ম্যালেরিয়া

ম্যালেরিয়া  মশাবাহিত দীর্ঘস্থায়ী রোগ। এতে কাঁপুনিসহ জ্বর আসে, ক্রমে রক্তহীনতা এবং প্রায়শ মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয় বা মৃত্যু ঘটে। ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ নানা রকমের এবং এ রোগ লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস ও ফলত বিপাকীয় বিপর্যয় থেকে উদ্ভূত। রোগটির বৈশিষ্ট্য জ্বর, গৌণ রক্তহীনতা, প্লীহাবৃদ্ধি এবং তীব্র পর্যায় থেকে দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার উত্তরণ। তীব্র পর্যায়ে মাঝে মাঝে জ্বরের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং পরবর্তী দীর্ঘস্থায়ী পর্যায়ে মাঝেমাঝেই সুপ্তাবস্থা ভেঙে তীব্র পর্যায়ের মতোই জ্বর দেখা দেয়। রোগের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব অনেকগুলি উপাদানের উপর নির্ভরশীল পরজীবীর প্রজাতি ও প্রকারভেদ, রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা, পরিবেশ ইত্যাদি।

স্ত্রী এনোফিলিস (বামে), পুরূষ এনোফিলিস (ডানে)

বিস্তার ও প্রকোপ  ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বিশ্বব্যাপী এবং সম্ভবত অন্যান্য সংক্রামক রোগের তুলনায় এতে আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক বেশি। ম্যালেরিয়াকে অনেকেই উষ্ণমন্ডলীয় বা উপ-উষ্ণমন্ডলীয় রোগ বলেন, কিন্তু আসলে তা সত্য নয়। অতীতে সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও উত্তর রাশিয়াতে ম্যালেরিয়ার মহামারী দেখা দিয়েছিল। আমেরিকা আবিষ্কারের আগে সেখানে ম্যালেরিয়া ছিল কিনা তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি; তবে উপনিবেশ স্থাপনের ফলে ম্যাসাচুসেটস উপকূল এবং জর্জিয়া-ক্যারোলিনা উপকূল এলাকায় সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ম্যালেরিয়ার উপস্থিতি ছিল বলে জানা যায়। এমনকি ১৯৩০-এর দশকেও আমেরিকা মহাদেশে বছরে ৬০-৭০ লক্ষ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হতো। দক্ষিণ চীন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও এশিয়া মাইনরে ম্যালেরিয়া ছিল একটি অপ্রধান আঞ্চলিক রোগ। কোন কোন দ্বীপে যেমন, মধ্য ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ, গুয়াম, হাওয়াই, মিডওয়ে দ্বীপপুঞ্জ ও নিউজিল্যান্ডে ম্যালেরিয়া নেই। রোগটির সর্বাধিক প্রাদুর্ভাব স্বল্প আর্দ্র অঞ্চলে ও সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় এবং সর্বনিম্ন মরু ও পার্বত্য অঞ্চলে। দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার ৩,০০০ মিটার উঁচু অঞ্চলে মাঝে মাঝে এ রোগের খবর পাওয়া যায়। এর বিস্তার বাহক মশার উপস্থিতির উপর নির্ভরশীল।

বিগত ৭৫ বছরে রোগটি পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই হ্রাস পেয়েছে। এককালের ম্যালেরিয়াপ্রবণ ইউরোপের বেশির ভাগ এলাকাই এখন এই রোগমুক্ত এবং দক্ষিণ আমেরিকা থেকেও তা নির্মূলপ্রায়। ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০টিরও কম স্বাভাবিক ম্যালেরিয়া সংক্রমণ ঘটেছে। ভারতে বিশ শতকের মাঝামাঝিও ম্যালেরিয়ায় বছরে প্রায় ১০ লক্ষ লোক মারা গেছে।

পি.এফ রাসেল (1943, Bull. New York Aca. Med. 19: 599-630)-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পৃথিবীতে বছরে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত ৩০ লক্ষ এবং আক্রান্তের সংখ্যা কমপক্ষে ৩ কোটি।

মানুষের অন্যতম মারাত্মক ব্যাধি ম্যালেরিয়া ১৯৭০ দশকেই পৃথিবীর ম্যালেরিয়াপ্রবণ দেশগুলিতেও বিরল হয়ে আসে। উচ্ছেদ কর্মসূচি রোগটিকে প্রায় নিয়ন্ত্রণে আনে। অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে ১৯৬০-এর দশকে নিশ্চিহ্ন ম্যালেরিয়া পরজীবীদের অপ্রত্যাশিত পুনরাগমন ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সাম্প্রতিক (২০০০) হিসাব অনুযায়ী শতাধিক দেশ এবং পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৪০% এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রতিবছর মশাবাহিত এ রোগে ৩০-৫০ কোটি লোক আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে ১৫-২৭ লক্ষ। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে একদা নিশ্চিহ্নপ্রায় ম্যালেরিয়া পুনরুত্থানের সম্পর্ক খুঁজে পান।

ইতিহাস ‘ম্যালেরিয়া’ নামটি অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্যবহূত না হলেও রোগটি মানুষের প্রাচীন সংক্রামক ব্যাধিগুলির অন্যতম। হিপোক্রেটিস খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে পালাজ্বরকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছিলেন কুয়োটিডিয়ান (প্রতিদিন), টারসিয়ান (একদিন পর পর) ও কোয়ার্টান (তিনদিন পর)। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, বদ্ধ জলাশয় থেকে যারা পানি পান করে তাদের প্লীহা বড় ও শক্ত হয়ে থাকে, যা এই রোগের একটি বৈশিষ্ট্য। হারকিউলিস ও হাইড্রার উপকথার সঙ্গে ম্যালেরিয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে। ১৭৫৩ সালে টরটি (Torti) রোগটিকে বায়ুবাহিত মনে করে ম্যালেরিয়া (malaria) নামকরণ করেন, কেননা এর সঙ্গে জলাভূমি ও বিলের সম্পর্ক ছিল। রোগটির কারণ আবিষ্কারের কৃতিত্ব (১৮৮০) ফরাসি সৈন্যদলভুক্ত ও তৎকালে আলজেরিয়াতে কর্মরত লাভেরোঁ (Laveran) নামের একজন চিকিৎসকের। মশা দ্বারা রোগ সংক্রমণের তত্ত্বটি বহুদিন থেকেই ইটালি ও টাইরোলিয়ার কৃষক এবং সাবেক জার্মান পূর্ব আফ্রিকার আদিবাসীদের জানা থাকলেও, ১৮৮৩ সালে কিং (King) প্রথম মশা- ম্যালেরিয়া তত্ত্ব সঠিকভাবে প্রকাশ করেন। ১৮৮৫ ও ১৮৮৬ সালে গলগি (Golgi) জ্বরের ধারার সঙ্গে রক্তকণিকার অভ্যন্তরে পরজীবীদের বেড়ে ওঠা এবং বিশেষত এগুলির পালাক্রমিক স্পোর গঠনের সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। কোয়ার্টান এবং টারসিয়ান উভয় ধরনের পরজীবীর ক্ষেত্রেই তিনি এমনটি লক্ষ্য করেছিলেন।

উষ্ণমন্ডলীয় রোগ ও চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রপথিক, স্যার প্যাট্রিক ম্যানসন ১৮৯৪ সালে মশা যে ম্যালেরিয়া বাহক সে অনুমান ব্যক্ত করেন। তাঁরই অব্যাহত নির্দেশনা ও উৎসাহের কারণে ব্রিটিশ চিকিৎসক স্যার রোনাল্ড রস ১৮৯৭-৯৮ সালে ভারতে ঐ বিস্ময়কর আবিষ্কার, মশাই নিশ্চিতরূপে ম্যালেরিয়া জীবাণু বাহক, সম্পন্ন করেন এবং দুবার নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। রোনাল্ড রস মানুষের ম্যালেরিয়া এবং বাহক হিসেবে অ্যানোফেলিস মশার ভূমিকা আবিষ্কার করলেও তাঁর প্রধান কৃতিত্ব হলো কিউলেক্স মশার মধ্যে পাখিদের ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুর সম্পূর্ণ জীবনচক্র আবিষ্কার। তিনি পাখি থেকে মশাতে এবং মশা থেকে পাখিতে এই চক্রটির পুনরার্বতন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৮ সালের নভেম্বর মাসে ইতালীর গবেষক এ. বিগনানি, জি.বি গ্রাসি এবং জি. বাস্তিয়ানেলি সর্বপ্রথম মশা দ্বারা মানুষকে সংক্রমিত করান, মানুষের শরীরে পরজীবীর গোটা পরিস্ফুরণ বর্ণনা করেন এবং ম্যালেরিয়া যে শুধু অ্যানোফেলিস মশাই ছড়িয়ে থাকে সেটাও অনুমান করেন, যা এখনও সঠিক বলে গণ্য। পরবর্তীকালে বহু বৈজ্ঞানিক ও গবেষক সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে Anopheles-এর কয়েকটি প্রজাতিই ম্যালেরিয়ার জীবাণু বাহক এবং Plasmodium-এর তিনটি প্রজাতির জীবাণু ম্যালেরিয়ার কারণ।

ম্যালেরিয়া চিকিৎসার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল কুইনাইন উৎপাদক উচ্চফলনশীন সিনকোনা গাছের ব্যাপক চাষ। পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ওলন্দাজরা এতে সাফল্য অর্জন করে। ১৮৯১ সালে গাটম্যান ও পল এহর্লিখ ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় মেথিলিন ব্লু-এর কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শুলম্যান (Schulemann) এবং তাঁর সহযোগীরা প্লাসমোচিন (plasmochin) আবিষ্কার করেন যা পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে কেমাকুইন (quamaquine) উৎপাদনে সহায়ক হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মেপাক্রিনসহ আরও কয়েকটি ম্যালেরিয়ানাশক ঔষধ আবিষ্কৃত হয়। কালক্রমে ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় উন্নততর সংশ্লেষিত যৌগগুলি ক্রমান্বয়ে পুরাতন ঔষধের স্থলবর্তী হয়েছে।

ম্যালেরিয়া পরজীবী ম্যালেরিয়ার পরজীবী Plasmodium গণভুক্ত এককোষী প্রাণী, যার চারটি প্রজাতি দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয়: Plasmodium vivax, P. ovale, P. malariae, এবং P. falciparum। বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য ম্যালেরিয়া পরজীবীদের দুটি পোষকের প্রয়োজন, মানুষ ও স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশা। মশাকে বাহক বলা হয়ে থাকে, কারণ মশাই একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষে রোগটি ছড়ায়। সংক্রমিত স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশার দংশনেই পরজীবীরা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। দংশনের আধঘণ্টার মধ্যেই পরজীবী রক্তপ্রবাহের সঙ্গে যকৃতে পৌঁছয় এবং সেখানে বংশবৃদ্ধি শুরু করে। জীবাণুর জীবনচক্রের এই অংশকে ‘লোহিতকণিকা বহিস্থ চক্র’ (exoerythrocytic cycle) বলা হয়। কয়েকদিন পর জীবাণু যকৃত ত্যাগ করে রক্তের লোহিতকণিকা আক্রমণ করে এবং সেখানে আরেক দফা বংশবৃদ্ধির ‘লোহিতকণিকা চক্র’ (erythrocytic cycle) শুরু করে। লোহিত কণিকা শীঘ্রই জীবাণুতে ভরাট হয়ে ফেটে যায় এবং রক্তে পরজীবী অবমুক্ত করে। একই সঙ্গে কিছু বিষাক্ত দ্রব্যও বিমুক্ত হয়। রোগীর তখন কাঁপুনি ওঠে এবং প্রবল জ্বর অনুভব করে।

অনেক ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়া রোগীদের কাঁপুনিজ্বর বা পালাজ্বর শুরুর আগে কয়েকদিন একটানা জ্বর চলতে পারে। P. vivaxP. ovale ম্যালেরিয়াতে একদিন পর পর জ্বর আসে। P. malariae সংক্রমণে প্রতি তৃতীয় দিনে জ্বর হয়। কিন্তু P. falciparum জীবাণুতে জ্বরের কোন বিশেষ নির্দিষ্ট ধরন থাকে না। সংক্রমিত লোহিত কণিকা মস্তিষ্ক, বৃক্ক, যকৃত, ফুসফুস ও পরিপাকতন্ত্রের ক্ষুদ্র রক্তনালির গায়ে লেগে থাকে। রোগী ক্ষীণ চেতনা ও খিঁচুনির দরুন অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এটাই মস্তিষ্কের ম্যালেরিয়া (cerebral malaria)। শেষ পর্যন্ত রোগী কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়।

ম্যালেরিয়া রোগী জ্বর বৃদ্ধির সময় সাধারণত কাঁপুনি অনুভব করে এবং শরীরের তাপমাত্রা ১০৪° ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। ত্রিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যেই তথাকথিত উষ্ণ বা রক্তিমাভার পর্যায় শুরু হয় এবং তা কয়েক ঘণ্টা চলার পর শেষ পর্যন্ত রোগীর প্রচুর ঘাম হয় ও একই সঙ্গে জ্বরও কমে আসে। চক্রটি বার বার পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। জ্বর ছাড়াও রোগী রক্তশূন্য হয়ে পড়ে এবং যকৃত ও প্লীহা বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা দেয়।

বাহক মশা  বাংলাদেশে বিদ্যমান প্রায় ৩৪ প্রজাতির অ্যানোফেলিস মশার মধ্যে সাতটি ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায় বলে জানা গেছে। এই সাতটির মধ্যে চারটি Anophelis dirus, A. philippinensis, A. sundaicus, এবং A. minimus গুরুত্বপূর্ণ ম্যালেরিয়া বাহক। অবশিষ্ট তিনটি A. aconitus, A. annularis, এবং A. vagus ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত এলাকায় থাকার দরুন সম্প্রতি (১৯৯১-১৯৯৩) ম্যালেরিয়ার বাহক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। A. dirus বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ী বনাকীর্ণ এলাকা ও পাহাড়তলীতে ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এই বুনো প্রজাতিটি মূলত ঘরের বাইরে থাকে এবং প্রধানত মাঝরাতে দংশন করে। দিনের বেলা এদের বসত ঘরে পাওয়া যায় না। রক্ত শোষণের আগে এরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয় এবং রক্ত খাওয়ার পরপরই বাইরে পালায়। এগুলি ঘরের বাইরেও দংশন করে থাকে।

জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড় ও পাহাড়তলীর ম্যালেরিয়ার আদিবাহক A. minimus ১৯৬০-এর দশকে ম্যালেরিয়া উচ্ছেদ অভিযানে DDT ছড়ানোর ফলে কার্যত নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। এরা সূর্যাস্তের পরপরই কামড়াতে শুরু করে, তবে মধ্যরাতের পরই আক্রমণ তুঙ্গে পৌঁছে। এগুলি গৃহপালিত মশা হিসেবে গণ্য। সম্ভবত কীটনাশকের চাপেই দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর সম্প্রতি এই প্রজাতির মশার কিছুটা উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের বদ্বীপীয় প্লাবনভূমির ম্যালেরিয়া বাহক A. philippinensis মশাকে ম্যালেরিয়া উচ্ছেদ কার্যক্রমের পর থেকে কম দেখা যায়। এটি কমার আরেকটি সম্ভাব্য কারণ বংশবৃদ্ধির জন্য এর উপযুক্ত জলাভূমি, জমা পানি, ডোবা, দিঘি, পুকুর ইত্যাদির অভাব। এই প্রজাতিকে এখন প্রধানত গোয়ালঘরের চালা অথবা বাইরের আশেপাশের গাছপালায়, কদাচিৎ ঘরের ভিতর বিশ্রামরত দেখা যায়।

বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে A. sundaicus ম্যালেরিয়া ছড়ায়। DDT প্রয়োগের পর থেকে এটি কার্যত লোপ পেয়েছে। বর্তমানে এদের কক্সবাজারসহ কয়েকটি উপকূল অঞ্চলে দৈবাৎ দেখা যায়। এ মশা স্বল্পলোনা পানিতে বংশবৃদ্ধি করে।

বাংলাদেশের কিছু কিছু প্লাবনভূমিতে A. annularis, A. vagus, এবং A. aconitus  মশাগুলি দেখা যায়। এ তিনটি প্রজাতি সাধারণত গরুর রক্ত খেয়ে থাকে, মাঝে মাঝে মানুষকেও কামড়ায়। A. annularis কোন কোন অঞ্চলে অধিক সংখ্যায় দেখা যায় এবং কোথাও কোথাও ম্যালেরিয়া ছড়াতেও পারে। A. aconitus এখন বিরল, বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে এ মশা ম্যালেরিয়ার গৌণ বাহক হিসেবে গণ্য। A. vagus, বাংলাদেশের সর্বত্র বিস্তৃত মশার একটি প্রজাতি এবং সম্প্রতি ম্যালেরিয়ার বাহক হিসেবে গণ্য, যদিও ভারতে তা নয়। পরিবর্তিত বাস্ত্তসংস্থানিক পরিস্থিতিতেই সম্ভবত এসব প্রজাতি ম্যালেরিয়া ছড়াতে শুরু করেছে। কোন বিশেষ ঋতু অথবা কোন বিশেষ বাস্ত্তসংস্থানিক পরিস্থিতিতে এই তিন প্রজাতির মশার ব্যাপক উপস্থিতি, বিশেষত রোগের প্রাদুর্ভাবের সময়, রোগবিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারে।

ম্যালেরিয়ার প্রকোপ  বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া সর্বদাই একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা ছিল। রোগটি এখনও দেশের উত্তর ও পূর্বাংশে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তলগ্ন স্থানগুলির একটি আঞ্চলিক রোগ। ওইসব অঞ্চল এবং কোন কোন বদ্বীপীয় প্লাবনভূমির কয়েকটি বিচ্ছিন্ন এলাকা থেকে প্রায়ই ম্যালেরিয়ার খবর পাওয়া যায়। ১৯৮৮ সাল থেকে ম্যালেরিয়া পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। ১৯৮৮ সালে রোগের ঘটনা ছিল ৩৩,৮২৪টি এবং ১৯৯৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬০,০২৩টি, তন্মধ্যে প্রায় ৭০% Plasmodium falciparum সংক্রমণ। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলিতে ৫৩,৮০৮টি (৯০%) ঘটনার মধ্যে ৪২,২২২টি ছিল ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়া (দেশের মোট ফ্যালসিপ্যারাম সংক্রমণের ৭০.৩৪%)। ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ায় সর্বাধিক আক্রান্ত জেলাগুলি হলো রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম।

দেখা গেছে, যেসব লোক ম্যালেরিয়ামুক্ত অঞ্চল থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেছে, তাদের মধ্যে ম্যালেরিয়া আক্রমণ ও মৃত্যু বেশি। এমনকি ঢাকা শহরেও প্রায়ই ম্যালেরিয়ার খবর পাওয়া যায়। আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগের ঘটনাগুলি অজানাই থেকে যায় এবং অনেক রোগীই সংগঠিত স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ গ্রহণ করে না।

ম্যালেরিয়া বাহক নিয়ন্ত্রণ  ১৯২০ সালের পূর্বে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া উচ্ছেদের কোন কার্যক্রম ছিল না। ১৯২০ সালে জনস্বাস্থ্য বিভাগ এই কার্যক্রম শুরু করলেও ১৯২০-১৯৪৭ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লার্ভা ধ্বংস ব্যতীত এক্ষেত্রে খুব কম কাজই হয়েছিল এবং তাও কয়েকটি শহর ও গ্রামাঞ্চলে। ১৯৬০-এর দশকে ম্যালেরিয়া উচ্ছেদ কার্যক্রম (malaria eradication programme/MEP) শুরু হলে যেসব স্থানে বাহক প্রজাতি সাধারণত রক্ত খাওয়ার আগে বা পরে ঘরে আশ্রয় নেয়, সেসব জায়গায় DDT ছড়ানো হতে থাকে। এই কার্যক্রম ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চললে ম্যালেরিয়ার ঘটনা ১৯৭০ সাল নাগাদ ৬,৬৬০টিতে নেমে আসে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ম্যালেরিয়া উচ্ছেদ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালেও আর তেমনভাবে চালু হয়নি।

বর্তমানে ম্যালেরিয়া উচ্ছেদের কর্মকৌশল হলো  দ্রুত ম্যালেরিয়া শনাক্তি ও চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা প্রদান। বাহকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে এবং DDT ছড়ানোও পরিত্যক্ত হয়েছে। Anopheles philippinensis এবং A. dirus প্রজাতি দুটিই এখন প্রধান বাহক, যারা ঘরের বাইরে থাকে এবং দংশন করে। কোন কোন অঞ্চলে ম্যালাথিয়ন ছড়িয়ে বাহক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ম্যালেরিয়া উচ্ছেদে উৎসাহজনক ফল পাওয়া গেছে। অধুনা কোন কোন সীমান্ত অঞ্চলে ব্যক্তিগত সুরক্ষায় ডেল্টামেথ্রিন-সম্পৃক্ত মশারি ব্যবহার বেশ সুফল দিয়েছে। ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ১৯৯৯ সাল নাগাদ প্রায় ১ লক্ষ মশারি বিতরণ করেছে। [এস.এম হুমায়ুন কবির]

মস্তিষ্কের ম্যালেরিয়া (Cerebral malaria)  ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ায় পরজীবীর আসঞ্জিত স্বভাবের দরুন মস্তিষ্কের কৈশিকনালিকা অবরুদ্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে, এমনকি মারাও যায়। বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে ম্যালেরিয়া মানুষের জন্য মারাত্মক অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছে। ঔষধ প্রতিরোধক্ষম P. falciparum মস্তিষ্কের ম্যালেরিয়ার উৎপত্তি ঘটায় এবং ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় ঔষধপত্র অকার্যকর হয়ে পড়ায় এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। সম্ভবত ব্যক্তিগত প্রতিষেধন এবং সাম্প্রতিক রাসায়নিক ওষুধপত্রের কল্যাণে ভাইভ্যাক্স ম্যালেরিয়া কার্যকরভাবে হ্রাস পেয়েছে। Plasmodium falciparum বাহক মশার প্রতিরোধক্ষম জাত আবির্ভাবের কারণে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া এখন একটি প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে উঠেছে। ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর তেমন কোন রাসায়নিক ঔষধপত্র এখনও উদ্ভাবিত হয়নি। এই ম্যালেরিয়া পাবর্ত্য চট্টগ্রামে অত্যধিক। সেখানে ৪,২৫০ জন ম্যালেরিয়া রোগীর মধ্যে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, তাদের প্রায় ৯৯% ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ায় ভুগছে এবং মাত্র ১% রোগীর দেহে ভাইভ্যাক্স প্রজাতির জীবাণু রয়েছে। এই ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়াগ্রস্ত রোগীর ১৪৫ জন অর্থাৎ প্রায় ৪% মস্তিষ্কের ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।

১৯৯০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সামরিক বাহিনীর কর্মকতা ও কর্মচারীদের মধ্যে মস্তিষ্কের ম্যালেরিয়ায় ১০২ জন রোগীর ক্ষেত্রে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। দেখা গেছে ২০-৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যেই মস্তিষ্কের ম্যালেরিয়া সর্বাধিক এবং মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই রোগের আক্রমণ সর্বনিম্ন। ত্রি-চিকিৎসা পদ্ধতিতে (যার ভিতর থাকে কুইনাইন, কট্রিমক্সাজল ও টেট্রাসাইক্লিন) মস্তিষ্কের ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুহার যথেষ্ট কমান যায় (১০.৩৯%), আর এই ত্রি-চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায় টেট্রাসাইক্লিনসহ কুইনাইনের চিকিৎসায় মৃত্যুহার প্রায় ১২.৭৫%। অন্যান্য ব্যাপক সমীক্ষা থেকে আরও দেখা গেছে যে, মস্তিষ্কের ম্যালেরিয়ায় শুধু কুইনাইনে চিকিৎসার তুলনায় ত্রি-চিকিৎসা পদ্ধতিতে মৃত্যুহার যথেষ্ট হ্রাস পায়। ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ায় কুইনাইনের ব্যর্থ চিকিৎসার কয়েকটি ঘটনা সম্প্রতি জানা গেছে। বিশ্বব্যাপী প্রয়াস সত্ত্বেও ম্যালেরিয়া এখনও উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে একটি ব্যাপক বিস্তৃত রোগ এবং    মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বর্তমানে কুইনাইন ও ত্রি-চিকিৎসা পদ্ধতিতে বাংলাদেশে মারাত্মক ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা করা হয়।  [আনিস ওয়াইজ এবং বরেন চক্রবর্তী]

আরও দেখুন সিনকোনা; ডেঙ্গু; কালাজ্বর