মূলনীতি কমিটি

মূলনীতি কমিটি  ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত  পাকিস্তান গণপরিষদ কর্তৃক পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে সুপারিশ দানের উদ্দেশ্যে গঠিত একটি সংসদীয় কমিটি। এই লক্ষ্যে গণপরিষদ ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে নতুন সংবিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে অভিলক্ষ্য প্রস্তাব (Objective Resolution) নামে একটি প্রস্তাব পাস করে। প্রস্তাবটি পাসের পর গণপরিষদ ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ অভিলক্ষ্য প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধানের মৌলনীতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি কমিটি নিয়োগ করে। ২৪ সদস্যের এই কমিটি ‘মূলনীতি কমিটি’ নামে পরিচিত। এ কমিটিকে অনধিক ১০ জন সদস্য কো-অপ্ট করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়, যারা গণপরিষদের সদস্য নাও হতে পারেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মূলনীতি কমিটির আহবায়ক। মূলনীতি কমিটি চারটি সাব-কমিটি গঠন করে। সাব-কমিটিগুলো ছিল নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের তালিকা প্রণয়নকারী সাব-কমিটি; ভোটাধিকারের নীতিনির্ধারক সাব-কমিটি; বিচার সম্পর্কিত সাব-কমিটি এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক সংবিধানের রূপরেখা প্রণয়ন ও ক্ষমতা বণ্টন সাব-কমিটি।

মূলনীতি কমিটি অভিলক্ষ্য প্রস্তাব সম্পর্কে পরামর্শ দানের জন্য ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে তালিমাত-ই-ইসলামিয়া নামে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। মূলনীতি কমিটি সাব-কমিটিগুলোকে পরামর্শ দানের জন্য প্রয়োজনবোধে সর্বোচ্চ ৩ জন টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞকে কমিটিভুক্ত করার ক্ষমতা প্রদান করে। মূলনীতি কমিটি ১৯৫০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর একটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট দাখিল করে। এই রিপোর্টে একটি ইউনিট পরিষদ ও গণপরিষদসহ দ্বি-কক্ষ আইনসভা নিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ইউনিট পরিষদে পাকিস্তানের সকল ইউনিটের (প্রদেশের) প্রতিনিধিত্ব থাকবে এবং গণপরিষদ জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবে। কমিটি গণপরিষদের আসনসংখ্যা উল্লেখ থেকে বিরত থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্টে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রের প্রস্তাব ছিল। প্রেসিডেন্টকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার এবং সংবিধান স্থগিতের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে সন্দেহ ও বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি করে। পূর্ব বাংলা এই খসড়ার তীব্র বিরোধিতা করে এই যুক্তিতে যে, এতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্টের প্রতিবাদে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে কতিপয় আইনজীবী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকায় একটি ‘গণতান্ত্রিক ফেডারেশন বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করে। ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসের ৪-৫ তারিখ ঢাকায় গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের উদ্যোগে একটি প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলন একটি বিকল্প সংবিধানের প্রস্তাব উত্থাপন করে। এই প্রস্তাবে ছিল কেবলমাত্র মুদ্রা, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে রেখে প্রদেশগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তাসহ একটি প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার সুপারিশ। সম্মেলন জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচিত এককক্ষ আইন পরিষদ গঠনের প্রস্তাব করে। সম্মেলনে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান হয়।

সম্মেলনে গণতান্ত্রিক ফেডারেশন প্রণীত বিকল্প সাংবিধানিক প্রস্তাবগুলো জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লাভ করে। উক্ত সাংবিধানিক প্রস্তাব অনুমোদনের দাবিতে ১৯৫০ সালের ১২ নভেম্বর ধর্মঘট পালিত হয়। পূর্ব বাংলা থেকে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্টের চূড়ান্ত অনুমোদন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রেখে এই রিপোর্টের উপর জনমত আহবান করা হয়। গণপরিষদ তখন অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্টের প্রস্তাব এবং সমালোচনা পরীক্ষার জন্য আবদুর রব নিশতারের সভাপতিত্বে একটি সাব-কমিটি নিয়োগ করে। সাব-কমিটি প্রয়োজনীয় পর্যালোচনা শেষে ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে মূলনীতি কমিটির নিকট রিপোর্ট দাখিল করে। মূলনীতি কমিটি এ রিপোর্টের ভিত্তিতে গণপরিষদে পেশ করার জন্য দ্বিতীয় খসড়া রিপোর্ট প্রণয়ন করে।

১৯৫২ সালের ২২ ডিসেম্বর মূলনীতি কমিটির দ্বিতীয় খসড়া রিপোর্ট গণপরিষদে উপস্থাপিত হয়। এ রিপোর্টের বৈশিষ্ট্য ছিল: (১) সংসদ দ্বি-কক্ষ হবে; ইউনিট পরিষদের মোট ১২০ সদস্যের ৬০ জন নির্বাচিত হবেন পূর্ব বাংলা থেকে। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আসন বণ্টন ছিল, পাঞ্জাব ২৭, সিন্ধু ৮, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ৬, উপজাতীয় এলাকাসমূহ ৫, বাহওয়ালপুর ৪, বেলুচিস্তান ও বেলুচ রাজ্যসমূহ ৪, খয়েরপুর ২ এবং রাজধানী করাচী ৪। গণপরিষদের সদস্যসংখ্যা নির্ধারিত হয় ৪০০ এবং আসন বণ্টন করা হয়নিম্নোক্তভাবে: পূর্ব বাংলা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ২০০, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত ২০০; (২) রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন এবং দুই কক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা বিষয়টি মীমাংসিত হবে। মূলনীতি কমিটির দ্বিতীয় খসড়া রিপোর্ট পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সমতার নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছিল।

কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্টের মতো মূলনীতি কমিটির দ্বিতীয় খসড়া রিপোর্টও বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এবার পাঞ্জাবিরা এই যুক্তির ভিত্তিতে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে যে, এতে বাঙালিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। মূলনীতি কমিটির দ্বিতীয় খসড়া রিপোর্ট সম্পর্কে পাঞ্জাবের বিরোধিতার মুখে গণপরিষদ আরেকবার এর বাস্তবায়ন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতুবি রাখে। গণপরিষদ কর্তৃক মূলনীতি কমিটির দ্বিতীয় খসড়া রিপোর্ট গ্রহণের পূর্বেই খাজা নাজিমউদ্দিন মন্ত্রিসভা বরখাস্ত হয় (১৬ এপ্রিল ১৯৫৩) এবং বগুড়ার মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মূলনীতি কমিটি বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে কেন্দ্রীয় আইনসভার আসন বণ্টনের প্রস্তাব পাঞ্জাব ও পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক গ্রহণযোগ্য বিবেচিত না হওয়ায় নতুন প্রধানমন্ত্রী আসন বণ্টন ব্যবস্থা সংশোধন করার উপর জোর দেন। তিনি একটি নতুন প্রস্তাব পেশের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে একটি সমঝোতা সৃষ্টিতে সফল হন। এই সূত্র অনুসারে কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বি-কক্ষ হবে এবং উভয় কক্ষের সমান ক্ষমতা থাকবে। উচ্চ কক্ষের মোট ৫০ আসনের মধ্যে ১০ থাকবে পূর্ব বাংলার জন্য আর ৪০ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। নিম্ন কক্ষের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৫ আসন থাকবে পূর্ব বাংলার জন্য। দুটি কক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে যৌথ অধিবেশনের মাধ্যমে তার সমাধান করা যাবে; তবে যৌথ অধিবেশনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রতিটি প্রদেশের ৩০% সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন হবে। সুতরাং উচ্চকক্ষে পূর্ব বাংলার মাত্র ১০ আসন থাকলেও এই সূত্রমতে সম্মিলিতভাবে উভয় কক্ষে সমতা বজায় ছিল। বিধান রাখা হয় যে, কোনো সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রপ্রধান উভয় কক্ষ ভেঙে দেবেন।

মোহাম্মদ আলীর সূত্রের আলোকে মূলনীতি কমিটির সংশোধিত রিপোর্ট ১৯৫৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয়। চূড়ান্ত রিপোর্টটি ছিল দীর্ঘ ৮০ পৃষ্ঠার। সতেরোটি অংশে বিভক্ত এই দলিলের প্রধান বিষয়গুলো ছিল নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা, সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন প্রক্রিয়া, বিচার বিভাগ, কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সম্পর্ক, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা ইত্যাদি। তারপর সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য মূলনীতি কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত খসড়া কমিটির কাছে প্রেরিত হয়। ১৯৫৪ সালের ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় সংসদ অধিবেশনে আলোচনার জন্য রিপোর্ট পেশ করার কথা ছিল। কিন্তু খসড়া কমিটির কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর গভর্নর জেনারেল এ অজুহাতে গণপরিষদ ভেঙে দেন যে, ‘সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে’ এবং গণপরিষদ ‘জনসাধারণের আস্থা হারিয়েছে।’ এভাবে প্রথম গণপরিষদ ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূলনীতি কমিটিরও স্বাভাবিক বিলুপ্তি ঘটে। তা সত্ত্বেও মূলনীতি কমিটির সুপারিশসমূহ পরবর্তী গণপরিষদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তী গণপরিষদ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান পাস করে।  [মোঃ মাহবুবুর রহমান]