামত ও পুনর্নির্মাণ পর্যায়ের প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়। আদিতম কেন্দ্রীয় মন্ডপটি ৩য় কালপর্যায়ভুক্ত (সাত-আট খ্রি.)। ২য় ও ১ম কালপর্যায়ের পরিসরে পড়ে এমন কোন বিহারের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। পরের দুই কালপর্যায় অর্থাৎ ৪র্থ ও ৫ম কালপর্যায়ে (নয়-দশ খ্রি.) এখানে পূর্বের নির্মিত অবশেষের উপর নতুন করে মেঝে ও প্রবেশপথ নির্মিত হয়। বিহারের কক্ষগুলির ভেতর দুটি কৌতূহলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য এ কাল পরিসরে পরিলক্ষিত হয়েছে। সে দুটি হলো: কক্ষে আগুন জ্বালানোর তথা রান্নার পরিকল্পিত ব্যবস্থা ও নকশি ইটের পাদস্তম্ভ (pedestal)। এগুলি বিহারের মূল পরিকল্পনাভুক্ত ছিল না। স্পষ্টত দেখা যায়, বিহারের কিছু নিবাসী সন্ন্যাসী তাদের নিজেদের রান্নার ও একান্ত স্বকীয় পর্যায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের চাহিদা পূরণের জন্য এ ব্যবস্থা করেছিলেন। অবশ্য বিহারে সকল সন্ন্যাসীর জন্য বারোয়ারি রন্ধনশালা ও বিরাটাকার পীঠস্থান ছিল। অন্যান্য আরও যে বৈশিষ্ট্য এই বিহারে পরিলক্ষিত হয়, তা হলো দরবার আঙিনায় কিছু সোপান ও কোণের কক্ষগুলিতে বড় আকারের সিঁড়ি,কেন্দ্রীয় কক্ষগুলিতে ভজনালয়,প্রতি কক্ষে পূজ্য দেবদেবীর মূর্তি,বাতি, লিখন ও পাঠ সামগ্রী রাখার জন্য সোপানক্রমিক তাক বা কুলুঙ্গি।

কেন্দ্রীয় বা মধ্যবর্তী মন্ডপ  শালবন বিহারের কেন্দ্রীয় মন্ডপ প্রকৃতপক্ষে কোন একক নির্মাণ কাঠামো নয়, বরং  এখানে ছয়টি বিভিন্ন নির্মাণ কাঠামোর অস্তিত্ব রয়েছে। এগুলি বিভিন্ন সময়ে ও পরিকল্পনায় একই স্থানে একের পর এক নির্মিত হয়। এগুলিতে কালপরিক্রমায় একটি সনাতন বৌদ্ধ সূতপ স্থাপত্য ক্রমবিবর্তনের ফলে কিভাবে ধীরে ধীরে হিন্দু মন্দির স্থাপত্যে রূপান্তরিত হয়েছে তারই এক প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথম দুই কালপর্যায়ের ধ্বংসাবশেষ তৃতীয় কালপর্যায়ের নিচে লুকিয়ে আছে। ৩য় কালপর্যায়ে এখানে এক ক্রুশাকার মন্ডপ নির্মিত হয় বিহারের একক স্থাপনার অঙ্গ হিসেবে।

ক্রুশাকার মন্ডপ  অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক স্থাপত্যের নমুনা এই ক্রুশাকৃতি মন্ডপ। মন্ডপটি গ্রিক ক্রুশাকৃতি পরিকল্পনায় নির্মিত। দীর্ঘতর মূলদন্ডটির সাথে মিল রেখে ৫১.৮ মিটার দীর্ঘ বাহুর দুদিকে ভজনালয়গুলি নির্মিত হয়েছিল। মন্ডপের নিচের তলার দেওয়ালগুলিতে রয়েছে টেরাকোটা ভাস্কর্য ফলক দিয়ে প্রলম্বিত রজ্জুবিন্যাসে চমৎকার অলঙ্করণ। নকশি পোড়ামাটি ভাস্কর্য ফলকগুলি সমান্তরাল বন্ধনীতে নকশি ইট দিয়ে বসানো হয়েছে। বস্ত্তত এই মন্ডপের সাথে পাহাড়পুর বিহারের লক্ষণীয় মিল রয়েছে।

ময়নামতীকে কার্যত সাত-আট শতকের বাংলার বৌদ্ধ মন্দির স্থাপত্যের এক পরিপূর্ণ বিকশিত নমুনা বলা যায়। আর যেহেতু  ময়নামতীর এ পুরাতাত্ত্বিক সৌধগুলি প্রশ্নাতীতভাবে পাহাড়পুর ও বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রায় একশো বছর আগের এবং এখানকার বিবর্তন ধারায় আরও আগের ও মধ্যবর্তী স্তরের বিকাশ পর্বের উপস্থিতি লক্ষণীয়,ফলে যুক্তিসঙ্গতভাবেই ধরে নেওয়া যায় যে, ময়নামতীর ক্রুশাকার মন্ডপের নমুনা কেবল পাহাড়পুর কিংবা পূর্ব ভারতের বিক্রমশীলা বিহারকে প্রভাবিত করে নি বরং বার্মা, ইন্দোনেশিয়া ও ইন্দোচীনেও বৌদ্ধ স্থাপত্যের নমুনা বা আদর্শ হিসেবে কাজ করেছে।

শালবন বিহার

পরবর্তী দুই কালপর্যায় অর্থাৎ ৪র্থ ও ৫ম কালপর্যায়ে উল্লিখিত কেন্দ্রীয় মন্ডপটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে মন্ডপের ক্রুশাকৃতি বদলে আয়তাকার হয়ে ওঠে। এভাবে পুরোপুরি খোলা, সুপরিসর ও কার্যোপযোগী হয়ে ওঠায় গোটা কাঠামো অনেকখানি হিন্দু মন্দিরের রূপ পরিগ্রহ করে। বৌদ্ধ পীঠস্থান বা মন্দিরের নিচতলার দেওয়ালে টেরাকোটা অলঙ্করণ একটা ঐতিহ্যগত রীতি। তবু প্রধানত উল্লিখিত গুণগত পরিবর্তনেই সম্ভবত এ রীতি অতঃপর বন্ধ করে দেওয়ার প্রাথমিক কারণটি নিহিত রয়েছে। এ বিবর্তিত পীঠস্থানগুলির প্রধান আকর্ষণ বহির্দেওয়াল থেকে ভেতরের প্রকোষ্ঠগুলি, যেখানে মূর্তি, ভাস্কর্য ও স্থাপত্য অলঙ্করণ রয়েছে।

আনুষঙ্গিক অন্যান্য নির্মাণ কাঠামো  প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এখানে আরও কতকগুলি আনুষঙ্গিক নির্মাণকাঠামোর অস্তিত্বও উদ্ঘাটিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে ভোজনালয়, অপেক্ষাকৃত ছোট স্তম্ভযুক্ত আয়ত ও বর্গাকার পীঠস্থান এবং পূজার সূতপ। এগুলির ভিত ও বুনিয়াদ চমৎকারভাবে ঢালাই করা। এ ছাড়াও রয়েছে বিহারের বাইরে ও ভেতরে নানা ধরনের আরও কিছু ভবন। বহির্ভাগে রয়েছে মধ্যমাকার একটি মন্ডপ, যা চারপাশে স্তম্ভবেষ্টিত অনেকখানি চিরায়ত মন্দিরের অনুরূপ এবং যার নিদর্শন আর কোনো বিহারস্থলে আছে বলে জানা নেই।

অন্যান্য উদ্ঘাটন  ময়নামতীর এই খননস্থল থেকে আবিষ্কৃত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে আটটি তাম্রশাসন, আনুমানিক ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য টেরাকোটা নিদর্শন, পোড়ামাটির সিলমোহর, মোহরাঙ্কন, প্রস্তর, ব্রোঞ্জ ও টেরাকোটার ভাস্কর্য, যেগুলি তাদের মূল অবস্থান বা অন্যত্র থেকে পাওয়া গেছে।

এই মহাসন্ন্যাসী বিহার ও এর ক্রুশাকার কেন্দ্রীয় মন্ডপটি  দেবপর্বতের আদি দেব বংশের ৪র্থ শাসক শ্রী ভবদেব অনুমানিক সাত শতকের শেষ কিংবা আট শতকের গোড়ার দিকে নির্মাণ করেন।  [এম হারুনুর রশীদ]