সিনকোনা

সিনকোনা গাছ ও গাছের বাকল

সিনকোনা (Cinchona)  Rubiaceae গোত্রের চিরসবুজ উদ্ভিদ Cinchona। এর অনেকগুলি প্রজাতি বলিভিয়া থেকে কলম্বিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অ্যান্ডিজ (Andes) উচ্চভূমিতে জন্মে। সিনকোনার প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ৩৮; পত্রবিন্যাস বিপ্রতীপ, ফুল গুচ্ছবদ্ধ, গোলাপি বা সাদা, কখনও সুগন্ধি। সিনকোনা ম্যালেরিয়া ও অন্য কয়েক ধরনের জ্বরের ঔষধের উৎস। এই জাতীয় গাছে অন্যান্য ক্ষারক (alkaloid) আছে, যেগুলিকে একক বা মিশ্র হিসেবে টোটাকুইনা (totaquina) বলা হয়। এসব দ্রব্য কিছুটা ভেষজ গুণসম্পন্ন। সিনকোনার বাকল থেকে প্রাপ্ত প্রায় ৩০টি চিহ্নিত রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে কুইনাইন সর্বোত্তম, অতঃপর ক্রমান্বয়ে কুইনিডাইন, সিনকোনিডাইন, সিনকোনাইন ইত্যাদি। সিনকোনার নামকরণ পেরুর সিনকোন রাজ্যের রানীর স্মরণে। জনশ্রুতি, এই গাছের বাকল থেকে তৈরি ঔষধে তিনি ১৬৩৮ সালে জ্বর থেকে আরোগ্য লাভ করেন। আমেরিকার আদিবাসীরা এই গাছের ভেষজ সম্পর্কে অবহিত ছিল। আমেরিকা থেকে স্পেনে এবং অতঃপর মিশনারিদের মাধ্যমে এই গাছের ছালের জ্বরনাশক গুণাবলির সংবাদ এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীর অঞ্চলে পৌঁছায়। ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার ক্লিমেন্ট মারখাম (Sir Clement Markham) ১৮৬২ সালে বাংলায় সিনকোনা চাষ প্রবর্তন করেন। এ সময় বাংলার কোন কোন অঞ্চলে ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরের ব্যাপক প্রকোপ ছিল।

দার্জিলিং, আসাম ও সিকিমে সিনকোনা চাষের উপযোগী জলবায়ু, মাটি ও ভূখন্ড থাকায় এসব স্থানে ১৮৭০ দশকে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকটি সিনকোনা বাগান গড়ে ওঠে। দার্জিলিং-এ গড়ে ওঠে সিনকোনার কারখানা। এখানে তিন প্রজাতির সিনকোনা চাষ হতো- লাল বাকল, Cinchona succirubra; হলুদ বাকল, C. ledgeriana এবং বাদামি বাকল, C. officinalis। দার্জিলিং কারখানায় সিনকোনা ছাল থেকে জ্বরনাশক মিশ্র ও কুইনাইন- দুটিই উৎপন্ন হতো। ১৯০৫ সাল নাগাদ ভারত কুইনাইন উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে উঠেছিল। তারপরই ভারত থেকে সিনকোনা ও কুইনাইন রপ্তানি শুরু হয়।

রোগবিষয়ক ইতিহাসবিদদের মতে কুইনাইনের কল্যাণেই বাংলা ম্যালেরিয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিল। লোকদের ম্যালেরিয়া থেকে আরোগ্যের জন্য শহর ও গ্রাম সর্বত্রই যাতে কুইনাইন সহজে পৌঁছায় সেজন্য সেটি নামমাত্র মূল্যে ডাকঘরের মাধ্যমে বিলি করা হতো। বর্তমানে সিনকোনাজাত কুইনাইনের বিকল্প হিসেবে উদ্ভাবিত হয়েছে আধুনিকতর কয়েকটি কৃত্রিম ঔষধ। তবে বাংলাকে দেওয়া দার্জিলিং-এর সিনকোনার সেবা দেশের স্বাস্থ্যরক্ষার ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে আছে। [সিরাজুল ইসলাম]