রামায়ণ

রামায়ণ প্রাচীন ভারতীয় সূর্যবংশীয় রাজাদের কাহিনী অবলম্বনে মহর্ষি বাল্মীকি রচিত  সংস্কৃত মহাকাব্য। এর রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক। অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্রের জীবন-কাহিনী এর মুখ্য বিষয়। কাব্যটি সপ্তকান্ড বা সাত খন্ডে বিভক্ত। আদিকান্ডে রামের জন্ম ও বাল্যজীবন; অযোধ্যাকান্ডে অযোধ্যা থেকে রামের নির্বাসন; অরণ্যকান্ডে রাম-লক্ষ্মণ-সীতার বনবাস ও রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ; কিষ্কিন্ধ্যাকান্ডে বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে রামের মিত্রতা; সুন্দরকান্ডে রামের সসৈন্যে লঙ্কা গমন; লঙ্কাকান্ডে রাম-রাবণের যুদ্ধ, যুদ্ধে রাবণের পরাজয় ও সবংশে মৃত্যু, রাম কর্তৃক সীতা উদ্ধার ও রাবণভ্রাতা বিভীষণকে লঙ্কার রাজা করে সদলে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন; এবং উত্তরকান্ডে  রামচন্দ্র কর্তৃক সীতাবিসর্জন, লব-কুশের জন্ম, রাম-সীতার পুনর্মিলন এবং মৃত্যু এ বিষয়গুলি বর্ণিত হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক ঘটনাবলি। এই সপ্তকান্ডের প্রতিটি আবার একাধিক সর্গ বা অধ্যায়ে বিভক্ত। কাব্যটি অনুষ্টুপ্ ছন্দে রচিত এবং এর শ্লোকসংখ্যা বিভিন্ন সংস্করণে ২৪-৪৩ হাজার পর্যন্ত।

চতুর্দশ শতকে  কৃত্তিবাস ওঝা প্রথম সংস্কৃত রামায়ণের বাংলা অনুবাদ করেন, যা কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে পরিচিত। পরে ষোড়শ শতকে আসামের কবি মাধব কন্দলী এবং শঙ্করদেব যৌথভাবে প্রাচীন অসমীয়া ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। সতেরো শতকে অদ্ভুত আচার্য (নিত্যানন্দ) রচিত অদ্ভুতাচার্য রামায়ণ উত্তরবঙ্গে বেশ জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু পরে কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে স্থান দখল করে। একই শতকে আরও অনেক বাঙালি কবি রামায়ণ রচনা করেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন দ্বিজ লক্ষ্মণ, কৈলাস বসু, ভবানী দাস, কবিচন্দ্র চক্রবর্তী, মহানন্দ চক্রবর্তী, গঙ্গারাম দত্ত ও কৃষ্ণদাস।

১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে রামানন্দ ঘোষ যে রামায়ণ রচনা করেন তার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এতে তিনি রামচন্দ্রকে বুদ্ধের  অবতার বলে ঘোষণা করেছেন। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়ানিবাসী জগৎরাম বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পুত্র রামপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় যৌথভাবে আরেকটি বাংলা রামায়ণ রচনা করেন। বাংলা ছাড়া ভারতীয় অন্যান্য ভাষায়ও রামায়ণ অনূদিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে তুলসীদাসের (১৫৩৩-১৬২৪) হিন্দী রামায়ণ (তুলসীদাসী রামায়ণ বা রামচরিত মানস) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি উত্তর ভারতে বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয়।

উপরিউক্ত বাংলা রামায়ণগুলি সংস্কৃত রামায়ণের অনুবাদ হলেও রচয়িতার প্রতিভা, জীবন, জগৎ ও সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, রচনারীতি ইত্যাদি কারণে নতুন সৃষ্টির মর্যাদা লাভ করেছে। বিশেষ করে কৃত্তিবাসী রামায়ণ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। মূলের সঙ্গে বিষয়গত অনেক পার্থক্য থাকলেও বাঙালি হিন্দুসমাজে এর ব্যাপক প্রভাব আছে।

রামায়ণ হিন্দুদের নিকট ধর্মগ্রন্থের পর্যায়ভুক্ত। এটি ভারতবর্ষ এবং ভারতবর্ষের বাইরেও অনেক দেশেই প্রচলিত ও সমাদৃত। শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় রামায়ণ এখনও খুবই জনপ্রিয়। বাংলা ও সংস্কৃতসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। যুগে যুগে অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং সৃষ্টি করেছেন মূল্যবান অনেক কাব্য, নাটক, চিত্রকলা, কাহিনী ইত্যাদি।  মধুসুদন দত্ত রামায়ণের অংশ-বিশেষ অবলম্বনে তাঁর বিখ্যাত  মেঘনাদ বধ কাব্য রচনা করেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে উপমাদি অলংকার এবং চিত্রকল্প রচনায় রামায়ণের বহু ঘটনার ও চরিত্রের উল্লেখ আছে।

সংস্কৃত রামায়ণকে পৃথিবীর আদি মহাকাব্য বলা হয়। এতে  প্রাচীন ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে মূলবান তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে অনুবাদসূত্রে ওইসব বিষয় সংক্রামিত হয়েছে। সে সঙ্গে রয়েছে মধ্যযুগীয় বাংলা তথা ভারতবর্ষ সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। রামায়ণের প্রধান কয়েকটি চরিত্র যেমন রাম,  সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, বিভীষণ একেকটি  আদর্শের প্রতীক। পিতৃসত্য ও প্রজা পালন, পতিপরায়ণতা, ভ্রাতৃভক্তি, ভগবদ্ভক্তি ইত্যাদি গুণের কারণে এ চরিত্রগুলি শাশ্বত রূপ লাভ করেছে। আর এ কারণেই ভারতীয় সমাজজীবনে বিশেষত হিন্দুসমাজে রামায়ণের  প্রভাব চিরকালীন।  [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]